প্রকৃতির সঙ্গে নিবিড়ভাবে কয়েকদিন
কমলা আদক

২০২০-র শুরুতে হঠাৎই আমরা করোনা আতঙ্কে শঙ্কিত। অজানা অচেনা রোগের প্রাদুর্ভাবে গৃহবন্দি, সামাজিক মেলামেশা বন্ধ। বন্ধ স্কুল কলেজ– সহ বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, দোকানপাট, হাটবাজার, অফিস ও আদালত। পরিবহন ব্যবস্থাও স্তব্ধ। সারা বিশ্বজুড়ে মৃত্যুর বিভীষিকা। এই অবস্থায় ভ্রমণ পিপাসু বাঙালির মনের অবস্থা কী হতে পারে সহজেই অনুমেয়। করোনা আতঙ্ক, তা আরও দীর্ঘস্থায়ী হল, প্রায় বছর ঘুরে গেল। করোনা প্রকোপ একটু কমতেই প্রকৃতি হাতছানি দিয়ে টানতে শুরু করল। কিন্তু যাওয়া যায় কোথায়? বাড়িতে তো বয়স্ক ও শিশুরা আছে। এদের নিয়ে যেতে হলে অতিরিক্ত সতর্কতার প্রয়োজন।

নেট সার্চ করে খুঁজেপেতে দেখা গেল গোয়ার ভার্সা সি বিচে যাওয়া যেতে পারে। এটি শান্ত, পরিচ্ছন্ন বিচ, সোনালী বালুকাবেলা, আইভরি সমুদ্রতরঙ্গ। এই নির্জন সি বিচে জনসমাগম যথেষ্টই কম, হকারদের উপদ্রব মোটেই নেই। গোয়ায় অনেকগুলি সি বিচ আছে— এই বিচ থেকেই দেখা যায় অপূর্ব মনোরম সূর্যাস্ত। সমুদ্রের স্নান করার কোনো ভয় নেই বরং বিশাল সমুদ্রতটে আছে নানা বিনোদন ব্যবস্থা। ক্যারাভেলা বিচ রিসর্টটি এর লাগোয়া বিশাল রিসর্ট, থাকা খাওয়ার বন্দোবস্তও বেশ ভালো। তাই ২০২১-এর জানুয়ারি মাসের মাঝামাঝি এই রিসর্টটি বুক করা হল। কিন্তু কীভাবে যাওয়া হবে?

ব্যাঙ্গালোর থেকে দূরত্ব অনেকটাই। উবের ট্যাক্সি ও উড়ানের সাহায্য নিলে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা সম্ভব নয়। যতই মাস্ক, পিপিই কোট ও স্যানিটাইজার ব্যবহার করা হোক না কেন। তাই আমাদের গাড়ি নিয়েই গোয়া রওনা দেব ঠিক হল। ড্রাইভারও রাজি হয়ে গেল। ১০-১২ ঘণ্টার পথ। উন্মুক্ত আকাশের নীচে ক’দিন কটাতে পারব ভেবে আমাদের মন অনাবিল আনন্দে ভরে উঠল। রাত ৩ টে থেকে জার্নি শুরু করলে রিসর্টে লাঞ্চ টাইমে পৌঁছানো যাবে, তারপর সমুদ্রজলে পদস্পর্শ করে দিনের আলোয় সমুদ্র সৈকতকে উপভোগ করা যাবে— সমুদ্রবক্ষে অপরূপ সূর্যাস্ত দেখার সুযোগ হবে। এই ভাবনাকে বাস্তবে রূপ দিতে আমরা ১৭ জানুয়ারী রাত ৩ টে রওনা দেওয়া স্থির করলাম। রাত ১১ টার সময় ৪ দিনের ব্যবহার্য জিনিস পত্র গুছিয়ে নিয়ে আগাম গাড়িতে ভরে রেখে এলাম। রাত ২:‌৩০ নাগাদ চা তৈরি করে খেলাম। ওদিকে পুত্রবধূ আমাদের সবার জন্য ব্রেকফাষ্ট বানিয়ে আলাদা আলাদা প্যাক করছে অর্থাৎ বাড়ির খাবার গাড়িতে বসে সহজেই খাওয়া যাবে। ঠিক সময়ে যাত্রা শুরু হল।

ঘুমাতে ঘুমাতেই চললাম। গাড়ি থামল একটা ছোট নতুন রেস্তোরার সামনে। এখানে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন শৌচালয়ের ব্যবস্থা আছে। আমরা নামলেও বাচ্ছারা/ দাদু ভাইরা গাড়িতেই রইল। শুধুমাত্র চা পান করে গাড়ি আবার চলতে শুরু করল। গাড়ি চলল জঙ্গলের মধ্য দিয়ে। জঙ্গল কেটে গাড়ি চালাবার জন্য একমুখী রাস্তার ব্যবস্থা করা আছে। দীর্ঘ সে পথ, মনোমুগ্ধকর প্রকৃতিকে উপভোগ করতে এই পথ পার হচ্ছি, মাঝে মাঝে গাড়ির দুলুনিতে চোখে ঘুম জড়িয়ে আসছে। ভালো লাগার অনুভূতি ভাষায় প্রকাশ যোগ্য নয়। এরপর কর্ণাটক পার হয়ে গোয়ার বর্ডারে ঢোকার কথা। পথে পড়ল সমুদ্র– রবীন্দ্রনাথ টেগোর সি বিচ কারওয়ার। পুত্র ও পুত্রবধু বেশ কিছুদিন আগে এখানে বেড়াতে এসেছিল, নৌকা চেপে সমুদ্র মধ্যস্থ পাহাড়দ্বীপে গিয়ে ঘুরে ফিরে এসেছে। স্মৃতি রোমন্থনই হল, সময়ের অভাবে ষেতে পারলাম না। তবে ফেরার পথে অবশ্যই খানিকটা সময় কাটাব এখানে। নির্দিষ্ট সময়ের পূর্বেই আমরা রিসর্টে পৌঁছে গেলাম।

কলকাতা থেকে উড়ানে আমাদের আর একটি দল পানাজি বিমানবন্দর হয়ে গাড়ি ভাড়া করে একই সময়ে রিসর্টে পৌঁছল। ঘরে জিনিস পত্র রেখে লাঞ্চ করতে গেলাম। দেরি হয়ে যাওয়ায় যা পাওয়া গেল তাই অর্ডার করা হল, বড় নাতি আন্তুর খুব খিদে পেয়ে গেছে কিন্তু ওর খাবার এল সবার শেষে। যাই হোক, আমি বেশ ক্লান্ত ছিলাম, খাওয়া সেরে আমি রিসর্টে ফিরে বিশ্রাম নিলাম আর বাকি সকলে চলল সমুদ্র সৈকতে। বাচ্চারা সঙ্গে আনা খেলনা নিয়ে ভিজে বালিতে বানাতে লাগল নানা নকসা। বালি মেখে বালিতে গড়াগড়ি খেয়ে বেজায় খুশি ওরা/আনন্দ ওদের।

নীল আকাশে পড়ন্ত বেলায় সূর্যাস্তের বর্ণময় দৃশ্য দেখে রিসর্টে ফিরে এল ওরা। একটু বিশ্রাম নিয়ে আবার চললাম সি বিচে। বসে বা শুয়ে সমুদ্র দেখার জন্য এখানে নানা রকমের বিছানা পাতা আছে। বিছানায় বসে ঢেউয়ের পর ঢেউ সমুদ্র লহরী দেখার আনন্দ অসাধারণ। এর পর সমুদ্র বারি স্পর্শ করতে করতে এ প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে হাঁটতে শুরু করলাম। রাতের ডিনার কোথায় হবে ভাবছি এমন সময় দেখি সমুদ্র সংলগ্ন বেলাভূমিতে টেবিল চেয়ার পাতা আছে। অর্থাৎ এখানে ক্যান্ডেল ডিনার করা যাবে।

আমরা আজ ডিনার সারব নানা সামুদ্রিকপদ দিয়ে। চেয়ারে বসতেই জ্বালিয়ে দিল বড় বড় মোমবাতি। মেনু কার্ড দেখে মেনু ঠিক করা হল। সামনেই জ্বলছে ক্যাম্প ফায়ার। মেঘ মুক্ত নীল আকাশের চাঁদনী আলোতে, সমুদ্র তরঙ্গের কলধ্বনি শুনতে শুনতে আমাদের ডিনার শেষ হল। আমার সামুদ্রিক পদে এলার্জি তাই বুঝে শুনে খেতে হল। সমুদ্রতটে এরকম ডিনার খাওয়ার আনন্দ এই প্রথম উপলব্ধি করলাম। মজাও পেলাম, মজা পেল শিশুরাও। রিসর্টে ফিরে ঘুমিয়ে পড়লাম।

সকালে ঘুম থেকে উঠে বারান্দা থেকে দেখা যায় রিসর্টের ভিতরে গাছ ভর্তি ফুলে ফলে ভরা, প্রকৃতির এই অপরূপ দৃশ্য মনকে আচ্ছন্ন করে রাখল। নানান ধরনের পাখি ও কাঠবেড়ালি গাছের ফাঁক থেকে মাঝে মাঝেই উঁকি দিচ্ছে। তাই কমপ্লিমেন্টারি ব্রেকফাস্ট খেয়ে পুরো রিসর্ট চত্বরে ঘুরে বেড়াব ঠিক করলাম। এটি একটি ইন্টারন্যাশনাল রিসর্ট। সে জন্য ব্রেকফাষ্ট মেনুতে সাউথ ইন্ডিয়ান, নর্থ ইন্ডিয়ান, বিদেশি সব ধরণের খাবারের ব্যবস্থা আছে। এখানে প্রচুর ভিড় অর্থাৎ বিশাল এই রিসর্টে বহু লোক বেড়াতে এসেছে। মাঝে মাঝে খাবারের জন্য লাইনে দাঁড়াতে হচ্ছে, তবে তদারকি ব্যবস্থাও সামঞ্জস্য পূর্ণ।

প্রতিটি মেনুই খুব সুস্বাদু। তবে একদিনে সবকিছুর স্বাদ গ্রহণ সম্ভব নয়। এরপর দেখলাম সুন্দর সুইমিং পুল। করোনাবিধিতে সাঁতার কাটা নিষিদ্ধ। একমাত্র কাকেরা সুইমিং পুলে স্নান করছে, ওদের জন্য কোনো নিষেধ বিধি নেই। এখানে ছবি আঁকা, পেন্টিং করা ও নানা খেলাধুলোর ব্যবস্থা আছে। কিন্তু করোনা আবহ সম্পূর্ণ কাটেনি বলে সবই প্রায় বন্ধ, বন্ধ জিমও। বিশাল জায়গা জুড়ে নারকেল গাছের সারি। প্রচুর কাজু বাদাম গাছ, কিন্তু ফল ধরেনি এখনও। গাছ দেখে সন্তুষ্ট থাকতে হল। চারিদিক প্রাচীর দিয়ে ঘেরা রিসর্টটির সমুদ্রগামী পথটি বড়ই মনোরম, সুন্দর গেট পার হয়ে যেতে হয়। রিসর্ট থেকে সমুদ্রে পৌঁছাতে অন্তত ১৫ মিনিট সময় লাগে। কিন্তু প্রকৃতির ছত্রছায়ায় হাঁটুর ব্যথা নিয়ে যেতে আসতে কোনো কষ্ট হয়নি। 

এর পর সমুদ্রে স্নান করা চলল। শিশুরা খেলনা ও ভিজে বালি নিয়ে নানান নকসা এঁকে চলেছে। বড়রাও মন্দির/ ক্যাসল বানাচ্ছে। সমুদ্রঢেউ সেগুলি ভেঙে দিয়ে চলেছে। তবুও গড়া ভাঙা চলছে অবিরত। সমুদ্রতটে জেটস্কাই ও প্যারাসেলিং অপেক্ষায় আছে যাত্রীর জন্য। বহু ছোট বড় লোকজন, লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে টাকার বিনিময়ে সমুদ্রে ভাসা বা আকাশে ওড়ার জন্য। আমার ৭ বছরের নাতির ইচ্ছা প্রবল। ওর সাহস দেখে অবাক হলাম— ভাসা এবং ওড়ায় ওর কোনো ভয়-ডর নেই। বিকালে সূর্যাস্ত দেখার অপেক্ষায় আছি। আকাশ মেঘাচ্ছন্ন। হঠাৎই খানিকটা মেঘমুক্ত হয়ে সূর্য অস্তমিত হল সমুদ্রবক্ষে। অপূর্ব সুন্দর সে দৃশ্য, নয়নাভিরাম। এরপর সমুদ্র সৈকতের একটি হোটেলে নৈশভোজ সেরে ডেরায় ফিরে এলাম। হোটেলটির বসার ব্যবস্থা এতই ভালো যে খেতে খেতে সমুদ্রের তরঙ্গ লহরী চাক্ষুষ করা যায়। পাশেই দেখা গেল গোয়ালিয়ন হার্ড ড্রিকসের দোকান। তারও একটু স্বাদ নেওয়া হল।

পরের দিন আবার সমুদ্র সৈকতে। চলল নানান পাখির ছবি তোলা, তারপর বালি মেখে সমুদ্র স্নান। বিকেলটা অবশ্য কাটল অন্যভাবে। এখানে সাইকেল ভাড়া পাওয়া যায়। প্রত্যেকে সাইকেল নিয়ে ছুটে চলল বিচের এ প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে, শিশুরাও সাইকেলের সামনে পিছনে চেপে। শান্ত সমুদ্র, ছোট ছোট ঢেউ তাই বাচ্চারা ক্রিকেট বল নিয়ে খেলতে শুরু করল। বল লোফালুফি খেলাও চলল। বিচে বেশি লোক সমাগম নেই। মনে হয় শুধু রিসর্টের লোকজনই এই বিচটা ব্যবহার করে। বিচে পাতা বিছানায় শুয়ে সামুদ্রিক মনোরম দৃশ্যাবলী অনুভব করার আনন্দ আগে কোনোদিন পাইনি। তার উপর করোনায় বন্দি জীবনের সাময়িক মুক্তি। 

পরদিন ফেরার পালা, কলকাতাগামী যাত্রীদের গাড়িতে তুলে দিয়ে ভার্সা বিচের শেষ দর্শন সেরে নিলাম। ব্রেকফাষ্ট করলাম একটু পরে। গাড়িতে মালপত্র উঠিয়ে চললাম ফেলে আসা রবীন্দ্রনাথ টেগোর সি বিচের দিকে। মনের মধ্যে সে কি এক অনাবিল রোমাঞ্চ। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ এই সি বিচে কিছুদিন সময় কাটিয়েছেন, এখানে বসেই লিখেছেন ‘প্রকৃতির প্রতিশোধ’ কবিতা। পথে পড়ল পর্তুগিজদের কিছু পুরাতন বাড়ি (একসময় গোয়া পর্তুগিজদের কলোনি ছিল)। শুনসান এই বিচ। নতুন ভাবে চমকপ্রদ করার কাজ চলছে এই বিচে। নৌকায় চড়ে পাহাড় দ্বীপে যাওয়ার কোনো নৌকা দেখতে পেলাম না।

কয়েকটা ছবি তুলে খানিকটা সময় কাটিয়ে রওনা দিলাম বাড়ি ফেরার পথে। ড্রাইভারের একমুখী জঙ্গলের পথ পছন্দ হয়নি। তাই অন্য পথের সন্ধান নিয়েছে, সে পথটি নাকি প্রসস্থ এবং কম দীর্ঘ। কিন্তু আমরা যা দেখলাম পথটি অধিকতর দীর্ঘ তো বটেই, রাস্তাটি চওড়া ঠিকই কিন্তু খুবই খারাপ, ভাঙাচোরা অবস্থা। পুরো পথটিতে মেট্রো রেলের কাজ চলছে। এ পথে কোনো ভাল রেস্তোরা নেই, ফলে ডিনার খাওয়ার খুব অসুবিধা হল। তার উপর এক অন্ধকার পথে গাড়ির চাকার একটি টায়ার ফেটে গাড়ি বসে গেল। আমি সামলাচ্ছিলাম দুই নাতিকে। মোবাইলের আলোয় বাকিদের চেষ্টায় টায়ার বদলানো সম্ভব হল। অবশেষে বাড়ি পৌঁছালাম রাত্রি ২টোয়। ১০ ঘণ্টার জার্নি ১৫ ঘণ্টায় শেষ হল। তবে আমরা সবাই সুস্থভাবে নিরাপদে বাড়ি পৌঁছালাম। প্রকৃতির সঙ্গে নিবিড় ভাবে কয়েকদিন কাটিয়ে ভ্রমণ পিপাসা খানিকটা মেটানো গেল।

সব ছবি: কমলা আদক

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *