রোমানিয়ার ব্রাসফের
ড্রাকুলা ক্যাসেল
ডঃ সঞ্জীব রায়
দেশ–বিদেশে একাধিকবার বিপদ কানঘেঁষে বেরিয়ে যাবার সুবাদে আমার ভেতরে এক আত্মবিশ্বাসের জন্ম দেয়। মনে করি যে, জীবনের প্রথম পাতা ও শেষ পাতা তো ঈশ্বরের লিখিত, সেই শেষ পাতাটি বোধকরি তার লিখতে আরও দেরি আছে। সেই ভাবনা থেকেই অতিরিক্ত সাহসী হয়ে এমন কিছু কাজ করে বসি যা আমার কোনোভাবেই করা উচিত নয়। আজকের এই লেখা এমনই এক অনুচিত কাজকে কেন্দ্র করেই।
ব্রাসফ রোমানিয়ার মধ্যভাগে অবস্থিত রাজধানী বুখারেস্ট থেকে ১৭৬ কিমি দূরবর্তী এক ছোট্ট, সুন্দর ও সাজানো শহর। এই শহরের জন্ম ১২৩৫ সালে। জন্মের পর এর নাম ছিল করোনা (হ্যাঁ, ঠিকই পড়ছেন), ল্যাটিন এই শব্দের অর্থ ‘মুকুট’। ব্রাসফ নামটা আসে অনেক পরে, স্থানীয় নদী বারসার নামানুসারে। কেউ কেউ অবশ্য বলেন ব্রাসফ নামকরণের উৎস তুর্কি শব্দ বারাসু— যার অর্থ সাদা জল। আমাদের প্যাকেজে এই শহর কিছুটা বাধ্য হয়েই ঢোকানো। সেটা কেমন? আমরা বুলগেরিয়ার রাজধানী সোফিয়া থেকে সড়কপথে রোমানিয়ার রাজধানী বুখারেস্ট যাব। দূরত্ব ৬৫০ কিমি–র মতো, যা এক নাগাড়ে বাসে করে যাওয়া বাস্তবিকই কষ্টসাধ্য। ইউরোপের রাস্তাঘাট খুবই উন্নতমানের হলেও ঐ দেশে বাধ্যতামূলকভাবে ২ ঘণ্টা বাস চালানোর পর পাইলট সাহেবকে (ড্রাইভার) পথের যে কোনো পেট্রল পাম্পে ৩০ থেকে ৪৫ মিনিট বিশ্রাম নিতেই হয়। ফলে ৬৫০ কিমি ভ্রমণ করা সময়সাপেক্ষ বটেই। অন্যদিকেও এক সমস্যা আছে, ওই দেশে বাসে কিন্তু শুকনো খাবারও খেতে দেয় না, ফলে বাস যেখানে থামছে সেখানেই পর্যটকরা কেউ না কেউ কিছু খাচ্ছেন, স্বভাতই সেখান থেকে বাস ছাড়তেও দেরি হচ্ছে। সব কিছু মাথায় রেখে ব্রাসফকে রাত কাটানোর এবং খানিক বিশ্রামের জন্যই নির্বাচিত করা। ব্রাসফে পৌঁছনোর পরে আমরা বাস থেকে নেমে সোজা ডিনার টেবিলে বসে পড়েছিলাম। এখানে ভালোই ঠান্ডা পড়ে। ফলে রাত্রে ঘুমটা ভালোই হয়েছিল।
পরেরদিন সকালে প্রাতঃরাশ সেরে লাগেজপত্র বাসে উঠিয়ে আমাদের যাত্রাশুরু। ব্রাসফ শহরের অন্যতম দ্রষ্টব্য ব্ল্যাক চার্চ। গথিক স্থাপত্যের সুন্দর নিদর্শন এই গির্জার নির্মাণকাল ১৪৭৭ সাল। গির্জার নাম কিন্তু প্রথম থেকে ব্ল্যাক ছিল না, অন্যকিছু ছিল। ১৬৮৯ সালে শহরে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে চার্চটি একেবারে ভস্মীভূত না হলেও সম্পূর্ণভাবেই কালো হয়ে যায়। কুসংস্কারছন্ন শহরের মানুষজন যে কোনো কারণেই হোক চার্চটির বাইরের অংশকে কালোই রেখে দিয়েছেন। চার্চটির নামকরণ হয়ে যায় ব্ল্যাক। এটি ছাড়াও সেন্ট নিকোলাস চার্চ বা সিটি সেন্টারে কাউন্সিল স্কোয়্যার ফাউন্টেন অবশ্যই দেখার।
ব্যক্তিগতভাবে আমার কাছে ব্রাসফের আকর্ষণ কিন্তু উল্লেখিত কোনোটাই নয়। কলকাতা থেকেই যাকে দেখার জন্য ভেতরে ভেতরে ছটফট করছি তা হলো ব্রান ক্যাসেল বা ড্রাকুলা ক্যাসল। এটা দেখার কেন এত আগ্রহ সেটা বলা দরকার।
ক্যাসেলটি লোকালয়ের সামান্য দূরে এক ছোট পাহাড়ের উপর কাঠের পাটাতন দিয়ে তৈরি একেবারেই সাদামাঠা গড়ন। দ্রষ্টব্য স্থান বলতে যা বোঝায় মোটেই এটা সেটা নয়। তবে এর একটা বিশেষ বৈশিষ্ট আছে। ড্রাকুলা উপন্যাসের সৃষ্টিকর্তা ব্রাম স্টোকারের ড্রাকুলার বাড়ি বলে যে বাড়ির বর্ণনা দেওয়া হয়েছে, সেই বর্ণনার সঙ্গে এই ক্যাসেলের অদ্ভূত মিল, যেন এক্কেবারে কার্বন–কপি। সাধারণভাবে এই মিল থাকার মধ্যে অস্বাভাবিকতা কিছু নেই, তবে এই ক্ষেত্রে কিছু রহস্য আছে বৈকি! ব্রাম স্টোকারের বক্তব্য ছিল—রাতের অন্ধকারে ছোট গোলটেবিলে বসে টেবিল ল্যাম্পের আলোয় যখন তিনি উপন্যাস লিখতেন সেই সময় নাকি সেই উপন্যাসের জায়গা-বিশেষে তাঁর কলম আশ্চর্যজনকভাবে নিজেই দায়িত্ব নিয়ে লিখে দিয়েছে। প্রচণ্ড জনপ্রিয় এই উপন্যাস প্রকাশিত হবার পরে সাংবাদিকরা যখন স্টোকারের কাছে জানতে চান যে তিনি তাঁর বর্ণিত ক্যাসেলে কতবার গিয়েছেন। প্রশ্নের উত্তরে, উপন্যাসের লেখক বলেন, ‘বিশ্বাস করুন, আমি একটিবারও সেখানে যাইনি। যাওয়া তো দূরের কথা আমার এমন কোনো ক্যাসেলের সঙ্গে কোনোদিনই যোগাযোগ ছিল না।’ সত্যি অবাক করে দেবার মতনই ব্যাপার!
রোমানিয়ার বা রুমানিয়ার লোকজন ভূত–প্রেত, অশরীরী আত্মা, ব্ল্যাক ম্যাজিক ইত্যাদি জানে এবং খুব বিশ্বাস করে। ব্রাসফে হোটেলে চেকইন করে আমি রাতে হোটেল কাউন্টারে নেমে এসে কাউন্টারের ভদ্রলোকের সঙ্গে একটু আলাপ জমাবার চেষ্টা করি। সেখানে ভাষা সমস্যা আছে। তিনি ইংরেজি বললেও উচ্চারণ আমাদের মতো লোকেদের কাছে অসুবিধাজনক। অন্যদিক থেকে তিনিও সম্ভবত আমাকে দেখে একই কথা ভাবলেন। যাই হোক অনেক কষ্টে কিছুটা বুঝতে পেরেছিলাম, সেটাই বলছি।
মাঝে মধ্যেই অদ্ভূত সব ঘটনা ঘটার জন্য ক্যাসেল কিছুদিনের জন্য বন্ধ রাখা হয়। প্রায়শই নাকি অতি উৎসাহীরা ক্যাসেলের ভিতরে প্রবেশ করে নিখোঁজ হয়ে যায়। ঘটনাগুলি সবই ঘটে শুক্রবারে। সে জন্য প্রহরী ও গাইডরা শুক্রবার করে ক্যাসেল বন্ধ রাখার দাবি করেছিল। কিন্তু কর্তৃপক্ষ সেই দাবি না মেনে বন্ধের সময় একঘণ্টা এগিয়ে নিয়ে আসে। শনি ও রবি ক্যাসেল বন্ধ থাকতোই। অন্যান্য দিন (সোম থেকে বৃহস্পতি) বিকেল ৫টা অবধি আর শুক্রবার ৪টে করা হয়। বলা দরকার, আমার কথাগুলো বছর ছয়েক পুরনো, এখন কী সময় হয়েছে তা বলতে পারবো না।
পরের দিন ব্রেকফাস্ট করে বেরোনোর পরে আমি তো ব্রাসফের দ্রষ্টব্য কিছুই দেখছি না, মন পড়ে আছে সেই ড্রাকুলা ক্যাসেলে। আরও একটা আশ্চর্য ব্যাপার লক্ষ্য করছি যে, গাইড সাহেব খানিক ইচ্ছা করেই গড়িমসি করছেন। একবার বলার চেষ্টাও করলাম যে আজ, শুক্রবার ক্যাসেল তাড়াতাড়ি বন্ধ হয়ে যাবে, কিন্তু তিনি কথায় কর্ণপাত করলে তো! আমাদের গোটা দলের মধ্যে আমরা জনাছয়েক উৎসাহী বাদে বাকিদের না দেখলে কিছুই এসে যায় না। গাইড সাহেব তো আমার কথা শুনছেনই না, উল্টে গতকাল হোটেল কাউন্টারে শোনা কথাগুলো আবার আওড়ে চলেছেন, ফলে সহযাত্রীদের অনেকের মনের ভাবটা— ‘না বাবা গিয়ে কাজ নেই, কী দরকার!’ আমি দৃঢ় প্রতিজ্ঞ, দেখবই। শেষমেশ গ্রুপের অনেকেই যেতে না চাওয়ায় মাত্র ৬জন উৎসাহী হন্তদন্ত হয়ে অনেক সিঁড়ি ভেঙে টিকিট কাউন্টারের সামনে গিয়ে দেখি কাউন্টার বন্ধ হয়ে গিয়েছে। কারণ তিনটে বেজে গেছে। ক্যাসেল বন্ধ হবার ১ ঘণ্টা আগে টিকিট বিক্রি বন্ধ করে দেওয়া হয়। দেখি কাউন্টার বন্ধ করে ভদ্রলোক ইউরো/ডলার গুনছেন। তাঁকে হাত জোড় করে রাজি করাতে করাতে প্রায় সাড়ে তিনটে। রাজি হবার পেছনেও শর্ত ছিল তিনি মাত্র ৪জনকেই টিকিট দেবেন, সঙ্গে থাকা দু’জন মহিলাকে তিনি কোনোভাবেই টিকিট দেবেন না। তিনি বারবারই একই কথা বলছিলেন, ‘রিক্স’। কিসের রিক্স, কেন রিক্স কিছুই তখনো বুঝতে পারিনি।
একেবারে বন্ধ হয়ে যাবার মুখে ক্যাসেলে ঢুকলাম। ভেতরের লোকজন সবাই বেরিয়ে আসছে আমাদের ঢুকতে দেখে তারা অনেকটাই অবাক। আমি সুযোগের অপেক্ষায় ছিলাম, ভেতরে ঢুকেই আমি ইচ্ছাকৃতভাবে গাইড ও সহযাত্রীদের থেকে আলাদা হয়ে যাই। আমার লক্ষ্য ইন্টারনেট এবং সিনেমায় একাধিকবার দেখা নীচের তলায় একটা ঘর। তারপর যা ঘটেছিল তা মনে করলে এখনো গা ছমছম করে বৈকি। একতলায় অনেকগুলি ঘর পরপর। এখানে আলোটাও নিতান্তই কম। যেটা আমাকে অবাক করেছিল সেটা হচ্ছে এই ছবির সঙ্গে সিনেমায় দেখা ছবির অদ্ভূত মিল। নীচে নামার সিঁড়িতে লাল রঙে লেখা ছিল, ‘নীচে নামা একেবারেই নিষিদ্ধ।’ নীচের ঘরগুলি সবই ভেতর থেকে বন্ধ। কিন্তু হ্যাঁ একটাই খোলা। খোলা ঘরের সামনে আমি একা এসে দাঁড়াই। মুহূর্তে ঘরের ভেতরে চোখ যায়, বড় বড় কাচের জানলা সব বন্ধ। আমি নিশ্চিত ঘরে কেউ আছেন। হ্যাঁ, ইজিচেয়ার নড়ছে ঘরে, অদ্ভূত একটা পচা গন্ধ সঙ্গে মাঝে মাঝে বৃষ্টির জল মাটিতে পড়ার সেঁাদা সেঁাদা গন্ধ বটে। মাথাটা কেমন ঘুরতে থাকে। ভাগ্য ভালো, হ্যাঁ নিতান্তই ভালো, বাইরে দেওয়াল ধরে দাঁড়িয়ে থাকাকালীন ঘরে প্রবেশের মুহূর্তেই পেছন থেকে কেউ হ্যাঁচকা টানে আমাকে বাইরে নিয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে দরজা বন্ধ হয়ে যায়। পুরো ঘটনা ঘটে মুহূর্তের মধ্যে।
বহুকাল আমলের ভারী দরজা বিন্দুমাত্র হাওয়া ছাড়া কী করে বন্ধ হলো তা আজও বিস্ময়। গাইড আমাকে ক্যাসেলের বাইরে নিয়ে এসে একটা ছোট কলসি থেকে সামান্য জল মুখে–চোখে দেয়, তাতেই আমি সুস্থ হয়ে উঠি। ঐ জলটাকে তিনি বারবার ‘হোলি ওয়াটার’ বলছিলেন। জলের ভেতরে একটি প্রভু যিশুর ক্রশ ডোবানো ছিল। গাইডের মুখ থেকেই শুনি যে, ঠিক এখান থেকেই সবাই হারিয়ে যায়, মূলত এই শুক্রবারেই। উপন্যাসেও বলা ছিল ভ্যাম্প্যায়ার আসার আগে পচা গন্ধ ও সোঁদা সোঁদা গন্ধ পাওয়া যায়।
গাইডের একটি কথা আজও মনে পড়ে, ‘ভাগ্যি ভালো, আপনি আমাকে নীচের ঘরগুলো সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, যার জন্য আমি বিন্দুমাত্র সময় নষ্ট না করে আপনাকে দেখতে না পেয়ে এই হোলি কলসি নিয়ে বিদ্যুৎবেগে নীচে নেমে যাই।’
হয়তো তাই, প্রভু যিশুর দয়াতেই সেই যাত্রায় বেঁচে গিয়েছিলাম।
ছবি: লেখক ও আন্তর্জাল
Leave a Reply
Your email address will not be published. Required fields are marked *
Comments