আজ ২১ ফেব্রুয়ারি। বাঙালি হিসেবে গর্বের দিন, অহংকারের দিন, বেদনার দিনও
অমর একুশে
ডঃ সঞ্জীব রায়
১৯৪৮ সাল। তখন মানচিত্রে সদ্য ভিন্ন হয়ে যাওয়া বিষণ্ণতায় মোড়া প্রতিবেশী দুটি দেশ ভারত ও পাকিস্তান। দেশ ভাগের দগদগে ঘা তখনও তাদের সারা শরীরে ও মনে। গোদের ওপর বিষফোঁড়ার মতন পাকিস্তানের জাতির জনক মহম্মদ জিন্না সাহেব ২১ মার্চ ঢাকার রমনা রেসকোর্স ময়দানে বলে বসলেন, ‘পাকিস্তানের সর্বত্র উর্দু ভাষাই একমাত্র সরকারি ভাষা হিসেবে স্বীকৃত হবে।’ বাঃ! বাঃ! যেখানে সমগ্র পাকিস্তানের লোকসংখ্যার অর্ধেকের বেশি মানুষের ভাষা বাংলা, তাদের মাতৃভাষা ভালোবাসার ভাষা, সেটা রয়ে যাবে স্বীকৃতিহীন! মিটিং বা সমাবেশের একাংশ থেকেই গুঞ্জন ওঠে— মাতৃভাষার অপমান মানে দেশমাতৃকার অপমান, সহ্য করা হবে না।
গুঞ্জন থেকে জন্ম নেয় প্রতিবাদ। প্রতিবাদ সংগঠিত হবার জন্য তৎকালীন ঢাকার বুদ্ধিজীবীদের অবদান অনস্বীকার্য। তাঁরা জনগণকে বোঝাতে পেরেছিলেন মাতৃভাষার তাৎপর্য ও গুরুত্ব। তবে সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ যে কাজটা করেছিলেন, তা হচ্ছে মাতৃভাষার আবেগটাকে সযত্নে জনগণের মনে বপন করা, যা কিনা মিটিং মিছিল নিষিদ্ধ করে দমানো সম্ভব হয়নি।
২১ ফেব্রুয়ারি ১৯৫২। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে ছাত্রদের নেতৃত্বে বিশাল সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। দাবি একটাই— মর্যাদার সঙ্গে মাতৃভাষার স্বীকৃতি। পুলিশ প্রথমে টিয়ার গ্যাস ও পরে নির্বিচারে গুলি চালায়। শতাধিক মানুষ আহত হবার সঙ্গে সঙ্গে পাঁচ জন ছাত্র শহীদ হয়। তাঁরা হলেন আব্দুস সালাম, আবুল বরকত, রফিক আহমেদ, আবদুল জব্বার ও শফিউর রহমান। ইতিহাসের পাতায় তাদের স্থান হয় ভাষা আন্দোলনের শহীদ হিসেবে। অন্যদিকে বলা যেতে পারে এই ভাষা আন্দোলন কিন্তু প্রকৃতপক্ষে পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধীনতা আন্দোলনের বীজ বপন করেছিল যা বাংলাদেশ নামক এক স্বাধীন রাষ্ট্রের জন্ম দেয়। সেই অর্থে এই পঞ্চরত্নের জীবন উৎসর্গ নিঃসন্দেহে পরাধীনতার মোচনেও তাৎপর্যপূর্ণ।
১৯৯৯ সাল অবধি ২১ ফেব্রুয়ারি দিনটি নেহাতই বেদনার দিন হিসেবে বাংলাদেশে পালিত হতো। সমগ্র বাংলাদেশ জুড়ে দিনটি চিহ্নিত হত শোক দিবস হিসেবে। কিন্তু ১৯৯৮ সাল থেকেই দিনটির পদমর্যাদা নিয়ে নতুনভাবে ভাবনাচিন্তা শুরু হয়। নিঃসন্দেহে তার সংক্ষিপ্ত উল্লেখ প্রয়োজন।
রফিউল ইসলাম এবং আব্দুস সালাম, দুই প্রাণের বন্ধু কর্মসূত্রে থাকে ভ্যাঙ্কুবারে (কানাডা)। তারা মিলিতভাবে একটি চিঠি লেখে তৎকালীন রাষ্ট্রপুঞ্জের সেক্রেটারি কোফি আন্নানকে। চিঠিতে অনুরোধ করা হয় যাতে রাষ্ট্রপুঞ্জ ২১ ফেব্রুয়ারি দিনটিকে ‘আন্তর্জাতিক ভাষা দিবস’ হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। চিঠির একটি কপি পাঠানো হয় বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী মুজিব কন্যা শেখ হাসিনার কাছে। জাতিসঙ্ঘ চিঠিটির যথাযথ গুরুত্ব না দিলেও বাংলাদেশ সরকার ওই চিঠির পরিপ্রেক্ষিতে একই আবেদন নিয়ে সংসদে একটি প্রস্তাব দাখিল করে, যা সর্বসম্মতিক্রমে পাশ হয়। ওই প্রস্তাবের কপিসহ একটি চিঠি বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে জাতিসঙ্ঘের কাছে পাঠানো হয়। বলাবাহুল্য সে চিঠিতে অনুরোধ ছিল না, ছিল এক দাবি।
জাতিসঙ্ঘ এবারে বিষয়টিকে গুরুত্ব দেয়। অবিলম্বে সভ্যদের নিয়ে সভা ডাকে। উক্ত সভায় প্রস্তাব উত্থাপন করলে সহজেই তা পাশ হয়ে যায়। সেখানে বলা হয়, মাতৃভাষার জন্য শহীদ হওয়া নিশ্চিতভাবে বিশ্বে বিরল। জাতিসঙ্ঘ ওই দিনটিকে আন্তর্জাতিক ভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। দিনটি ছিল ১৭ নভেম্বর ১৯৯৯। সেইমতো ২০০০ সাল থেকে সারা বিশ্বে রাষ্ট্রসঙ্ঘের অধীন ১৮৮টি দেশ ২১ ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক ভাষা দিবস হিসেবে মান্যতা দিয়ে আসছে। বাংলাদেশ ওই দিনটি ছুটি ঘোষণা করে এবং ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের সামনে শহীদ মিনারের পাদদেশে নানা অনুষ্ঠানের মাধ্যমে দিনটিকে উদযাপন করা হয়।
পরিশেষে বলা যায়, ২০০০ সাল থেকে বাংলাদেশের জনগণের কাছে ২১ ফেব্রুয়ারি নিঃসন্দেহে অন্য স্বাদের। বেদনার ২১ ফেব্রুয়ারি খানিকটা হলেও উন্নিত হয় আনন্দের দিন, গর্বের দিন হিসেবে। এ গর্ব বা অহংকার শুধু একটা দেশের নয়, এ গর্ব বিশ্বে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা সমগ্র বাংলা ভাষাভাষীর। স্বভাবতই প্রতিবেশী হিসেবে আমরাও এর ভাগীদার।
সকলের ঐকান্তিক প্রচেষ্টা ও মাতৃভাষার প্রতি ভালোবাসা দিয়েই আমরা সার্থক করে তুলতে পারি ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি...।’
মাতৃভাষার টানে
রাজীব হাসান
বাংলা গানে একুশের টান
লেখা আছে বুঝি
ভাষার টানে সবার মাঝেই
বাংলাটাকে খুজি।
আমি বাঙালি তাই বাংলা
আমার মাতৃভাষা
দেশের জন্যে লড়তে হবে
বুকে সহস্র আশা।
মায়ের মুখে বাংলা শুনে
পড়ে গেছি প্রেমে
বাংলাকে তাই রক্ষা করতে
ঝাঁপ দিয়েছি গেমে।
রক্ষা করতে মায়ের ভাষা
দিয়েছি তাজা প্রাণ
স্বাধীন দেশে স্বাধীনতার
বাজে বিজয়ের গান।
অমর একুশের আশা
তন্ময় দাস
বাঙালির এই প্রাণের ভাষা
আমার ভাষা বাংলা
খাটি সোনায় গড়া ভিত্তি
মধুর ছন্দে ভাষা সেটি—
কোন দামে বিকোচ্ছো
এ অমূল্য দান?
হাজার নলের সামনে বীর—
প্রাণ দিল—নিসংকোচ শরীর
এ ভালোবাসার নিদর্শন—
কোথাও পাবে না এ পৃথিবীর।
প্রতি যুগের অন্ত শেষে
ভাষার আশায় শব্দ মিশে
না যেন হয় ভঙ্গুর।
অজুহাত আর অনুযোগে
না থেকে এই যুগে
কলম ধরো শক্ত হাতে।
সৃষ্টি করো নতুন নতুন।
বাঙালির এই প্রাণের ভাষা
মায়া ভরা বাংলা ভাষা—
জাত–বিজাতে সয়ে বয়ে
লয়ে চলো বুকে চষে
সৃষ্টি করো অমুল্য এক ধন।
পাখির ডানায় লেখা ‘রক্তাক্ত উন্মুক্ত’ ২১ ফেব্রুয়ারি
সুমন কল্যাণ চক্রবর্তী
ভাষাই হল কোনও দেশের মূল সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের ধারক, বাহক ও শক্তিশালী হাতিয়ার। মাতৃভূমি যদি একটি ফুল হয়, তার সুগন্ধই হল মাতৃভাষা। আর এই মাতৃভাষার মাধ্যমে কল্পনাশক্তি, আকুলতা, ব্যাকুলতা ও ভালোবাসা বিকশিত হয়। মাতৃভাষাকে যারা কেড়ে নিতে চায়, সেটিকে প্রতিহত করতে হয় শরীরের রক্ত দিয়ে, যা বাংলাদেশের মানুষ সারা বিশ্বকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়েছে। বাংলা ভাষা যে একটি আবেগ, পরমপ্রিয় ও অধিকার, সেটি বাংলাদেশের মানুষের কাছ থেকে শিখতে হয়েছে সারা বিশ্বকে। আত্মত্যাগ ও আন্দোলনের মাধ্যমে বাংলা ভাষাকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য এবং যেটি বাঙালি জাতির প্রেরণা ও ঔপনিবেশিক প্রভুত্ব তথা শাসনের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ ও জাতীয় ভাবনার উন্মেষ, সেটিকেই ‘আর্ন্তজাতিক মাতৃভাষা’ দিবস বলা হয়। ১৯৯৯ সালের ১৭ নভেম্বর, ইউনেস্কো ২১ ফেব্রুয়ারি দিনটিকে ‘আর্ন্তজাতিক মাতৃভাষা দিবস’ হিসেবে ঘোষণা করার আগে বাংলাদেশে এই দিনটি ‘শহীদ দিবস’ হিসেবে পালন করা হত। ১৯৪৮ সালের ২১ মার্চ বাংলাদেশের রেসকোর্স ময়দান (সোহরাওয়ার্দী উদ্যান)–এ মহম্মদ আলি জিন্নাহ যখন বলেন, ‘উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা’, তখনই এই কথার প্রবল আপত্তি জানিয়ে প্রতিবাদের ঝড় ওঠে। বেশ কয়েক মাস ধরে এই প্রতিবাদের ঝড় চলতেই থাকে। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি (৮ ফাল্গুন, ১৩৫৮, বৃহস্পতিবার) বাংলা ভাষাকে পূর্ব পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে আন্দোলনকারীরা পুলিশের গুলিবর্ষণের শিকার হন।
পুলিশের গুলিতে জব্বার, শফিউল, বরকত, রফিক, সালামসহ বেশ কিছু তরুণ যুবক শহীদ হয়েছিলেন এবং শতাধিক আহত হয়েছিলেন। এছাড়াও, এই ভাষা আন্দোলনের সঙ্গে আনোয়ারা খাতুন, বেগম আফসরুন্নেসা, লিলি খান, শাফিয়া খাতুন, সুফিয়া ইব্রাহিম প্রমুখ বেশ কিছু নারীরও উল্লেখযোগ্য ভূমিকা গ্রহণ করেছিলেন। এই প্রেক্ষাপটে মওলানা ভাসানির নেতৃত্বে সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা পরিষদ ১৯৫২ সালে ২১ ফেব্রুয়ারিকে ‘ভাষা দিবস’ পালনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। বাংলাদেশিরা গর্বের সঙ্গে তাই আজও বলেন, ‘আমরাই পৃথিবীর একমাত্র জাতি, যারা ভাষার জন্য জীবন দিয়েছি। এই বীর তরুণ শহীদের মাধ্যমে আমরা বাংলা ভাষায় কথা বলার অধিকার পেয়েছি, যা এক গর্বের বিষয়।’
২১ ফেব্রুয়ারি, সারা বিশ্বকে এটাই স্মরণ করায় যে, বাংলা ভাষাকে যথাযোগ্য মর্যাদা ও সম্মান প্রদান, বাংলা ভাষাকে বিলুপ্তির হাত থেকে রক্ষা এবং মাতৃভাষা বাংলাকে বিকশিত হওয়ার পূর্ণ সুযোগ দেওয়া। বাংলাভাষা শুধু শিক্ষাকেই উৎসাহিত করবে না, সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের উন্নয়ন এবং মর্যাদা প্রদর্শনের ক্ষেত্রেও এক বিশেষ অবদান রাখবে বলে বাংলাদেশের মানুষজন মনে করেন। এই ২১ ফেব্রুয়ারিতেই শহীদরা বাংলা ভাষাকে আত্মমর্যাদার চেতনা ও রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা এনে দিয়েছিল। আর তাতেই বোঝা যায়, মাতৃভাষা বাংলাকে বাংলাদেশের মানুষজন কতটা ভালোবাসেন। তারই সঙ্গে হয়ত বিশ্বের মানুষ অনুভব করেছিল ও শিখেছিল ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের প্রয়োজনীয়তা এবং বাংলাভাষার ভালোবাসার মন্ত্র।
২১ ফেব্রুয়ারি সম্পর্কে বিশিষ্ট ভাষাবিজ্ঞানী ডঃ হুমায়ুন আজাদ বাংলাভাষা ও শহীদদের প্রতি ভূয়সী প্রশংসা ও গর্ববোধ করেছিলেন। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরে ২১ ফেব্রুয়ারি দিনটিকে সরকারি ছুটির দিন হিসেবে ঘোষণা করা হয়। প্রত্যেক বছর ২১ ফেব্রুয়ারি ঢাকার শহীদ মিনারে শহীদদের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জানান রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী। এছাড়া, এই ঐতিহাসিক দিনটিতে নানা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের মাধ্যমে সম্মান জানানো হয়। বাঙালি জাতি যতদিন এই পৃথিবীতে থাকবে ততদিন একটা কথাই বলবে,
‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারী, আমি কি ভুলিতে পারি?’
তারই সঙ্গে হয়ত ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ ঘটে বাংলাদেশের মানুষের মুখে মুখে ফিরবে—
‘বাংলার মুখ আমি দেখিয়াছি, তাই পৃথিবীর রূপ খুঁজিতে যাই না আর।’
কিংবা, ‘মোদের গর্ব মোদের আশা, আ মরি বাংলা ভাষা।’
মায়ের ভাষা
কনক কুমার প্রামাণিক
বাংলা আমার মায়ের ভাষা
প্রথম শেখা বুলি,
প্রাণ জুড়ায় বাংলা ভাষায়
যখন কথা বলি।
গর্বে মোদের বুকটা ভরে
এই ভাষার তরে,
ভাষার জন্য লড়াই করে
বাঙালি অকাতরে।
বায়ান্নার একুশ তারিখ
ঝরে অনেক প্রাণ,
জীবন দিয়েই রক্ষা করে
মাতৃ ভাষার মান।
অমর একুশে
আয়শা সাথী
স্বাধীকার বজ্র ধামামা হুংকারিত প্রমত্ত ঝংকার
স্ব–তেজী তরুণ প্রাণের স্ব–হাস্য বলিদান,
প্রতিফলিত বজ্র নিশানা রুখে কুচক্রী শঠতা
রফিক–শফিকের বাংলা ভাষা, চির অম্লান!
হে বাংলা ভাষা,
মহাকালের মহাবীর লালন করে জাতিস্বত্বায়
বঙ্গ–বিসর্জন প্রত্যক্ষণে অবাক বিশ্বময়,
একুশের রক্তস্নাত রক্তিম রাজটীকায়
স্বগৌরবে আমি বাঙালি, তুমি রাষ্ট্রভাষা বাংলায়।
বেঁচে থাক মাতৃভাষা
দেবব্রত হাতী
একুশের হাত ধরে ফিরে ফিরে আসা
রুদ্র পলাশের আগুন ঝরা রঙের ছটা
আমাদের মনে করায় অমর শহীদের স্মৃতি,
তাঁদের রক্তাক্ত ইতিহাসের অমর কাহিনি।
ত্রিশ কোটি বাংলা ভাষাভাষী হৃদয় দিয়ে
আগলে রাখতে চায় অক্ষর, কথন, ভাষ্য।
একুশের স্মৃতির সরণি বেয়ে
মাতৃভাষার সঙ্কটে বারে বারে সঙ্কল্পের
দাবি নিয়ে ফিরে আসে একুশে—
মাতৃভাষায় শিক্ষানীতি প্রচলন,
প্রশাসনিক কাজে মাতৃভাষার প্রয়োগ,
সব পরীক্ষায় মাতৃভাষায় প্রশ্ন উত্তর লেখার
অধিকার, মাতৃভাষায় বিষয়ভিত্তিক বই রচনা,
মাতৃভাষায় বিজ্ঞান চর্চা, মাতৃভাষা পুষ্ট করে।
মাতৃভাষাকে বাঁচাতে, ভবিষ্যতের জন্য
বাঁচিয়ে রাখতে একুশ অমর হয়ে থাকুক।
সবচেয়ে প্রিয় মাতৃভাষা
প্রীতিময় রায়বর্মন
আজ মাতৃভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠার দিন। সেই অধিকার প্রতিষ্ঠায় ওপার বাংলা যেমন আত্মবলিদানে পিছপা হয়নি, তেমনই ভাষার জন্য আরও বহু আন্দোলন সংগঠিত হয়েছে বিশ্বজুড়ে। কোথাও সহিংস, কোথাও অহিংস, কোথাও আবার আন্দোলনের ব্যাটন হাতে স্কুল পড়ুয়ারা। আজ সেরকমই কিছু দেশের ভাষা আন্দোলনের সাক্ষী থাকব আমরা
নেতৃত্বে স্কুল পড়ুয়ারা
আন্দোলনের একেবারে সামনের সারিতে স্কুল পড়ুয়ারা। নেতৃত্বে তারাই। স্কুলে বাধ্যতামূলক হয় আফ্রিকানার ভাষায় (দক্ষিণ আফ্রিকায় বসবাসরত শ্বেতাঙ্গ ডাচদের জার্মান–ডাচ ভাষার মিশ্রণ) শিক্ষাদান। জোহানেসবার্গের সোয়েটোতে ১৯৭৬ সালের ১৬ জুন আন্দোলন সঙ্ঘটিত হয়। ছাত্রদের দাবি ছিল তাদের মাতৃভাষা জুলু এবং ব্যবহারিক লিঙ্গুয়া ফ্রাঙ্কা ইংরেজিতে শিক্ষা গ্রহন। বর্ণবিদ্বেষী সরকার আন্দোলনে যোগ দেওয়া ছাত্রদের মিছিলে গুলি চালায়। প্রাণ যায় শতাধিক মানুষের, যাদের বেশিরভাগই ছাত্র। এই আন্দোলন সুয়েটো অভ্যুত্থান নামে যেমন পরিচিত, তেমনই দিনটিকে বলা হয় ‘ডে অফ চাইল্ড’।
আত্মবলিদানের মধ্যে দিয়ে স্বীকৃতি আদায়
১৯৩৭ সালে মাদ্রাজ প্রেসিডেন্সির স্থানীয় কংগ্রেস সরকার স্কুলে হিন্দি শিক্ষা বাধ্যতামূলক করলে দক্ষিণ ভারতে ভাষার জন্য প্রথম প্রতিবাদ সংগঠিত হয়। প্রতিবাদ–আন্দোলনের চাপে তৎকালীন মাদ্রাজ প্রেসিডেন্সির ব্রিটিশ গভর্নরের হস্তক্ষেপে ১৯৪০ সালে হিন্দি শিক্ষা বাধ্যতামূলক আইনটি তুলে নেওয়া হয়। এরপর ১৯৬৫ সাল হিন্দিকে একমাত্র সরকারি ভাষা করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হলে ওই বছরের ২৬ জানুয়ারি এর বিরুদ্ধে তীব্রতর আন্দোলন শুরু হয়। প্রায় দু’মাস আন্দোলনের আগুনে উত্তপ্ত দক্ষিণ ভারত। প্রাণ যায় অনেকের। আন্দোলনের এপিসেন্টার তামিলনাড়ুর মাদ্রাজ (বর্তমান চেন্নাই)। গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো, বিশেষ করে মাদ্রাজ এবং আন্নামালয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরা। এরই মধ্যে ১৯৬৭ সালে হাজির হয় বিধানসভা নির্বাচন এবং নির্বাচনে জয়লাভ করে আন্দোলনকারী পক্ষ নেওয়া রাজনৈতিক দলগুলি। শেষ পর্যন্ত ১৯৬৭ সালেই হিন্দির সঙ্গে ইংরেজিকেও ব্যবহারিক সরকারি ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। এছাড়া আসামও ১৯৬১ সালে দেখেছে ভাষা আন্দোলন। তৎকালিন প্রাদেশিক সরকার শুধুমাত্র অহমীয় ভাষাকে আসামের একমাত্র সরকারি ভাষা করার সিদ্ধান্ত নিলে তার বিরুদ্ধে গর্জে ওঠে আসামের বাংলাভাষীরা। বিশেষত বরাক উপত্যকায়। আত্মবলিদানের মধ্যে দিয়ে বাংলা ভাষা আদায় করে তার যথাযথ স্বীকৃতি।
সংরক্ষণে আইন পাস
ইউরোপীয় ঔপনিবেশিক শাসকের দাপটে মার্কিন মুলেকে অনেক নেটিভ আমেরিকান ভাষা বিলুপ্ত হয়েছে। গত শতকের ষাট–সত্তরের দশকে যখন নাগরিক অধিকার আন্দোলন চলছে, তখন নেটিভ আমেরিকান ভাষা রক্ষার দাবিও ওঠে। দীর্ঘ ২০ বছর আন্দোলন এবং আলোচনার পর ১৯৯০ সালের ৩০ অক্টোবর যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন নেটিভ, আদি ও স্থানীয় ভাষা রক্ষা এবং সংরক্ষণের জন্য একটি আইন পাস হয়।
প্রাণ গেল বহু
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগে জাপানী ভাষার বিরুদ্ধে এবং পরবর্তীতে চীনা ভাষার বিরুদ্ধে আন্দোলনে প্রাণ গেছে অনেক তাইওয়ানবাসীর।
রাজনীতির গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু
কানাডাতে, বিশেষত কানাডার পূর্ব অংশের অঙ্গরাজ্য কুইবেকের রাজনীতিতে ভাষা অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু। এই অঞ্চল এক সময় নিজেদের সংস্কৃতি এবং ভাষার প্রশ্নে স্বাধীনতা চেয়েছিল।
গণভোটে জয় মাতৃভাষার
নিজের ভাষা কতটা প্রিয় বুঝিয়েছিল লাটাভিয়ানরা। সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং পরে রাশিয়ার অংশ হিসেবে থাকাকালীন রুশ ভাষাই ছিল লাটাভিয়ার প্রধান ভাষা। ২০১২ সালে কাজের জায়গায় রুশ ভাষাকে দ্বিতীয় ভাষা করার প্রশ্নে নেওয়া হয় গণভোট। গণভোটের রায়ে জয় হয় লাটাভিয়ানদের নিজস্ব ভাষার।
আরও...
বেলজিয়ামে ফ্রেঞ্চ–জার্মান–ডাচ, ইউরোপের বলকান অঞ্চল, স্পেনের বিভিন্ন অঙ্গরাজ্য, আফ্রিকার গোল্ড কোস্ট অঞ্চল; উনিশ শতকে গোটা মধ্যপ্রাচ্যে আরবি–ফারসি–তুর্কি বা তৎকালীন মেক্সিকোর উত্তরাংশে স্প্যানিশ–ইংরেজি; সপ্তদশ–অষ্টদশ শতকে চীনে ম্যান্ডারিন–মাঞ্চুরিয়ান বিরোধ ইত্যাদি নানাভাবে জাতিয়তাবাদী ও নিজ সাংস্কৃতিক রক্ষার আন্দোলনে উপলক্ষ্য হয়ে উঠেছিল ভাষা।
যে কোনও মানুষের কাছেই সবচেয়ে প্রিয় মাতৃভাষা। মায়ের ভাষা। তাকে কখনই অবহেলা করা যায় না। সংখ্যাগরিষ্ঠের ভাষাও যেমন থাকবে, তেমনই থাকবে সংখ্যালঘুর ভাষাও। প্রার্থনা, সংখ্যাগরিষ্ঠ যেন কখনই সংখ্যালঘুর ভাষাকে টুঁটি টিপে মারার ষড়যন্ত্র না করে, তাকে যেন থাকতে দেওয়া হয় সংখ্যাগরিষ্ঠের ভাষার মতো স্বাধীনভাবে স্বমহিমায়।
সব ছবি: আন্তর্জাল
Leave a Reply
Your email address will not be published. Required fields are marked *
Comments