ভারতের স্বাধীনতায়
হারিয়ে যাওয়া তিন বিপ্লবী
সুমন কল্যাণ চক্রবর্তী
ইংরেজ শাসনের হাত থেকে ভারতবর্ষকে স্বাধীন করার দিন হল ১৫ আগস্ট, যেটি ১৯৪৭ সালে ঘটে। দেশকে স্বাধীন করার পিছনে কত প্রাণ বলিদান হয়েছে, সেটাই এক দীর্ঘ ইতিহাস! ভারতের স্বাধীনতার জন্য ভারতমাতার বীর সন্তানদের মহান লড়াইয়ের গৌরবোজ্জ্বল ঐতিহ্য এবং বিপ্লবীদের বিশাল অবদান ভারতের স্বাধীনতার ইতিহাসে অম্লান হয়ে থাকবে যুগ যুগ ধরে। পরাধীন ভারতবর্ষে অগুণতি বিপ্লবী থাকলেও বাঙালি বিপ্লবীদের বৈপ্লবিক কর্মকান্ড একটু হলেও বেশি এবং অন্যরকম, একথা অনস্বীকার্য! শুধু পরাধীনতার গ্লানি অনুভব করতেন না বাঙালি বিপ্লবীরা, ভারতমাতাকে ভালোবেসে তাকে মুক্ত করার শপথ নিয়েছিলেন তাঁরা। ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে সেই সব বিপ্লবীদের প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষ বিদ্রোহ ও আন্দোলনগুলি বিশেষ একটি গণ অভ্যুত্থান হিসেবে চিহ্নিত হয়ে আছে যা সেই সময়ে
ইংরেজদের শাসনের ভিতকে নাড়িয়ে দিয়েছিল। ইংরেজ শাসনের সময়ে বাংলার কিছু কিছু নারীরা সমাজে বাল্যবিবাহ কিংবা সতীদাহের ন্যায় বর্বর প্রথাগুলির জন্য নিজেদের সংসারে তথা তৎকালীন সমাজে পরাধীন ছিলেন। কিন্তু এই সব বিশ্রী প্রথাগুলিকে উপেক্ষা করে ভারতের স্বাধীনতায় পুরুষদের মতন নারীরাও কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে উঠে পড়ে লেগেছিলেন ভারতমাতার শৃঙ্খলমোচনের জন্য। প্রচারের অভাবেই হোক কিংবা রাজনৈতিক কারনেই হোক, ভারতের স্বাধীনতায় হারিয়ে যাওয়া বহু বিপ্লবীদের অবদান ও ভূমিকা হয়ত আজ অনেকেরই অজানা, যাঁরা নিজেদের প্রাণ হাসতে হাসতে বলিদান দিয়েছেন শুধুমাত্র ভারতকে বিদেশী শাসনের হাত থেকে মুক্তির জন্য। এমনই তিনজন বিপ্লবীদের সম্পর্কে জানানোর জন্যই আজকের এই কলম ধরা।
সতীশচন্দ্র পাকড়াশী
ভারতীয় উপমহাদেশের ইংরেজ শাসন বিরোধী এক ব্যক্তিত্বের নাম সতীশচন্দ্র পাকড়াশী, যিনি ১৮৯৪ সালে বাংলাদেশের ঢাকার নরসিংদীর মাধবদিতে জন্মগ্রহণ করেন। ওনার বাবা ছিলেন জগদীশচন্দ্র পাকড়াশী। পিতা জগদীশচন্দ্র পাকড়াশীর অনুপ্রেরণায় ছেলে সতীশচন্দ্র পাকড়াশী ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে ঝাপিয়ে পড়েন। ছোটবেলায় বারো বছর বয়সে ত্রৈলোক্যনাথ চক্রবর্তী মহারাজের সান্নিধ্যে এসে অনুশীলন সমিতির সদস্য হয়ে বিপ্লবী কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে যান। ১৯১১ সালে ম্যাট্রিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার পরই অস্ত্র আইনে গ্রেফতার হন তিনি। জেল থেকে মুক্তি পেয়ে তিনি পুনরায় বিপ্লবী দলে যোগ দেন। ১৯১৪ সালে কলকাতায় এসে আইবি পুলিশ সুপারিন্টেডেন্টকে হত্যা করার জন্য বোমা নিক্ষেপ করেন। কিন্তু তাঁর একটু ভুলের জন্য ঐ বোমায় তিনি নিজেই আহত হন। আহত অবস্থায় সেখান থেকে পালিয়ে আশ্রয় নেন রাজশাহী সায়েন্স কলেজের হোস্টেলে। হোস্টেলের ছেলেরা ওনাকে চিকিৎসার ব্যবস্থা করে এবং তিনি সেই সময়ে বেশ কয়েকদিন আত্মগোপন করে থাকেন ব্রিটিশ পুলিশের ওয়ারেন্টের জন্য। পরবর্তীক্ষেত্রে ওঁনার এক সহকর্মী নলিনীকান্ত বাগচী-র সঙ্গে ঢাকা থেকে গৌহাটি-তে গিয়ে তাদের তৈরি গোপন খাঁটি থেকে সারা বাংলাদেশের সশস্ত্র বিপ্লবের কাজকর্ম করতে থাকেন। ১২ই জানুয়ারি, ১৯১৮-তে হঠাৎ পুলিশের আক্রমণ হয় তাদের ও তাদের সহকর্মীদের উপর। ওনারা কয়েকজন পালিয়ে আশ্রয় নেন নবগ্রহ পাহাড়ে। ওঁনাদের সহকর্মীরা সবাই ধরা পড়লেও তিনি নলিনীকান্ত বাগচী-র সঙ্গে চলে আসেন কলকাতায়। এর কয়েকদিন পরে নলিনীকান্ত বাগচী ঢাকায় চলে আসেন। সেখানে তিনি আন্দোলনের সময়ে পুলিশের গুলিতে শহীদ হন বলে জানা যায়। ১৯১৮ সালে কলকাতার একটি গোপন আস্তানা থেকে সতীশচন্দ্র পাকড়াশী-কে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। সতীশচন্দ্র পাকড়াশী প্রেসিডেন্সি জেলে কয়েকদিন ও তারপর রাজশাহী জেলে মিলিয়ে মোট তিন বছর কারারুদ্ধ থাকেন। বিপ্লবী অবনী মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে ১৯২৩ সালে রাশিয়া যাওয়ার সুযোগ আসলে সে সুযোগ ব্যর্থ হয়, কারণ তিনি তখন পুলিশের হাতে আবার ধরা পড়েছিলেন। সেই সময় তিনি মেদিনীপুর, আলিপুর, ঢাকা, বেলগাঁও (কর্ণাটক) এবং যারবেদা (মহারাষ্ট্র) জেলে মোট প্রায় পাঁচ বছর ইংরেজদের জেল খাটেন। ১৯২৯ সালে মেছুয়াবাজার বোমা মামলায় তিনি আবার গ্রেপ্তার হন এবং ছয় বছরের জন্য আন্দামানের সেলুলার জেলে বন্দি হন। বিপ্লবী কাণ্ডকারখানার জন্য সতীশচন্দ্র পাকড়াশী মোট ইংরেজদের কাছে জেল খেটেছেন ৩২ বছর আর তিনি আত্মগোপন করেছিলেন মোট ১১ বছরেরও বেশি সময় ধরে। শেষ জীবনে তিনি ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি (মার্কসবাদী)-তে যুক্ত ছিলেন। ওনার রচিত 'অগ্নিযুগের কথা', 'অনুশীলন পত্রিকা— প্রভৃতি থেকে তৎকালীন ভারতের স্বাধীনতা ও বিপ্লবীদের অবদান সম্পর্কে জানা যায়। ১৯৭৩ সালের ৩০ শে ডিসেম্বর বিপ্লবী সতীশচন্দ্র পাকড়াশী মারা যান।
সতীন সেন
জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের এক বিরল ব্যক্তিত্বের নাম হল সতীন সেন, যিনি তৎকালীন পরাধীন ভারতের অগ্নিযুগের বিপ্লবীদের একজন বলে পরিচিত ছাড়াও ইতিহাসবিদ তপন রায়চৌধুরী দ্বারা বিশেষরূপে প্রশংসিত। ১৮৯৪ সালের ১৫ই এপ্রিল বাংলাদেশের ফরিদপুর জেলার কোটালী পাড়ার বাগান উত্তরপাড়া গ্রামে এক বৈদ্য পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন সতীন সেন। আসল নাম সতীন্দ্রনাথ সেন। ওনার পিতামহের নাম রামসেবক সেন, যিনি তাঁর পরোপকারিতা এবং ব্যক্তিত্ত্বের জন্য সেই অঞ্চলে প্রসিদ্ধ ছিলেন। সতীন সেন-এর পিতার নাম নবীনচন্দ্র সেন, যিনি পটুয়াখালীর একজন সমাজপতি ছিলেন। সতীন সেন-এর জ্যাঠামশাই কৈলাশচন্দ্র সেন ওই অঞ্চলের একজন নামকরা মোক্তার ছিলেন বলে জানা যায়। মাত্র এগারো মাস বয়সে সতীন সেন-এর মা মারা যান। সতীন সেন-এর বাল্যকাল পটুয়াখালীতেই কাটে। ওখানে তিনি ‘পটুয়াখালী জুবিলি হাই স্কুল’ থেকে পড়াশুনা করেন। এই স্কুলের হেডমাস্টারমশাই বরদাকান্ত সেনগুপ্তের প্রভাবে সতীন সেন খুব ভালো ইংরেজি ভাষা লেখা ও সাবলীল উচ্চারণ করতে পারতেন। ছাত্রাবস্থায় সতীন সেন, বরিশাল মিউনিসিপ্যালিটি থেকে কুকুর নিধন অভিযান চালানোর সময় বাধা দেন। সেই সময় সতীন সেনের মত পশুপ্রেমী আর খুব একটা চোখে পড়ত না বলেই শোনা যায়। স্কুলের গণ্ডী পেরোনোর পর ওনাকে ওনার বাড়ির লোক ‘হাজারিবাগ সেন্ট কলম্বাস কলেজ’-এ ভর্তি করান। সেখানে 'বটানি' সাবজেক্ট না থাকায় বটানি নিয়ে পড়ার জন্য কলকাতার বঙ্গবাসী কলেজে ভর্তি হন তিনি। যদিও শঙ্কর মঠের সন্ন্যাসী স্বামী প্রজ্ঞানন্দের কাছে তাঁর (সতীন সেন) বিপ্লবী ভারধারার হাতেখড়ি হলেও সক্রিয় বিপ্লবী হিসেবে তাঁর আত্মপ্রকাশ বঙ্গবাসী কলেজ থেকেই।
জানা যায়, সতীন সেন-এর বয়স যখন দশ বছর, তখন তিনি বরিশালের চারণকবি মুকুন্দ দাসের গানের টানে সোজা মুকুন্দ দাসের কাছে গিয়ে উপস্থিত হন এবং ভারতমাতার সেবায় নিজেকে নিয়োজিত করতে আগ্রহী বলে জানান। যদিও পরে অশ্বিনী দত্ত বুঝিয়ে পটুয়াখালীতে পাঠান সতীন সেন-কে। সতীন সেন তাঁর বিশেষ বাল্যবন্ধু সুধীর দাশগুপ্ত-কে নিয়ে সর্বপ্রথম পটুয়াখালী-তে ছাত্রসঙ্ঘ গঠন করেন এবং ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গ রদ আন্দোলনে যোগদান করেন। বঙ্গবাসী কলেজে পড়ার সময় সতীন সেন কলকাতার সীতারাম ঘোষ স্ট্রিটের ছোট্ট একটি বাড়িতে থাকতেন, যেখানে যুগান্তর বিপ্লবীদের আখড়া ছিল। সেই সময় সতীন সেন সাইকেল-আরোহী ফেরিওলারার ছদ্মবেশে ইউরোপীয় নাবিকদের কাছ থেকে অস্ত্রশস্ত্র জোগাড় করতেন বিপ্লবী কাজের জন্য। বিপ্লবী নরেন্দ্রনাথ ঘোষচৌধুরীর নেতৃত্বে ১৯১৫ সালে হাওড়ার শিবপুরে স্বদেশি ডাকাতি করতে যান সতীন সেন। ডাকাতির খবর পেয়ে পুলিশ ওঁনাদের সবাইকে তাড়া করে। গঙ্গায় একটি ডিঙিতে ঐ বিপ্লবীরা সবাই পলায়ন করলেও পুলিশ কয়েকজনকে ধরে ফেলে। সেই সময় সতীন সেনের এক হাতে ছিল পিস্তল আর অন্য হাতে ডিঙির হাল ধরেছিলেন। যদিও প্রমাণের অভাবে সুধীর দাশগুপ্ত ও সতীন সেন জেল থেকে ছাড়া পেয়ে যান, কিন্তু বিপ্লবী নরেন্দ্রনাথ ঘোষচৌধুরীর যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয়। বরিশাল জেলার প্রায় প্রতিটি প্রান্তে বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের সময়ে স্বদেশী আন্দোলনের ঘাঁটি ও বিপ্লবীদের কার্যকলাপ অব্যহত ছিল। ১৯২১ সালে সতীন সেন-এর নেতৃত্বে পটুয়াখালী মহকুমায় আসহযোগ আন্দোলন ও সত্যাগ্রহ আন্দোলন সংঘটিত হয়। এই আন্দোলন করার জন্য ব্রিটিশ সরকার ওনাকে গ্রেপ্তার করে। ১৯৩৯ সালে বরিশালের মুসলিম অধ্যুসিত ভোলা অঞ্চলে প্রবল বন্যা দেখা যায়, যেখানে সতীন সেন নিজের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে খাবার, পানীয় জল, ত্রাণ প্রভৃতি প্রদান করেছিলেন।
সতীন সেন একবার বরিশাল জেলে বন্দি থাকার সময়ে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে একটি প্রথার বিরোধিতা করেছিলেন। সেই সময়ে ‘সরকার সেলাম’ নামক একটি বিশ্রী প্রথা চালু ছিল ব্রিটিশদের জেলখানায়। জেলে বিপ্লবীদের হাড়ভাঙা খাটুনি, যাতা ঘোরানো, মাটি কোপানো প্রভৃতি করে একহাতে খাবারের থালা ও অন্য হাতে ব্রিটিশদের কাছে সেলাম জানানোর মতন কাজ করানো হত। সতীন সেন সর্বপ্রথম এই প্রথার বিরোধিতা করেন। যারা রাজবন্দি তারা কখনোই প্রতিবাদ করতে পারবে না, জেলের যা নিয়ম সেটাই পালন করতে হবে, অর্থাৎ তারা ‘সিভিল ডেড’। এই প্রথারও সতীন সেন বিরোধিতা করেন। সতীন সেন বলেছিলেন, ‘সিভিল ডেড’ অর্থ যদি মানবিক মর্যাদা বিসর্জন দেওয়া হয় তাহলে গান্ধীজি নিজে মুখে এসে বললেও আমি তা মানব না। আমরা শান্তভাবে প্রতিকার চাইব। না শুনলে সংগ্রাম করে আদায় করব। ইংরেজ সরকার আমাদের স্বাধীনতা আন্দোলনকে স্তব্ধ করার জন্য আমাদের জেলে পুরেছে। আমরা আন্দোলনকে স্তব্ধ হতে দেব না। জেলের বাইরে যেমন চলছে, জেলের ভিতর তেমন চলবে। ওদেরকে আমরা নিশ্চিন্ত হয়ে শাসন চালাতে দেব না। সতীন সেন-এর কথামত বিপ্লবীরা 'সরকার সেলাম' প্রথার বিরোধিতা করা শুরু করলে পুলিশ কয়েকজন বিপ্লবীকে বেত্রাঘাত ও নির্মম অত্যাচার করে। এতে সতীন সেন জেলে বসে একনাগাড়ে ৬১ দিন ধরে অনশন করেন, যা একটি ঐতিহাসিক ঘটনা বলে ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়। তারপর ইংরেজ সরকার বাধ্য হয়ে সেই বিশ্রী প্রথা তুলে দিয়ে বিপ্লবীদের মর্যাদা প্রদান করে। সতীন সেনকে পরবর্তীতে আলিপুর সেন্ট্রাল জেলে ও বহরমপুর জেলে আনা হয়। ওই একই সময়ে নজরুল ইসলাম হুগলি জেলে বন্দি থাকা অবস্থায় অনশন শুরু করেছিলেন। এই খবর পাওয়া মাত্রই সতীন সেন কারা কর্তৃপক্ষের কাছে অনুরোধ করেন তাঁকেও যেন হুগলিতে নজরুল ইসলামের সঙ্গে একই জেলে বন্দি রাখা হয়। ব্রিটিশ সরকার সেই অনুরোধ রাখে এবং হুগলিতে নজরুল ইসলামের সঙ্গে সতীন সেনও একসঙ্গে অনশন করেছিলেন।
১৯২৬ সালের ৩০ আগষ্ট হিন্দুদের এক শোভাযাত্রা নিয়ে বের হন সতীন সেন। ওই বছর কোরবানীতে প্রকাশ্যে গরু জবাই হওয়ায় সতীন সেন সেইখানকার মসজিদের সামনে বাজনা বাজিয়ে পূজা করবেন বলে সিদ্ধান্ত নেন। সময়মত সেই শোভাযাত্রা বের হয়। পুলিশ সেই শোভাযাত্রা আটকে দেয় এবং হিন্দুদের শান্তিভঙ্গের অভিযোগে গ্রেপ্তার করে। গ্রেপ্তার হন সতীন সেন। কয়েকদিন পরে সতীন সেন জেল থেকে ছাড়া পান। এরপর আবার ১৯২৭ সালে মার্চ মাসে লাখুটিয়ায় দোল পূর্ণিমা উপলক্ষ্যকে ঘিরে হিন্দু মুসলমানের দাঙ্গা লাগার উপক্রম হয়েছিল। সতীন সেন সেখানে পৌছাতে চাইলে মি. রান্ডি ও এস.পি তাঁকে গ্রেপ্তার করে। জেল থেকে ছাড়া পেয়ে সেই বছর কুলকাঠি মসজিদের সামনে বাজনা বাজিয়ে শিব মন্দিরে গমনরত হিন্দু তীর্থযাত্রীদের বাজনা বাজানোয় বাধা দেওয়ার কারণে পুলিশ উনিশ জন মুসলমানকে গুলি করে হত্যা করেছিল, সতীন সেন তাঁর তরুণ দলের বেশ কিছু সদস্য নিয়ে সেই তীর্থযাত্রীদের একদম সামনে ছিলেন। এরপর তিনি ভারত ছাড়ো আন্দোলন ও লবন আন্দোলন করার জন্য ব্রিটিশদের হাতে গ্রেপ্তার হন। জেলে বন্দি থাকা অবস্থায় তাঁর শরীরের অবনতি ঘটতে থাকে এবং তিনি যক্ষা রোগে আক্রান্ত হন। ১৯৫৫ সালের ১৮ মার্চ তিনি ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে মারা যান। সতীন সেনের রাজনৈতিক জীবনের বেশ কিছু ঝুঁকি তৎকালিন পরাধীন ভারতে এক গভীর অধ্যায় বলেই ব্যক্ত হয়েছে বিপ্লবীমহলে।
কমলা দাশগুপ্ত
ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে পুরুষ বিপ্লবীদের মতন বহু নারী বিপ্লবীরা নিজেদের জীবন বিপন্ন করে ইংরেজদের বিরুদ্ধে লড়েছিলেন কেবলমাত্র ভারতমাতা-কে রক্ষা করতে যা ইতিহাসের পাতায় সেইভাবে লেখা নেই। এমনই এক বীর নারী চরিত্রের অধিকারী হলেন কমলা দাশগুপ্ত, যিনি অগ্নিযুগের এক বিশেষ সংগ্রামী নারী চরিত্র এবং বিশিষ্ট সাহিত্যিক। ১৯০৭ সালের ১১ মার্চ কমলা দাশগুপ্ত বাংলাদেশের ঢাকার বিক্রমপুরে এক মধ্যবিত্ত বৈদ্য পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। পড়াশুনোয় অত্যন্ত মেধাবী এই কমলাদেবী ১৯২৪ সালে ঢাকার ব্রাহ্ম্যবালিকা শিক্ষালয় থেকে প্রবেশিকা পরীক্ষায় পাশ করেন। ওনার পরিবার সেই বছর কমলাদেবী-কে নিয়ে কলকাতায় চলে আসে। এরপর কমলাদেবী বেথুন কলেজে বিএ নিয়ে ভর্তি হন এবং পাশ করেন ১৯২৮ সালে। তারপর তিনি কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইতিহাসে এমএ পাশ করেন। কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে এম.এ পড়ার সময় উনি বিপ্লবী কর্মকান্ডের প্রতি প্রবল আকর্ষণ অনুভব করেন বলে জানা যায়। ওই সময়ে ‘যুগান্তর’ দলে যুক্ত কয়েকজন বন্ধুস্থানীয় ব্যক্তির সঙ্গে ওনার সম্পর্ক তৈরি হয়েছিল, যা কমলাদেবী-কে গান্ধীজির অহিংসবাদ ছেড়ে সশস্ত্র বিপ্লবের দিকে নিয়ে গেছিল। আর এই ক্ষেত্রে এক বিশেষ ভূমিকা নিয়েছিলেন যুগান্তর দলের নেতা বিপ্লবী রসিকলাল দাস।
তারপর আস্তে আস্তে কমলা দাশগুপ্ত বৈপ্লবিক কর্মকান্ডে জড়িয়ে পড়তে থাকেন। তিনি বিপ্লবী দীনেশ মজুমদারের কাছে প্রথম লাঠিখেলা ও পিস্তল চালানো শেখেন। ১৯২২ সালের ফেব্রুয়ারী মাসে বন্ধু বিপ্লবী কল্যাণী দাস ও বিপ্লবী বীণা দাসকে পিস্তল সরবরাহ করে গভর্নর স্ট্যানলি জ্যাকসন-কে হত্যার চেষ্টা করেন তিনি। এছাড়াও কমলা দাশগুপ্ত কয়েকটি বোমা হামলার সাথে যুক্ত থাকার কারণে ইংরেজ পুলিশের কাছে গ্রেপ্তার হন তবে সঠিক প্রমাণের অভাবে মুক্তি পান। জানা যায়, ১৯৩০ সালে তিনি নিজের বাড়ি ছেড়ে দরিদ্র নারীদের সেবা করার জন্য একটি হোস্টেলের ম্যানেজারের চাকরি করেন এবং এর পাশাপাশি বৈপ্লবিক কাজকর্ম চালাতে থাকেন গোপনে। এছাড়াও, নোয়াখালিতে যখন দাঙ্গা লেগেছিল, সেইসময় সেখানে তিনি ত্রাণের কাজ করেছিলেন। পরবর্তীতে বিপ্লবীদের জন্য অস্ত্র-শস্ত্র, বোমা ও বোমা তৈরির সরঞ্জাম রাখার জন্য ১৯৩২–৩৮ সাল পর্যন্ত তিনি প্রেসিডেন্সি জেলে এবং পরে হিজলি বন্দি নিবাসে (খড়গপুর) আটক থাকেন। হিজলি বন্দি নিবাসে বন্দিরত অবস্থায় তিনি ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত হয়েছিলেন। সুস্থ হয়ে সেখান থেকে ছাড়া পেয়ে তিনি যোগ দেন ভারত ছাড়ো আন্দোলনে। ভারত ছাড়ো আন্দোলন করার অপরাধে তিনি পুনরায় ১৯৪২ সালে জেলে বন্দি হন ও মুক্তি পান ১৯৪৫ সালে। উনি ওঁনার জীবনে বেশ কিছুদিন শিক্ষকতা করেছেন। ভারত স্বাধীন হওয়ার পরে (দেশভাগের পরে) কমলা দাশগুপ্তের লেখা আত্মজীবনী (তাঁর) ‘রক্তের অক্ষরে’ ১৯৫৪ সালে প্রকাশিত হয়। কমলা দাশগুপ্তের আরেকটি লেখা গ্রন্থ ‘স্বাধীনতা সংগ্রামে বাংলার নারী’ যেটি ১৯৬৩ সালে প্রকাশিত হয়। এই দুটি গ্রন্থ থেকে তৎকালীন বিপ্লবীদের বৈপ্লবিক কার্যকলাপ ও ওঁনার নিজের ব্যক্তিগত জীবনের নানা তথ্য জানা গেছে। ২০০০ সালের ১৯ জুলাই বীরাঙ্গনা এই কমলা দাশগুপ্ত বার্ধক্যাজনিত কারনে মারা যান।
ছবি সৌজন্যে আন্তর্জাল
Leave a Reply
Your email address will not be published. Required fields are marked *
Comments