ইভা ব্রাউনের
প্রেম ও কিছু প্রশ্ন

ডঃ সঞ্জীব রায়

প্রতিবেদনের শুরুতেই ইভার কাছে যাবার আগে তাঁর স্বপ্নের নায়কের সম্পর্কে কিছু বলা আবশ্যিক, কারণ তাঁর নায়ক যে পৃথিবীর সর্বকালের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ফ্যাসিস্ট নেতা অ্যাডলফ হিটলার। তাঁর পুঁথিগত বিদ্যা অতীব সামান্য থাকলে কী হবে— ভদ্রলোকের জনসমাবেশে বক্তব্য রাখার অসাধারণ নৈপুণ্য ছিল। হ্যাঁ, তাঁর বক্তৃতা মানুষকে চুম্বকের মত আকর্ষণ করত। তা অনেকের সঙ্গে করেও ছিল বিশেষ একজনকে, তাঁর নাম— ইভা ব্রাউন।

.

কর্তামশাই অর্থাৎ হিটলার সাহেবের জন্ম ১৮৮৯ সালের ২০ এপ্রিল অস্ট্রিয়াতে। জন্মসূত্রে তিনি ইহুদি। হিটলারের বাবা ছিলেন অবৈধ সন্তান। সেটা কীভাবে? হিটলারের ঠাকুমা ছিলেন রাঁধুনি এবং সুন্দরীও বটে। তিনি একটি অবস্থাপন্ন ইহুদি পরিবারে রান্নার কাজ করতেন। হিটলারের বাবা ছিলেন সেই বাড়িরই এক সদস্যের সন্তান। অ্যাডলফ সেটা জেনে গিয়েছিলেন। জেনে ছিলেন এক পাদ্রী সাহেবের কাছ থেকে। জনসমক্ষে পিতৃপরিচয় দিতে না পারলে যা হয়— হিটলারের বাবা যতদিন বেঁচে ছিলেন সর্বক্ষণ তাঁর মনে সামাজিক নিরপত্তাহীনতা কাজ করত। ফলে তিনি হয়ে উঠেছিলেন নির্মম, কঠিন ও বদরাগী।
অ্যাডলফ ছিলেন বাবা-মায়ের ছয় সন্তানের মধ্যে চতুর্থ। তাঁর মা (‌গর্ভধারিণী) ছিলেন বাবার দ্বিতীয় পক্ষের স্ত্রী। ছোটবেলা থেকে অ্যাডলফ ছিলেন পড়াশোনায় অত্যন্ত অমনোযোগী, কিন্তু ছবি আঁকায় অত্যন্ত পারদর্শী। ইচ্ছা ছিল রং তুলির সাহায্যেই নিজের ভবিষ্যৎকে রঙিন করে তোলার, কিন্তু বাধ সেধেছিলেন স্বয়ং বাবা। ছেলের আত্মজীবনীর ভাষায় বলতে গেলে, ‘বদরাগী‌ ওই লোকটাই আমার আঁকা বন্ধ করেছিল।’ সন্দেহ নেই বাবা চাননি যে ছেলে ছবি আঁকাকে জীবনে পেশা হিসেবে গ্রহণ করুক। তিনি যদি তা চাইতেন তাহলে পৃথিবীর ইতিহাস একটু অন্যরকম হতেই পারতো।

হিটলারের জীবনে একাধিক নারীর আগমন ঘটেছিল। সরকারিভাবে তিনজন। বেসরকারিভাবে অনেক। এই প্রসঙ্গে প্রথমেই বলে নেওয়া দরকার যে রটনা যাই হোক হিটলার ছিলেন স্বাভাবিক পুরুষ। সমকামী নন। যদিও নিজ ঔরসজাত সন্তানের জন্ম দিতে তিনি ছিলেন অক্ষম। হিটলারের জীবনে সরকারিভাবে যে তিনজন নারীর আবির্ভাব হয়েছিল সময়ানুসারে ক্রমান্বয়ে সাজালে তারা ছিলেন গেলি রবেল, মারিয়া রেইটার এবং সবশেষে কয়েকঘণ্টার হিটলারের আইনসিদ্ধ স্ত্রী ইভা। এ ক্ষেত্রে পাঠকদের একটি আপাতনিরীহ প্রশ্ন থাকতেই পারে, যে সারাজীবন বিয়ে না করে হিটলার মরণকালে (‌৫৬ বছর বয়সে)‌ বিয়ে করেছিলেন কেন। তাঁর কাউকে বিয়ে না করার জন্যই সম্ভবত গুজব রটে যে হিটলার শারীরিকভাবে অক্ষম ছিলেন। বাস্তবটা তাই ছিল না। হিটলার নিজেই চাইতেন না নাৎসি বাহিনীর কেউ বা তাঁর দলের গুরুত্বপূর্ণ কেউ বিয়ে করুক। তাঁর কিন্তু নারী সঙ্গ নিয়ে কোনো আপত্তি ছিল না। আপত্তি ছিল বিয়ে করা নিয়েই। সারাজীবন নিজেকেও অবিশ্বাস করে আসা এই ভদ্রলোক তাঁর সিদ্ধান্তের স্বপক্ষে অনেক যুক্তি সাজিয়ে ছিলেন বটে, কিন্তু সেগুলিকে তুলে ধরে প্রতিবেদনের আয়তন বাড়ানোর মানে হয় না। তিনি অলিখিত নিয়ম চালু করে দেন যে নাৎসি বাহিনীর কেউ বিবাহ করলে তাঁদের ‌স্ত্রীদের‌ বাধ্যতামূলকভাবে গৃহবন্দি হয়ে জীবন কাটাতে হবে। তিনি বিলক্ষণ জানতেন যে এই শর্তে জার্মান মহিলারা অন্তত বিয়ে করতে রাজি হবেন না। বলা বাহুল্য হিটলারের অনুমান একেবারেই সঠিক ছিল। তাহলেও একটা প্রশ্ন থেকেই যায় যে চিরবিদায়ের আগে হিটলার বিয়ে করলেন কেন? হ্যাঁ এই কাজটি প্রকৃত অর্থেই ছিল মৃত্যুর পূর্বে ইভাকে দেওয়া তাঁর ভালোবাসার স্বীকৃতি। যা অনেক আগেই করা উচিত ছিল তা তিনি করলেন জীবনের শেষ প্রহরে। তবে একটা কথা সত্যি যে অত্যন্ত প্রতিকূল অবস্থার মধ্যে বেড়ে উঠা, ইহুদি বুদ্ধিজীবীদের ক্রমান্বয়ে আক্রমণ এবং নিজের শারীরিক সীমাবদ্ধতা নিয়ে চলা ভদ্রলোককে তাঁর বাবার মতনই নিষ্ঠুর করে তুলেছিল।

প্রথম মহিলা রবেলের সঙ্গে হিটলারের যখন পরিচয় তখন রবেল একেবারেই কিশোরী। টানা ১৯ বছরের সম্পর্ক। সম্পর্কে টানাপোরেন যে আসেনি তা নয়। একসঙ্গে দু’জনের বেশ কয়েকবছর মিউনিখে রবেলের অ্যাপার্টমেন্টে থাকা। তারপর একদিন হিটলারের অনুপস্থিতিতে রবেলের আত্মহুতি। দ্বিতীয় জন মারিয়া সম্বন্ধে বিশেষ কিছু জানা যায় না, তবে অনেকেই বলেন হিটলারের জীবনে মারিয়ার প্রবেশ সহ্য করতে না পেরেই নাকি রবেলের আত্মহত্যা।
এবার আসি ইভার প্রসঙ্গে। মিউনিখে যখন ইভা প্রথম হিটলারকে দেখেন তখন তাঁর বয়স ১৭, আর হিটলারের ৪০ ছুঁই ছুঁই। সময়টা ১৯২৯ সালের মাঝামাঝি। ইভার বাবা স্কুলের মাস্টারমশাই। সাধারণ মধ্যবিত্ত পরিবার। ইভার বড় বোন লিজা এবং ছোট বোন মার্গারেট। ইভা বরাবরই বয়সের তুলনায় একটু বেশি বিচক্ষণ, বুদ্ধিমতী ও সপ্রতিভ। যতদূর জানা যায় সুন্দরী ইভার চেহারাটা বাস্তবিকই নজরে পড়ার মতনই ছিল। ঘটনাচক্রে ইভা একদিন দিদির সঙ্গে হিটলারের বক্তৃতা শুনতে গেল। ব্যাস প্রথম দর্শনেই কাহিল। আত্মীয়, পরিজন, বাবা, দিদি— সবাই বারণ করলেন কিন্তু বিধি বাম। ফলে হল কী তারপর থেকেই ইভা হিটলারের সঙ্গে যোগাযোগ করার জন্য অস্থির হয়ে উঠতে থাকেন। কিন্তু যতদূর জানা যায় হিটলারের জীবনে তখন রবেলের ও মারিয়ার উপস্থিতি পুরোমাত্রায় ছিল। বিচক্ষণ হিটলার সাহেব ইভাকে একটু নজরে রেখেছিলেন। মাঝেমধ্যে একটু যোগাযোগ তারপর কিছুদিন চুপচাপ। সোজা কথায় বললে ইভাকে নিয়ে একটু খেলা। তা হিটলার সাহেবের ভাগ্যটা ভালো ছিল বলতেই হবে। রবেল চলে গেলে আর মারিয়াও হঠাৎ করে হারিয়ে গেল। কিন্তু ইতিমধ্যে একটা ঘটনা ঘটে গেল। ইভার ভালোবাসা ছিল অকৃত্রিম এবং নিঃস্বার্থ। সহ্য করতে পারছিলেন না প্রাণের মানুষের সঙ্গে দূরত্ব। শেষমেশ সম্ভবত ১০ বা ১১ আগস্ট ১৯৩২ বাবার পিস্তল থেকে ইভা নিজের বুকেই গুলি করলেন। নিন্দুকরা অবশ্য বলেন যে পুরোটাই নাটক ছিল হিটলারের কাছ থেকে গুরুত্ব পাবার জন্য। তবে এটাও ঠিক যে এই ঘটনার পর থেকেই হিটলারের সঙ্গে তাঁর প্রেমে গতি আসে। তাহলেও এটাও অনস্বীকার্য যে হিটলারের কর্মব্যস্ত জীবনে ইভার জন্য বেশি সময়বার করা বাস্তবিকই অসম্ভব ছিল। কিন্তু প্রেমিকা তা বুঝলে তো!‌ আবার ১৯৩৫ সালের মে মাসে ইভা একটা চিঠি লিখে রেখে গাদাখানেক ঘুমের বড়ি খেয়ে নিলেন। চিঠিতে ছিল হিটলার বেশি সময় দিতে না পারার জন্যই তাঁর এই সিদ্ধান্ত। তবে হিটলার ও ইভা দু’জনেই বাইরের জগতে খুব সংযমী ছিলেন। ১৯৩৬ সালে শীতকালীন অলিম্পিক ক্রীড়াতেই সর্বপ্রথম তাঁদের একসঙ্গে দেখা গিয়েছিল। পরবর্তীকালে ১৯৪৪ সালে ইভার বোনের বিয়ের পার্টিতেও তাঁদের একসঙ্গে দেখা যায়। তবে তাঁরা একসঙ্গে সচারচর বাইরে বেরোতেন না।

দু’জনের মধ্যে আরও একটি ব্যাপারে খুব মিল ছিল। দু’জনেই ছিলেন পশুপ্রেমিক। সহজ করে বলতে গেলে সারমেয় প্রেমিক। ইভার ছিল স্কটিশ টেরিয়ার আর হিটলারের জার্মান শেফার্ড। আত্মহননের আগে হিটলার তাঁর প্রিয় সারমেয়র উপর সাইনাইড প্রয়োগ করেন ২৯ এপ্রিল, ১৯৪৫ সালে; সদ্য মা হয়ে ওঠা সে চারটে বাচ্চাকে রেখে মিনিটখানেকেও বাঁচেনি। পরেরদিন, ইভার সাইনাইড খাবার আগে তাঁর সারমেয়দের সঙ্গে সদ্য জন্মানো নবজাতকদের গুলি করে মারা হয়। যথাবিহিত নিয়ম অনুসারে ম্যারেজ রেজিস্টারে উভয়ের সই, সাক্ষী সমেত আচার সম্পন্ন হয় সারমেয় নিধনের পরে।
দুঃখের কথা ইভার পটাশিয়াম সাইনাইডের সাহায্যে আত্মহনন বহু প্রশ্নের উত্তর পাবার সম্ভাবনাকে চিরতরে নষ্ট করে দিয়েছে। তবে হিটলার-সমালোচকদের অনেককেই স্তব্ধ করে দিয়েছে। প্রশ্ন জাগে ইভার এই অকৃত্রিম ভালোবাসার কারণটা ঠিক কী? শুধুই কি মোহ? পেশাগতভাবে ফটোগ্রাফার হবার দৌলতে কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্প তাঁর না জানার বিষয় নয়। আউইচের ভেতরে ইহুদি নিধন যজ্ঞে ইভার তোলা ছবি বহু জায়গায় প্রদর্শিত হয়েছে। ইভা দেখেছেন যে তাঁর নিজের আত্মীয়দেরও হিটলারের প্রতিহিংসার শিকার হতে হয়েছে। তিনি জানতেন তাঁর প্রিয়তমের ইহুদি বিদ্বেষের কথা। তিনি যথেষ্ট ওয়াকিবহাল ছিলেন যে তাঁর জীবন হিটলার-ময় হলেও তাঁর প্রেমিকের জীবন কিন্তু ইভা-ময় নয়। সব কিছু জেনে শুনে ইভা আপনি কীসের মোহে, কীসের আগ্রহে এই নিষ্ঠুর প্রেমিকের সঙ্গে সহমরণে গেলেন? এ প্রশ্ন শুধু আমার নয়— এই প্রশ্ন তোলপাড় করে সমগ্র বিশ্ববাসীকে, হ্যাঁ আজও।

প্রেমিকের জন্য প্রেমিকার আত্মত্যাগ বিশ্বে নতুন কিছু নয়। তবুও এটি একটি ব্যতিক্রমী ঘটনা। জনতার দরবারে সুহৃদ মুসোলিনির ফাঁসি হওয়ার খবর পেয়ে হিটলার অত্যন্ত বিচলিত হয়ে পড়েন এবং তৎক্ষণাৎ আত্মহননের সিদ্ধাম্ত নেন। এ ছাড়া তার অন্য কোনো পথ খোলা ছিল না, কারণ তাঁর মতো ব্যক্তিত্বের আত্মসমর্পন ছিল অসম্ভব। সেহেতু হিটলারের আত্মত্যাগ ছিল সম্পূর্ণভাবে আত্মকেন্দ্রিক, কিন্তু ইভার আত্মত্যাগ ভালোবাসার জন্য। ইভা আপনি মরিয়া প্রমাণ করিলেন যে, ওইরকম একটি লোককেও ভালোবেসে সহমরণে যাওয়া যায়। সেও ভালোবাসার যোগ্য।
হে মহিয়সী নারী ইভা ব্রাউন হিটলার, আপনাকে স্যালুট জানাই। সেলাম জানাই আপনার ভালোবাসাকে, আপনি আজীবন থেকে যাবেন বিশ্ববাসীর অন্তরে।

ছবি সৌজন্যে: আন্তর্জাল

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *