দুর্ভাগ্যের শিকার নাগাসাকি
ডঃ সঞ্জীব রায়
১৯৪৫ সালের গোড়ার কথা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ প্রায় শেষ হয়ে আসছে। জার্মানি, জাপান, ইতালি প্রচণ্ড কোণঠাসা। ইতালি অবশ্য কোনোদিনই যুদ্ধে তেমনভাবে ছিল না। তারা বরাবরই যুদ্ধ অপেক্ষা কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনের ব্যাপারে অধিক আগ্রহী ছিল। নিঃসন্দেহে সব থেকে বেশি চাপে আছে জাপান। ক্রমাগত হুমকি আসছে নিঃশর্ত আত্মসমর্পনের। এই ‘নিঃশর্ত’ ব্যাপারটা কী? এর অর্থ হল জাপানের কোরিয়া ও ফরমোসার উপর নিয়ন্ত্রণ ছাড়তে হবে এবং জাপানি যুদ্ধবন্দিদের দেশে ফেরত নেওয়া যাবে না। তবে কথায় বলে জাপানি গোঁ। তারা ভাঙবে তবুও মচকাবে না। তারা সময় বিশেষে একটু নমনীয় হলে ইতিহাস হয়তো অন্যভাবে রচিত হত। সেই প্রসঙ্গে পরে আসছি।
যুদ্ধ শেষের সংকেত স্পষ্ট হওয়ায় মিত্র শক্তির একটি দেশ প্রচণ্ড চিন্তায় পড়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অবশ্যই চিন্তার যথেষ্ট কারণ আছে। কানাডার সঙ্গে যৌথভাবে তারা যে একাধিক পরমাণু বোমা প্রস্তুত করেছে তার জন্য তৎকালিন সময়ে ব্যয় হয়েছে নয় নয় করে প্রায় ৫ বিলিয়ান ডলার। যুদ্ধ শেষ হয়ে গেলে তো সব টাকাটাই জলে! এমনিতেই মার্কিন রাষ্ট্রপতি ট্রুম্যান প্রচণ্ড অশান্তিতে আছেন। তাঁর গদি টলমল করছে। কৈফিয়ৎ দিতে দিতে তিনি ব্যতিব্যস্ত। অন্যদিকে অস্বীকার করার উপায় নেই যে মিত্র দেশগুলির মধ্যে জাপানি বোমায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রিটেন। জাপানি বোমায় ধ্বংস হয়ে যাওয়া পার্ল হারবারের দুঃখ, অপমানের ঘা ১৯৪১ সাল থেকেই তাদের অন্তরে টাটকা। অনেকেই প্রশ্ন করবেন তবে কি সেই অপমানের যোগ্য জবাব দেওয়ার জন্যেই বিপুল অর্থ ব্যয়ে পরমাণু বোমা প্রস্তুত হয়েছিল? ব্যাপারটিকে অত সরলীকরণ করা বোধ হয় ঠিক নয়। কথাটি আংশিক সত্য হলেও পুরোটা নয়। এই পরমাণু তৈরির প্ররোচনায় কিছুটা হলেও ইহুদি সম্প্রদায়ের হাত আছে। এমন কী স্বয়ং আইনস্টাইনকেও এই ব্যাপারে ক্লিন চিট দেওয়া যাচ্ছে না। অন্তত তথ্য তাই বলে। আসা যাক সেই রহস্যে।
১৯৩৬ সালের আগে থেকেই ইহুদি বুদ্ধিজীবি সমাজ নানাভাবে হিটলারকে অশিক্ষিত, বর্বর বলে অপদার্থ প্রমাণ করার প্রচেষ্টা চালিয়ে আসছিল। সবরকম প্রচেষ্টা থাকা সত্ত্বেও হিটলারের অশ্বমেধের ঘোড়া আটকানো সম্ভব হয়নি। হিটলার ক্ষমতায় এসে হিসাব সুদে–আসলে মিটিয়ে দেওয়া শুরু করেন। হিটলার বা নাৎসি বাহিনীর দ্বারা অত্যাচারিত ইহুদিদের প্রসঙ্গে আর নতুন করে তো কিছু বলার নেই। নিঃসন্দেহে তা শতাব্দীর কলঙ্ক। এই অত্যাচারিতদের মধ্যে অনেক বিজ্ঞানী ছিলেন। সেই বিজ্ঞানীদের মধ্যে কিছু দেশ ছেড়ে পালাতে সক্ষম হলেও অনেকেই নাৎসি বাহিনীর দ্বারা বন্দি হয়ে গবেষণা চালাতে বাধ্য হয়েছিলেন। স্বভাবতই তাঁরা প্রতিশোধ নেবার সুযোগের অপেক্ষায় ছিলেন। সুযোগ এসেও গেল এক মোক্ষম সময়ে।
১৯৩৮ সালের শেষের দিকে জার্মান পরমাণু বিজ্ঞানী অটো হ্যান এবং ফ্রিনজ টারম্যান যৌথভাবে জার্মানির পক্ষ থেকে সরকারীভাবে পরমাণু–সংক্রান্ত কিছু তথ্য প্রকাশ করেন। সেই তথ্যতে কিন্তু জার্মানির পরমাণু বোমা প্রস্তুতির কোনো সংকেত ছিল না। তদুপরি এই তথ্য প্রকাশ কার নির্দেশে করা হয়েছিল, কেনই বা করা হয়েছিল তা জানা সম্ভব হয়নি। এই তথ্য প্রকাশের ফল হয় অতীব মারাত্মক। যে সমস্ত বিজ্ঞানীরা নাৎসি বাহিনীর দ্বারা কোনো না কোনো সময়ে অপমানিত বা অত্যাচারিত হয়েছিলেন তাঁরাই রটিয়ে দেন যে জার্মানি শীঘ্রই পরমাণু বোমার আঘাত হানতে চলেছে। বলা বাহুল্য এই প্রচার ছিল সর্বৈব মিথ্যা। সত্যি কথা বলতে কী জার্মানির সেই সময় পরমাণু বোমা প্রস্তুতের মতন আর্থিক জোরও ছিল না। জার্মানি থেকে বিতাড়িত বুদ্ধিজীবি ও বিজ্ঞানীরা মিথ্যা আশঙ্কার কথা প্রকাশ করে লিফলেটের আকারে (সকলের স্বাক্ষরসহ) বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে বিলি করেন। লিফলেটে স্বাক্ষরকারিদের মধ্যে ছিলেন সর্বজনপূজিত স্বয়ং আইনস্টাইন। অনেকেই মনে করেন যে এটি ছিল ইহুদিদের প্রতি অত্যাচারের এক পাল্টা আঘাত। তবে ঘটনার ফলশ্রুতিতে সমগ্র বিশ্ব প্রচণ্ডভাবে নড়েচড়ে বসে বিশেষ করে মিত্র পক্ষের দেশগুলিতে প্রচণ্ড তৎপরতা শুরু হয়। তারই ফলস্বরূপ আমেরিকা ও কানাডার যৌথ উদ্যোগে প্রস্তুত হয় ইউরেনিয়াম ও প্লুটোনিয়াম সমৃদ্ধ শক্তিশালী পারমানবিক বোমা লিটলবয় ও ফ্যাটম্যান এবং প্রচণ্ড শক্তিশালী এক হাইড্রোজেন বোমা (যার নামকরণ করা হয়নি)।
এই প্রসঙ্গে আরও একটা গুরুত্বপূর্ণ কথা অনেকেরই মনে আসে। ১৯৪৫ সালের গোড়াতেই ঠিক হয় যে পরমাণু বোমাগুলি সদগতি হবে জাপানের মাটিতে। প্রশ্নটা এখানেই জাপানে কেন? কেন বাদ মূল প্রতিপক্ষ জার্মানি? মিত্রপক্ষের সভায় জার্মানিকে পরমাণু বোমার আওতা থেকে বাদ দেওয়া হয় এই যুক্তি দেখিয়ে যে জার্মানিতে পরমাণু বিস্ফোরণ ঘটালে তার রেশ নিঃসন্দেহে ইউরোপের বৃহৎ অংশে ও সোভিয়েত ইউনিয়নের উপর আসবে। সেই আশঙ্কা থেকেই জার্মানি ছাড় পায়। সভাতে জাপানে বিস্ফোরণের দায়িত্ব দেওয়া হয় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে।
উক্ত সভার রেশ টেনে ১৯৪৫ সালের এপ্রিল মাসে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র একটি কমিটি গঠন করে। কমিটির কাজ ছিল জাপানে কোথায় কোথায় বিস্ফোরণ হবে তা নির্বাচন করা। কমিটির চেয়ারম্যান ছিলেন প্রচণ্ড প্রভাবশালী বরফ শীতল মাথার গ্রোবস। কমিটি প্রথম সভাতেই সর্বসম্মতিক্রমে হিরোশিমাকে নির্বাচন করে। স্বভাবতই জানতে ইচ্ছে করে কেন হিরোশিমা সর্বসম্মতিক্রমে পারমাণবিক বিস্ফোরণের জন্য প্রথম পছন্দ হল? সেই ব্যাপারে একটু সংক্ষিপ্ত আলোকপাত করা যাক। হিরোশিমা জাপানের বৃহত্তম দ্বীপ হনসু দ্বীপের পশ্চিম অংশে অর্থনৈতিক দিক থেকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। হিরোশিমা জাপান সরকারের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সেনা ব্যারাকও বটে। জাপানী জলবাহিনীর সদর দপ্তর উজিনা বন্দর হিরোশিমা থেকে সামান্যই দূরে। উজিনা বন্দরের গুরুত্বপূর্ণ কাজকর্মের বৃহৎ অংশ হিরোশিমা থেকে পরিচালিত হতো। মিত্রশক্তি যুক্তিসঙ্গত ভাবেই হিরোশিমাকে বেছে নেয় কারণ তারা জানত যে হিরোশিমাকে অকেজো করলে জাপানের মেরুদন্ডের উপর আঘাত আসবে। তারা বুঝেসুঝে আরও একটা কাণ্ড করে। সেটা কী? ১৯৪৪ সালের শেষের দিক থেকে শুরু ১৯৪৫ সালের জুলাই মাস পর্যন্ত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিমান থেকে জাপানে ৬৩ মিলিয়ানেরও বেশি লিফলেট ফেলা হয়েছিল। এই লিফলেটে জাপানে পরমাণু আক্রমণ হবে এবং যে শহরগুলিতে হবে তার তালিকা দেওয়া ছিল। সেই তালিকায় কোথাও হিরোশিমার উল্লেখ ছিল না। বলছিলাম না যে জাপানি গোঁ, আসলে জাপানের উচিত ছিল জার্মানির আত্মসমর্পণের পরেই যুদ্ধ থেকে সরে যাওয়া, কিন্তু সেটা তারা করল না। সেটা করলে পরমাণু বিস্ফোরণের ইতিহাস হয়তো রচিত হত না।
সূচী অনুযায়ী প্রথমে অপারেশন হিরোশিমা। ১৯৪৫ সালের ৬ আগস্ট সোমবার ৮ টা ১৫ মিনিটে ইউরেনিয়াম কেমিক্যাল সম্বলিত পারমাণবিক বোমা ‘লিটলবয়’–কে বিস্ফোরণ ঘটানো হয়। বিমানের নাম ছিল এনোলা গে, পাইলট ছিলেন কর্ণেল পল টিবেট। তাঁর মায়ের নাম অনুসারে বিমানের নাম ছিল এনোলা গে। মূল বিমানটি ছাড়াও সঙ্গে আর দুটি বিমান ছিল সাহায্যকারী হিসেবে। একটির নাম গ্রেট আর্টিস্ট আর একটির নাম নেসেসারি ইভিল। যার বাংলা দাঁড়ায় ‘অপরিহার্য অমঙ্গল’। অমঙ্গল তো বোঝা গেল, কিন্তু অপরিহার্য কার জন্য বলা মুশকিল। একটির কাজ ছিল বিস্ফোরণ ঘটানো আর একটির কাজ ঘটনার ছবি তোলা।
হিরোশিমা বিস্ফোরণের ক্ষয়ক্ষতির বিষয়ে বিস্তারিত বলার প্রয়োজন নেই। নিঃসন্দেহে সেটি বহু চর্চিত বিষয়, কিন্তু যা বলার দাবি রাখে যে হিরোশিমার বিস্ফোরণের পর জাপান কিন্তু আত্মসমর্পণ করেনি। এই আঘাতের পর তৎকালীন জাপানের প্রধানমন্ত্রী সুজেকি গুরুত্বপূর্ণ সাংবাদিক সম্মেলনে বলেন যে, জাপানের যুদ্ধে বিরত হবার মতন কোনো গুরুত্বপূর্ণ কাণ্ড এখনও ঘটেনি। যুদ্ধ যেমন চলছে তেমনই চলবে। জাপানীরা দেশের জন্য মৃত্যুবরণ করবে তথাপি রণক্ষেত্র থেকে পালিয়ে যাবে না। দুঃখের বিষয় জাপান যদি একটু নমনীয় হত তাহলে মাত্র কয়েকদিন পরে তাদের দ্বিতীয় পরমাণু বিস্ফোরণ হজম করতে হত না।
হিরোশিমা বিস্ফোরণের আগেই প্লুটোনিয়াম সমৃদ্ধ ‘ফ্যাটম্যান’ কোন শহরের জন্য বরাদ্ধ হবে সেই নিয়ে টালবাহানা চলতে থাকে। প্রথমদিকে আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র এই বিস্ফোরণের জন্য তিনটে শহরকে বেছে নিয়েছিল। সেগুলি হল কোকুরা, কিওটো এবং নীলঘাটা। তালিকায় নাম থাকা সত্ত্বেও বাদ যায় সবগুলিই। নিতান্তই দুর্ভাগ্য নাম এসে যায় নাগাসাকির, সে তথ্য নিঃসন্দেহে উল্লেখের দাবি রাখে। তালিকায় থাকা নামের থেকে সর্বপ্রথম বাদ যায় কিওটো। বাদ দেবার কারণ হিসেবে যদিও সরকারিভাবে কিছু কারণ উপস্থাপিত হয়েছিল যেমন সাংস্কৃতিক পীঠস্থান, প্রচুর খ্রিস্টিয় সংগঠন আছে, সেনা ব্যারাক নেই ইতাদি। তবে সেগুলো বাদ যাবার প্রকৃত কারণ নয়, মূল কারণ বাস্তবিকই ছিল চমৎপ্রদ। সেটা একটু বলি।
হেনরি স্টিমসন ছিলেন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন আমেরিকার সেনা বাহিনীর মুখ্যসচিব। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অনেক বছর আগে হেনরি তখন যুবক। সদ্য বিয়ে করে স্ত্রীকে নিয়ে কিওটোতে গেলেন মধুচন্দ্রিমায়। সৌন্দর্যের রানী কিওটো তখন চেরী ফুল দিয়ে সাজগোজ করছে। হেনরির স্ত্রী এলিনা ছিলেন প্রকৃত অর্থেই সুন্দরী। স্বভাবতই হেনরির শুধুমাত্র এলিনার প্রতি আকৃষ্ট হওয়াই বাঞ্ছনীয় ছিল, কিন্তু অদ্ভূতভাবে হেনরির কিওটোর প্রতি এক অনুরাগ জন্মায়। কিওটোর প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, মানুষের আচার–ব্যবহার আতিথেয়তা তাঁকে আপ্লুত করে। সেই ভালো লাগার রেশ হেনরির অন্তরে গেঁথে যায় সারাজীবনের জন্য। কিওটোর প্রতি হেনরির প্রেম ছিল অকৃত্রিম। ১৯৪৪ সালের প্রায় শেষ দিকে তিনি জানতে পারেন যে কিওটোর আকাশে ঘন মেঘ জমা হচ্ছে। তিনি চাননি তার ভালবাসার কিওটোর কোনো ক্ষতি হোক। যৌবনের স্বর্গ কিওটোকে বিস্ফোরণে ধূলিসাৎ হওয়া থেকে বাঁচাতে তিনি সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত উদ্যোগে রাষ্ট্রপতি ট্রুম্যানের কাছে অনুরোধ করেন কিওটোকে হটলিস্ট থেকে বাদ দেবার। প্রোটোকল অনুযায়ী প্রস্তাব যায় বিস্ফোরণ স্থান নির্বাচন কমিটির চেয়ারম্যান গ্রোবসের কাছে। তিনি তো কিছুতেই রাজি নন। তাঁর সঙ্গে হেনরির প্রচণ্ড মতবিরোধ, তর্ক–বিতর্ক হয়। শোনা যায় হেনরি তার ইচ্ছা রক্ষা হচ্ছে না দেখে প্রস্তাব দেন যে তিনি স্বয়ং কিওটো পৌঁছে ফ্যাটম্যানকে আমন্ত্রণ জানাবেন। এই কথা শোনার পর গ্রোবস প্রচণ্ড অনীহা সত্ত্বেও কিওটোকে বাদ দেন। অন্যদিকে নীলঘাটা বেঁচে যায় দূরত্ব বড্ড বেশি হওয়ায়। পড়ে থাকে প্রথম পছন্দের কোকুবা এবং সর্বশেষ পছন্দের স্ট্যান্ডবাই থাকা নাগাসাকি।
জাপানের কিউসু দ্বীপের উত্তর–পশ্চিম কোণে নাগাসাকি এক অন্যতম বৃহৎ প্রাকৃতিক নদী বন্দর। জাপানের বহু কৃতিত্বের দাবিদার এই নাগাসাকি। ১৮৫৫ সালে ওলন্দাজদের দেওয়া জাপানের প্রথম বাষ্পচালিত জাহাজ কান ক্লোউমারু সর্বপ্রথম নাগাসাকিতেই আসে। সেটি এখনও নাগাসাকিতেই রাখা আছে। সেটা চড়ে পর্যটকরা এখনও প্রমোদভ্রমণের সুযোগ পান। নাগাসাকিতেই প্রথম মানুষ বেলুন চড়ে আকাশে ওড়ে। এছাড়াও জাপানের প্রথম ইংরেজি সংবাদপত্র, প্রথম পেশাদার ক্যামেরাম্যান, প্রথম খ্রিস্টানদের জন্য ধর্মগ্রন্থের মুদ্রণ, প্রথম আন্তর্জাতিক টেলিফোন কল সবই নাগাসাকি থেকে। পারমাণবিক বিস্ফোরণে জর্জরিত হবার সঙ্গে সঙ্গে নাগাসাকিকে অনেকবার প্রাকৃতিক দুর্যোগের শিকার হতে হয়েছে। ১৯৫৭ সাল এবং ১৯৮২ সালে প্রবল বন্যায় নাগাসাকির বহু মানুষের মৃত্যু ঘটে। ১৯২২ ও ১৯৯০ সালে মাউন্ট আনজেন থেকে জলন্ত লাভার উদগীরণে বহু মানুষের জীবনহানি হয়। এ ছাড়া ভূমিকম্প তো নাগাসাকির নিত্যসঙ্গী। তবে কোনো কিছুই নাগাসাকিকে দমিয়ে রাখতে পারেনি।
১৯৪৫ সালের ৯ আগস্ট ভোরের দিকেই নির্দিষ্ট জায়গা থেকে বোমারু বিমান বকস্কার কমান্ডার সুইনির নেতৃত্বে কোকুরার দিকে রওনা হয়। সঙ্গে নেওয়া হয় ২০,০০০ টন বিস্ফোরক বহন করার ক্ষমতা সম্পন্ন প্লুটোনিয়াম বোম ফ্যাটম্যান। বোমাটির ওজন ছিল ১০,০০০ পাউন্ড। এটি লম্বায় ছিল ১০ ফুট ৮ ইঞ্চি। বিমান কোকুরার দিকে অগ্রসর হয়। সেদিন কোকুরার আকাশ ছিল ঘন মেঘে ঢাকা। খারাপ আবহাওয়া কোকুরার আশীর্বাদ হয়ে দাঁড়ায়। আকাশে বকস্কার খানিকক্ষণ চক্কর কাটার পর মেঘে ঢাকা আকাশ থেকে কিছুই দেখতে না পেয়ে ফেরার পথ ধরতে বাধ্য হয়। সমস্যা ছিল অন্য জায়গায়, ‘ফ্যাটম্যান’ নিয়ে ফিরে আসা অসম্ভব, কারণ এই প্লুটোনিয়াম বোম নিয়ে এড়োপ্লেন ল্যান্ডিং একেবারেই সম্ভব নয়। নিশ্চিতভাবে বিমান মাটি ছোঁয়ার সঙ্গে সঙ্গে বিস্ফোরণ হবেই। সুতরাং, ফ্যাটম্যানকে কোথাও না কোথাও নিক্ষেপ করতেই হত। উপর মহলের নির্দেশ অনুসারে কামান্ডার সুইনি নাগাসাকির আকাশেই বিস্ফোরণ ঘটান। বেলা তখন ১১ টা বেজে ২ মিনিট।
১৯৪৫ সালের ৯ আগস্ট দিনটি সম্পর্কেও একটু বলা দরকার। প্রথমে ঠিক ছিল বিস্ফোরণ ঘটানো হবে ১১ তারিখ। আবহাওয়া দপ্তর ওই দিনটি সম্পর্কে বিরূপ পূর্বানুমান পুরো বিষয়টিকেই দুদিন এগোতে বাধ্য করে। নাগাসাকির ঘটনার পরেই জাপান নিঃশর্ত আত্মসমর্পণ করে। ঘটনার ঠিক ৬ দিন পর অর্থাৎ ১৫ আগস্ট জাপানের নিঃশর্ত আত্মসমর্পণের ঘোষণা সমস্ত বেতার তরঙ্গের মারফৎ বিশ্ববাসী জানতে পারে। সেই ‘গোঁ’ ভাঙল কিন্তু বড্ড দেরিতে। তবে ইংরেজিতে একটি কথা খুবই ব্যবহার হয় ‘Better late than never’। এক্ষেত্রেও আর দুদিন দেরি হলে হয়তো দেশটাই থাকত না, কারণ জাপানের আত্মসমর্পণ হেতু পরের বোমটির সদগতি আর হয়ে ওঠেনি। বিশেষ ধরনের প্রস্তুত হাইড্রোজেন বোমটি তৈরি রাখা ছিল ১৭ বা ১৮ আগস্ট জাপানের অন্যকোনো শহরে নিক্ষেপ করার জন্য।
প্রতিবেদনের শেষ লগ্নে আরও কয়েকটি কথা উপস্থাপনের দাবি রাখে। শিল্পশহর নাগাসাকিতে হিরোশিমা অপেক্ষায় অনেক বেশি শক্তির বোমা নিক্ষেপ করা হয়। ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ কিন্তু হিরোশিমা অপেক্ষায় অনেক কম হয়েছিল কারণ প্রাকৃতিক গঠন, পাহাড়, নদনদী নাগাসাকিতে বোমার কার্যকারিতা হ্রাস করেছিল অনেকটাই। তথাপি প্রচুর শ্রমিকদের কর্মরত অবস্থায় মৃত্যু হয়েছিল। সেইজন্য নাগাসাকিতে শান্তি উদ্যানে প্রবেশ করা মাত্র চোখে পড়বে শ্রমিকের বিশাল স্ট্যাচু। একটু দূরেই আরেকটি স্ট্যাচুতে সন্তান কোলে মা। স্ট্যাচুর গায়ে বিস্ফোরণের সময় ও তারিখ খোদাই করা আছে। নাগাসাকি অ্যাটম বোম মিউজিয়াম ও পিস মেমোরিয়াল হলে চমৎকারভাবে ধ্বংসলীলার ছবি সংরক্ষণ করা আছে। বাস্তবিকই দেখলে চোখ অশ্রুজল হয়ে ওঠে। ঘটনার এত বছর পরেও সেই ধ্বংসলীলা দেখলে শুভবুদ্ধি সম্পন্ন মানুষ লজ্জা পায়। ঘৃণা করে দানবমনের সেই রাষ্ট্র প্রধানদের যাঁদের নির্দেশেই এই ধ্বংসলীলা। প্রত্যেক বছর আগস্ট মাসে অনুষ্ঠিত হয় ‘নাগাসাকি শান্তি উৎসব’। পৃথিবীর সমস্ত প্রান্ত থেকে মানুষ এই শোকজ্ঞাপনের উৎসবে যোগ দিতে সমবেত হন।
সবশেষে একটি কথা না জানিয়ে বোধকরি এই প্রতিবেদন শেষ করা যায় না। হিরোশিমা ও নাগাসাকি বিস্ফোরণের পর বারাক ওবামাই প্রথম কর্তব্যরত মার্কিন প্রেসিডেন্ট যিনি ২০১৬ সালের ৭ মে হিরোশিমায় পদার্পণ করেন। এর আগে দীর্ঘ ৭২ বছর কোনো মার্কিন রাষ্ট্রপতি ক্ষমতায় থাকাকালীন হিরোশিমা বা নাগাসাকিতে আসেননি। বাস্তবিকই কিন্তু ‘গোঁ’–তে কেউ কম যায় না।
সব ছবি: লেখক
Leave a Reply
Your email address will not be published. Required fields are marked *
Comments
Khub bhalo laglo. Tothyo mulok lekha. Onek kichhu jante parlam. Somriddho holam.
- Oindrila Banerjee
Mon, Aug 9, 2021 10:58 PM
অসাধারণ উপস্থাপনা। লেখকের পান্ডিত্য মুগ্ধ করে। অনেক অজানা তথ্য পরিবেশনার জন্য লেখককে জানাই আন্তরিক ধন্যবাদ ও অভিনন্দন। আরও এইরকম ইতিহাস সমৃদ্ধ লেখার আবেদন জানাই।
- জয়শ্রী রায়
Tue, Aug 10, 2021 12:56 AM
Anek ajana tathya janlam.. Asadharon sundor sabolil vasay lekha ti pathoker janar poridhi jemon baray temon mugdho kore..Erokom lekha ro anek chai..
- Brototi Mondal
Tue, Aug 10, 2021 3:27 AM
তথ্য সমৃদ্ধ লেখা। পরমাণু বোমা বিস্ফোরণের নেপথ্য কাহিনী লেখকের প্রাঞ্জল ভাষায় মনোগ্রাহী। ইতিহাস থেকে যেনো আমরা শিক্ষা নি যাতে বিজ্ঞানের অভিশাপ আর নেমে না আসে।
- Arpita Bhattacharya
Tue, Aug 10, 2021 7:34 AM