কালীর বিভিন্ন রূপ
অধ্যাপক জয়দীপ চক্রবর্তী

কালী দশ মহাবিদ্যার প্রথম মহাবিদ্যা। ইনি ভীষণা ভয়ঙ্করী। মৃত অসুর এনার কানের কুন্ডল। মহাকালরূপী শিবের ওপর ইনি বিপরীত মুদ্রায় রমণ রতা। এই মূর্তি মাতৃজ্ঞানে পুজো হয় না। বর্তমানে যে মূর্তি পুজো হয় তা কারুর মতে বশিষ্ট মুনি আবার কারুর মতে আগমবাগিশ মুনির ধ্যান কল্পে পাওয়া। সিদ্ধেশ্বরী কালী হলেন, যে কালীর কাছে সাধনা করে কোনো সাধক সিদ্ধি লাভ করেন। এই ক্যাটাগরিতে মা তাঁরা, ভবিতারিণী, কালীঘাটের কালী সবই সিদ্ধেশ্বরী কালী। 

দশমহাবিদ্যার পর আসেন চামুন্ডা কালী। চন্ড মুণ্ড রক্তবীজ বধের সময় মা দুর্গার শরীর থেকে আবির্ভাব এনার। ভীষণা ভয়ঙ্করী বিস্তৃত বদনাং লোল জিওভা শুস্ক মাংসদি ভৈরবা। পরনে ব্যাঘ্র চর্ম। ইনি তাঁর সামনে যা থাকে সব গিলে নেন। ইনি এতই ভয়ঙ্করী স্বয়ং মহাদেব এনাকে দেখে ভয়ে চোখ বুজে ফেলেন। কোনও বাড়িতে এনার পুজো হয় না। একমাত্র দুর্গা পুজোয় সন্ধি পুজোর সময় মা দুর্গাকে চামুন্ডা রূপে পুজো করা হয়। এনার বীজ মন্ত্র হ্রিং। কলকাতায় চেতলাতে প্রচুর চামুন্ডা কালীর পুজো হয়। ভয়ঙ্কর দেখতে সব মূর্তিগুলো। দর্শনীয় বস্তু। চামুন্ডা কালীর বিভিন্ন ভাগ আছে। যেমন শ্বেত চামুন্ডা, রক্ত চামুন্ডা প্রভৃতি।

এরপর রক্ষা কালী। ইনি দু–‌হাতের কালী। জিভ বের করা নেই। একহাতে রুধিরের পাত্র আরেক হাতে বরাভয়। বৈশাখ মাসের অমাবস্যায় এনার পুজো হয়। ইনি সূর্যের মুখ দেখেন না। সূর্য অস্ত যাবার পর এনাকে আসনে বসিয়ে পুজো করে আবার পরের দিন সূর্য ওঠার আগেই বিসর্জন দিতে হয়। শেওড়াফুলির কাছে শকুন্তলা কালীবাড়িতে খুব বড় করে রক্ষা কালী পুজো হয়। ঠাকুরের গায়ে ১০০ভরি সোনার গয়না থাকে, যা সবই মানতের। আগে এখানে এক রাতে ১০০০ পাঁঠা বলি হত। আমি বলছি ২০০৫–২০০৬ সালের কথা। এখন হয় কিনা জানি না। কোনও বাড়িতে এনার পুজো হয় না।

কালীর ধ্যানে কালীকে বর্ষার বজ্র গর্ভ মেঘের সঙ্গে সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে। তাই কালীর আসল রং কালো অথবা ধূসর। ইনি চার হাতের কালী। এক হাতে খর্গ। একহাতে ছিন্ন মুণ্ড। একহাতে প্রার্থনা অন্য হাতে বরাভয়। শবরূপী শিবের ওপর ইনি দন্ডায়মান। গলায় ৫২টি মুন্ডমালা। যোনিস্থল মানুষের হাত দ্বারা আবৃত। তন্ত্র ও গৌড়ীয় বৈষ্ণব শাখার মিলনে যে কালীর উদ্ভব তাঁর রং মেঘমুক্ত আকাশের মতো। ইনি গৃহে পূজিতা হন। ইনি শুভঙ্করী শক্তির প্রতীক। তবে এনার রূপ ও ওপরের কালো বা ধূসর কালীর মতোই। পুজোর পদ্ধতিও একই। তবে শাস্ত্র মতে ইনি বৈষ্ণবী। তাই এনার ভোগে মাংস বা মাছ থাকে না।

বলিটা পুরোটাই আমাদের ভুল কনসেপ্ট। তন্ত্রে যে ছাগ বলির উল্লেখ আছে সেই ছাগ মানে আমাদের ষড়রিপু। কিন্তু ব্রাহ্মন্যবাদী সমাজ নিজেদের স্বার্থে ছাগ মানে ছাগ শিশুকে কল্পনা করে নেন ষড়রিপুর প্রতিভূ বলে। ওই জন্য একদম কুচকুচে কালো পাঁঠা বলি দেওয়া নিয়ম। কোথাও কোথাও মোষ বলি হয়, যেমন বর্ধমানের সর্বমঙ্গলা কালী বাড়িতে। অবশ্য মোষ বলি আমি কোনওদিন দেখিনি, শুনেছি।

সবচেয়ে আশ্চর্য হল কালী পুজোয় আগে পুরীর জগন্নাথ মন্দিরে বলি হত। কারণ জগন্নাথ মন্দিরে বিমলার মন্দির আছে। এই মন্দির ৫১পীঠের এক পীঠ। এখানে জগন্নাথ ভৈরব। এখানেও গৌড়ীয় বৈষ্ণব এবং শক্তি তন্ত্র একজায়গায় অঙ্গাঙ্গিভূত। আর যে সব তান্ত্রিক খুব নিম্নমানের তন্ত্র সাধনা করেন বা করতেন যেমন হাকিনি বিদ্যা বা ডাকিনি বিদ্যা তাঁদের সাধনার অন্যতম উপাচার নরবলি। তবে এখন ভারতবর্ষের কোথাও হয় কিনা জানা নেই। এটা আমাকে তারাপীঠের এক তান্ত্রিক বলেছিলেন। সত্য মিথ্যা জানি না।

আমি তারাপীঠের শ্মশানে অনেকবার রাতে অনেকক্ষণ কাটিয়েছি। সেখানে থেকে এই জ্ঞান লাভ। আর আগেকার দিনে ডাকাতকালীর পুজোতে  নরবলি দেওয়া হত। বলির পশুকে এক কোপে কাটতে হয়। কারণ এক কোপে না কাটলে বলা হয় ওই পশুকে অন্য কেউ কামনা করেছে। তাকে বলি বেঁধে যাওয়া বলে। বেঁধে যাওয়া বলির মাংস খাওয়ার যোগ্য বলে বিবেচিত হয় না। বলির মাংসকে বলে মহাপ্রসাদ। আদা গরম মসলা দিয়ে পেঁয়াজ রসুন ছাড়া রান্না করতে হয়।

ছবি:‌ লেখক ও আন্তর্জাল

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *