পুজোয় থাকে
আন্তরিকতার স্পর্শ
ডঃ পার্থ বন্দ্যোপাধ্যায়
আটলান্টিক মহাসাগরের পূর্বে ছোট্ট সবুজ দ্বীপ আয়ারল্যান্ড। রাজধানী ডাবলিন। আর এই ডাবলিনেই নিয়ম, নিষ্ঠা মেনে জাঁকজমকভাবে হয়ে আসছে বেশ কিছু দুর্গাপুজো। ডাবলিনের পাশাপাশি কর্কেও হয় দুটো পুজো। এবার তিনটে। এই দেশে কোনও কোনও পুজো উদ্যোক্তা একদিনেই সেরে নেন সপ্তমী, অষ্টমী, নবমী, দশমীর পুজো; আবার কেউ দু–আড়াই দিনে মিটিয়ে নেয় মাতৃ আরাধানা। তবে দুটো পুজো আছে একটা ডাবলিনে, আরেকটা কর্কে; যেখানে উদ্যোক্তরা পাঁচদিন ধরে পুজোর আয়োজন করেন পঞ্জিকার তিথি এবং নিয়ম, নিষ্ঠা মেনে।
প্রথমে আসি ডাবলিনের সুজন বেঙ্গলি কালচারাল অ্যাসোসিয়েশনের দুর্গাপুজোয়। এবার বাইশ বছরে পা দিল এই পুজো। সমুদ্র আর পাহাড়ে ঘেরা আয়ারল্যান্ডে প্রবাসী বাঙালির সংখ্যা নেহাত কম নয়। কর্মসূত্রে বা উচ্চশিক্ষার তাগিদে বহু বাঙালি এখন এখানকার স্থায়ী বাসিন্দা। কয়েকজন সমমনস্ক মানুষ একত্রিত হয়ে শুরু করেন সুজন বেঙ্গলি কালচারাল অ্যাসোসিয়েশনের পুজো। সুজনের পুজোয় থাকে আন্তরিকতার স্পর্শ। পূর্ণমাত্রায় বজায় থাকে পুজোর আমেজ। প্রতিবারের মতো এবারও ষষ্ঠীর দিন সন্ধেতে আয়োজন করা হয়েছিল আনন্দমেলার। মেলায় বাড়ি থেকে সবাই খাবার বানিয়ে এনে বিক্রি করেন। যেখানে থাকে বিরিয়ানি থেকে চিকেন প্যাটিস, এগরোল থেকে বড়াপাও, পিঠেপুলি থেকে সিঙাড়া, মাছের চপ থেকে ঘুগনি, বিভিন্ন রকম চাট থেকে ফুচকা— সবই।
এই পুজো প্রতিবছর শরতের কোনও একটি সপ্তাহের শেষদিনে শুরু হয়ে আড়াইদিনে সম্পন্ন হয়। কারণ দৈনন্দিন জীবনের কর্মব্যস্ততা সামলে অধিকাংশকে পুজোয় যোগ দিতে হয়। সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, উপাচার সবই থাকে সুজনের পুজোয়। সে বিষয়ে প্রধান পুরোহিত ও কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে বেশ ভালো লাগল। দক্ষ হাতের তত্ত্বাবধানে অষ্টমীর অঞ্জলি, সন্ধি পুজো, নবমীর সন্ধ্যারতি, দশমীর বরণ, সিন্দুর খেলা সবই থাকে এই পুজোয়। সৌম্যদীপ্ত, ইন্দ্রজিৎ, সৌর্য, প্রত্যুষ, অভিষেক, অঙ্কিতা প্রমুখ প্রায় দু’মাস ধরে নেন পুজোর যাবতীয় প্রস্তুতি। নাটক, নাচ, গান সবই থাকে এই পুজোয়।
এবার আসি ডাবলিনের আরেকটি আইডিসি–র পুজো প্রসঙ্গে। যথেষ্ট ধুমধামের সঙ্গে অনুষ্ঠিত হয় এই পুজো। পাঁচদিনের এই পুজোয় মানা হয় যাবতীয় নিয়মকানন। পুজোর প্রধান আহ্বায়ক বিজয় আচার্য। সঙ্গে থাকেন শাশ্বত চ্যাটার্জি। বাকি সদস্যরাও বেশ আনন্দের সঙ্গে মাতেন এই পুজোয়। বাংলা থেকে এত দূরে থেকেও পুজোর উন্মাদনায় বিন্দুমাত্র খামতি চোখে পড়ল না।
এবার এক অন্যরকম মন মাতানো পুজোর কথা বলি। কর্কে দুটো পুজো হয়। একটা ডগলাসের কর্ক বেঙ্গলি অ্যাসোসিয়েশনের পুজো। সেখানে বাঙালিরা পুজো করেন। পুজোয় যুক্ত থাকেন সেখানকার সব বাঙালি পরিবার। আমার মেয়ে উপলা ব্যানার্জিও এদের পুজোর সঙ্গে যুক্ত। এখানে একদিনে পুজো সম্পন্ন হয়। এ বছর অষ্টমীর দিন হল মাতৃ আরাধনা। পুজো উপলক্ষ্যে আয়োজিত সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে অংশ নেয় উপলাও। আর এই সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের ব্যবস্থাপক রোহিনী রায়।
কর্কের আরেকটি পুজো বাংলাদেশী হিন্দু সম্প্রদায়ের পুজো। উদ্যোক্তা অভি রায়, রিপন ভৌমিক, হিরক কর, সাথী ভৌমিক, রিনা পুরকায়স্থ, উপলা ব্যানার্জি প্রমুখ। অভি রায়ের গানে ও উপলা ব্যানার্জির পরিচালনায় নৃত্যে আলোকিত হয়ে উঠে সংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। পুরোহিত সুখ চক্রবর্তী নিষ্ঠা সহকারে পাঁচদিন ধরে করেন দেবী দুর্গার আরাধনা। খাওয়াদাওয়া, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানেরও ছিল ব্যবস্থা।
এখানে এসে মনে হল আমরা সবাই যেন এক পরিবারের অংশ। এইরকম পুজোই তো প্রবাসে একত্রিত করে বাঙালিকে, বাঙালি পরিবারকে। পরিচয় হল কলকাতার ছেলে অরিজিৎ মিশ্রর সঙ্গে। কর্মসূত্রে রয়েছেন আয়ারল্যান্ডে। বাংলাদেশী হিন্দু সম্প্রদায়ের পুজোর সঙ্গে যুক্ত রয়েছে বেশ কয়েকটি পরিবার। শুনেছিলাম ছোট করে শুরু হয়েছিল এদের পুজো। এবার তো দেখলাম প্রচুর লোকের সমাগম।
এখানকার মেয়র কিরেন ম্যাক ক্যাথি, লিমেরিকের মেয়র আজাদ তালুকদার, সুপারিনটেনডেন্ট (পুলিশ) জন ডেইজি, পার্লামেন্টেরিয়ান ম্যাক ব্যারি সবাই অংশ নেন এই পুজোয় এবং নানাভাবে সহায়তা করেন। বাড়ির বা পাড়ার পুজোর মতো সবাই সবার সঙ্গে কী সুন্দর মিশে যাচ্ছিল এখানে। কমিউনিটি হলে হয় পুজোর যাবতীয় ব্যবস্থা। নিয়ম, নিষ্ঠা যেমন আছে; তেমনই এই পুজোর সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে আন্তরিকতা। পুজোয় ঢাকের বাদ্যির সঙ্গে মাঝেমাঝে মিশে যাচ্ছিল মহিষাসুরমর্দিনী। মনে হবে যেন নিজের বাড়ির পুজোতেই রয়েছি।
ডাবলিনে ভিএইচসিসিআই মন্দিরে আয়োজিত পুজো এবার নিয়ে ছিল অন্যমাত্রা। পুজোর আয়োজনে সুদীপ সান্যাল ও সঙ্ঘমিত্রা সান্যাল। এ বছর পুজোর পুরোহিত হিসেবেও দেখলাম সঙ্ঘমিত্রাকে। আয়োজনের কোনও খামতি যাতে না হয় তার জন্য আহ্বায়করা ছিলেন সজাগ। নিষ্ঠা ও ভক্তির এক চরম নিদর্শন পেলাম এদের এখানে মহাসপ্তমীর অঞ্জলি দিতে গিয়ে।
সব ছবি: ডঃ পার্থ বন্দ্যোপাধ্যায়
Leave a Reply
Your email address will not be published. Required fields are marked *
Comments