হিন্দুদের কালীপুজোয়
পাঁঠা বলি আদৌ যুক্তিসঙ্গত নয়
সুমন কল্যাণ চক্রবর্তী
বাঙালি হিন্দুদের কালীপুজো উপলক্ষ্যে প্রকাশ্যে ঢাক, ঢোল, কাঁসর বাজিয়ে আসুরিক দৃষ্টিভঙ্গিতে যেভাবে যুগ যুগ ধরে পাঁঠা বলি হয়ে আসছে, সেটিকে ধর্মের নামে নৃশংসতা ছাড়া আর কিছুই বলা যায় না। বিশ্রী এই পাঁঠা বলির প্রথা বেদ, উপনিষদ, পুরাণ কিংবা গীতায় কোথাও উল্লেখ নেই। কোরান, বাইবেল বা ত্রিপিটক প্রভৃতি ধর্মগ্রন্থেও কোনো ধরনের প্রাণী হত্যার কথা শুনতে বা দেখতে পাওয়া যায় না। কলিযুগে সম্পূর্ণরূপে পশুবলি নিষিদ্ধ। ভগবান শ্রীবিষ্ণুর অবতার, বুদ্ধদেব সারা বিশ্বে পশুবলি নিষিদ্ধ করেছিলেন বলে জানা যায়। তাই পশুর রক্তে কালীঠাকুরের পুজো কীভাবে সম্ভব? ভগবানের পুজো অন্য কারোর জীবন বিসর্জন দিয়ে কখনোই সম্পন্ন হতে পারে না।
ভগবানের পুজো একমাত্র জীবপ্রেম, ভক্তি, শ্রদ্ধা, ভালোবাসার দ্বারাই সম্ভব। আমাদের মনে রাখতে হবে, কালীপুজো উপলক্ষ্যে পাঁঠাবলি, ‘সতীদাহ প্রথা’-র মতন একটি ভুল প্রথা। এই পাঁঠাবলি সনাতন ধর্মের গৌরবকে ক্ষুন্ন করা ছাড়া আর কিছুই নয়। পাঁঠাবলি পুরোপুরি অধর্মকে বহন করে। হিন্দু শাস্ত্রে পাঁঠাবলির কোনো উল্লেখ নেই, বরং আছে ‘ছাগ বলি’ দেওয়ার কথা। এই ‘ছাগ’ কথার অর্থ হল ‘ষড়রিপু’। কাম, ক্রোধ, লোভ, মোহ, মদ, মৎসয্য— এই ছ’টিকে একত্রে ‘ষড়রিপু’ বলা হয়। আর ‘ছাগ’ শব্দটিকে নিরীহ ‘ছাগল’ বা ‘পাঁঠা’ বানিয়ে পশুবলি দেওয়া হয় কালীঠাকুরের পুজোয়, যেটি ঘোরতর অন্যায়। প্রধানত আমাদের দেহে ‘কাম’ নামক যে রিপু আছে, ওটাই আসল পশু। নারী দেখলে এই পশুটাই হিংস্র হয়ে ওঠে। তাই সমাজের প্রতিটি নারীকে ‘মা কালী’ মনে করে ‘কাম’ নামক মনের এ পশুকে বলি দেওয়াটাই আসল রীতি। কিন্তু বাস্তবে মূর্খরা নিজের মনের পশুকে বলি না দিয়ে নিরীহ পাঁঠাকে বলি দিয়েই যাচ্ছে।
শ্রীমদ্ভাগবত (৫/২৬/৩১) শ্লোক থেকে জানা যায়, যারা পশুবলির দ্বারা ভৈরব বা ভদ্রকালী প্রভৃতির পুজো সম্পন্ন করে, হিংসা কবলিত সেই পশু যমালয়ে রাক্ষস হয়ে তাদেরকেই সেই রূপে বধ করে। জনশ্রুতি আছে, একবার রাজা সুরথ, মা কালীকে সন্তুষ্ট করার জন্য নাকি একশত পাঁঠা বলি দিয়েছিলেন, তখন সেই একশত পাঁঠারাই রাজা সুরথকে স্বর্গে যেতে রাস্তা আটকালে, তখন মা কালী রাজাকে বলেন যে, ‘আমি তো কখনও কোথাও বলিনি আমাকে সন্তুষ্ট করার জন্য পাঁঠা বলি দিতে হবে।’ অবশেষে রাজা সুরথকে তার পাপের শাস্তি হিসাবে, ঐ একশত পাঁঠাই একসঙ্গে সুরথকে বলি দিয়ে নিজের কর্মফল ভোগ করিয়ে শাস্তি প্রদান করে।
তাই কালীঠাকুরের পুজোয় এই বর্বর পাঁঠা বলির বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ জানিয়ে মানুষকে কুসংস্কার থেকে মুক্ত করে সঠিক ধারণা জ্ঞাপন করিয়ে এই ‘পাঁঠা বলি’ প্রথা থেকে সরিয়ে আনতে বদ্ধপরিকর হওয়া উচিত। শুধুমাত্র আইন করে অথবা প্রশাসনের উপর দায়িত্ব না দিয়ে বাঙালি হিন্দু সমাজে পাঁঠাবলিকে বন্ধ করে কালী ঠাকুরকে ভক্তিরূপে পুজো করে পরম তৃপ্তি লাভ করাই হোক আমাদের উদ্দেশ্য; বাঁচতে দেওয়া হোক নিরীহ পশুগুলিকে৷
ছবি: আন্তর্জাল
Leave a Reply
Your email address will not be published. Required fields are marked *
Comments