কালীপুজো ও বুড়িমার
চকলেট বোমা
সুমন কল্যাণ চক্রবর্তী

বাঙালির কালীপুজো মানেই একসময়ের নিয়ম ছিল বুড়িমার চকলেট বোমা। তবে চকলেট বোমা নিষিদ্ধ হলেও এখন বুড়িমা ফায়ার ওয়ার্কসের আতসবাজির আলোতেই ঘোচে শ্যামাপুজোর অমাবস্যার অন্ধকার। তিনি সবার কাছেই ‘বুড়িমা’‌। বাবারও, ছেলেরও। তাঁর চকোলেট বোম না হলে তো কারও কালীপুজোই জমত না একটা সময়ে। এখন ডেসিবেল ধরে বাজির শব্দ মাপার যুগে সে নাম অনেকটাই মলিন। নয়ের দশকের নস্টালজিয়া ছিল বুড়িমার চকলেট বোম। কান ফাটানো আওয়াজের, ভয় ধরানো আলোর চকলেট বোমের প্যাকেটের ওপর থাকত নিরীহ বুড়িমার ছবি। বুড়িমা, বাঙালি নারী হিসেবে যিনি এক আশ্চর্য নজির গড়ে গেছেন।

বুড়িমার নাম অন্নপূর্ণা দাস। জন্ম বাংলাদেশের ফরিদপুর জেলায়। কম বয়সে বিয়ে হয়। তিন মেয়ে ও এক ছেলের মা। ছেলেমেয়েরা ছোট থাকতেই মৃত্যু হয় স্বামী সুরেন্দ্রনাথ দাসের। দেশভাগের পর সন্তানদের নিয়ে পূর্বতন পশ্চিম দিনাজপুর জেলার ধলদিঘির সরকারি ক্যাম্পে আশ্রয় নেন। সেটা ১৯৪৮ সাল। পেট চালাতে ধলদিঘির বাজারে সবজি বেচে সন্তানদের মুখে অন্ন তুলে দিতেন অন্নপূর্ণা। কঠিন জীবনের লড়াই সামলাতে একসময় ধলদিঘি থেকে গঙ্গারামপুরে চলে যান অন্নপূর্ণা দাস। এই সময় বিড়ি বাঁধার কাজও করতেন। কিছুদিন পর নিজেই বিড়ির ব্যবসা শুরু করেন। ব্যবসা জমে যায়। ছোটখাটো একটা বিড়ির কারখানা হয়। এই পর্বে মেয়ের বিয়ে দেন বেলুড়ে। সেই সূত্রে নিজেও চলে আসেন বেলুড়ে। বেলুড়ের প্যারিমোহন মুখার্জি স্ট্রিটে একটা দোকান–সহ বাড়ি কিনে ফেলেন। স্থায়ী ঠিকানা হওয়ার পর বুদ্ধিমান উদ্যোগপতির মতো ব্যবসা বাড়ান অন্নপূর্ণা।

বিড়ির সঙ্গে আলতা ও সিঁদুরের ব্যবসা করেন। এখানেই থেমে না থেকে বিশ্বকর্মা পুজোর সময় ঘুড়ি, দোলে রং এবং কালীপুজোয় বাজির ব্যবসাও শুরু করেন। তবে তখনও নিজে তৈরি করতেন না, মহাজনের কাছ থেকে মাল কিনে বিক্রি করতেন। ততদিনে অন্নপূর্ণা দাসের বয়স হয়েছে। স্থানীয় দোকানি থেকে সাধারণ ক্রেতারা তাঁকে ‘বুড়িমা’ সম্বোধন করে। এই ‘বুড়িমা’ শব্দটাকেই বাজির ব্যবসার ব্র্যান্ডিং–এ কাজে লাগালেন অন্নপূর্ণা। নানারকম বাজি তৈরি করে বিক্রি করা শুরু করলেন।

সেইসঙ্গে মাথা খাটিয়ে তৈরি করেন ছোটো গোল গোল এক ধরনের বাজি। যাতে আগুন দিলেই শব্দ করে ফেটে যায়। এই বাজির নাম দিলেন চকোলেট বোমা। এরপর দ্রুত‌ই বুড়িমার চকোলেট বোমার নাম ছড়িয়ে পড়ল সর্বত্র। বিখ্যাত হল ‘বুড়িমার চকলেট বোম’‌। এখানেই শেষ হয়নি অন্নপূর্ণার সফর। অন্ধ্রপ্রদেশের শিবকাশীতে একটি দেশলাই কারখানা তৈরি করেন। ডানকুনিতে চলতে থাকে তাঁর বাজির কারখানা। ১৯৯৫ সালের ৩ জুন মৃত্যু হয় বুড়িমার। তার পরে একমাত্র পুত্র সুধীরকুমার দাস ব্যবসা চালান। এখনও চলছে ‘বুড়িমা ফায়ার ওয়ার্কস’‌। এখন ব্যবসা দেখেন বুড়িমার পুতি (প্রপৌত্র) সুমিত দাস।

বুড়িমা ছিল নয়ের দশকের নস্টালজিয়া। ১৯৯৬ সালে সরকারিভাবে সেই নস্টালজিয়া গত হয়। কারণ ওই বছরেই ৯০ ডেসিবেল ও তার বেশি যাবতীয় শব্দবাজি নিষিদ্ধ হয়। বুড়িমা ব্র্যান্ডের ব্যবসা অবশ্য তাতে মার খায়নি। পরবর্তী প্রজন্ম আলোর বাজির ব্যবসা করছেন ঝকমকিয়ে। তবে চকলেট বোম জিনিসটা ওই বছরেই উঠে যায়। শব্দদূষণের কারণে চকোলেট বোম এখন লুপ্তপ্রায়। আজও বাঙালির সবচেয়ে বিখ্যাত বাজির ব্র্যান্ড বুড়িমা। এখনও বহু দূর থেকে ক্রেতারা বেলুড়ে বুড়িমার বাড়িতে বাজি কিনতে আসেন।

সব ছবি: আন্তর্জাল

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *