ডাঃ বিধানচন্দ্র রায়
(১ জুলাই, ১৮৮২ — ১লা জুলাই, ১৯৬২)
এক অসামান্য ব্যক্তিত্ব
সুমন কল্যাণ চক্রবর্তী
যিনি একাধারে পশ্চিমবঙ্গের রূপকার তথা বাংলার দ্বিতীয় মুখ্যমন্ত্রী, সেই ধন্বন্তরী এবং ঈশ্বরিক ক্ষমতাশীল চিকিৎকই হলেন ডাঃ বিধানচন্দ্র রায়। এঁনার ঠাকুমা আদর করে নাম রেখেছিলেন ‘ভজন’। মা ছিলেন অঘোরকামিনী দেবী ও বাবা প্রকাশচন্দ্র রায়, যিনি কেশবচন্দ্র সেনের ‘নববিধান’ বই-এর দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে ছেলের নাম রাখেন ‘বিধান’। বিধানচন্দ্র রায় যখন খুব ছোট, তখন তাঁর মাতৃবিয়োগ হয়। পাটনার বাঁকিপুরে জন্ম হলেও পাটনা কলেজে অঙ্ক নিয়ে পড়াশোনো শেষ করে চলে আসেন কলকাতায়। কলকাতায় এসে শিবপুর ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে এবং কলকাতা মেডিক্যাল কলেজে ভর্তি হওয়ার জন্য একই সঙ্গে ফর্ম ফিলাপ করে জমা দেন। ডাক্তারির সুযোগ আগে আসায় ইঞ্জিনিয়ারি-এ আর ভর্তি হলেন না। সেই সময় কিছুদিন বিধানচন্দ্র রায় কলেজ স্ট্রিটের YMCA তে থাকতেন। মাঝে মধ্যে তিনি তার প্রফেসরদের সাহায্যে রোগীর বাড়িতে মেল নার্স হিসেবে আট টাকার পারিশ্রমিকে ১২ ঘণ্টার ডিউটিও করতেন। মোটরগাড়ি সম্বন্ধে ওনার প্রবল আগ্রহ ছিল বলে শোনা যায়। প্রথমদিকে মেডিক্যাল পড়ার সময় বিধানচন্দ্র রায় কলকাতায় পার্ট টাইম ট্যাক্সিও চালিয়েছিলেন। YMCA-এর পরে তিনি থাকতেন ৬৭/১, হ্যারিসন রোডে, সেখান থেকে ৮৪ নং হ্যারিসন রোডে (দিলখুস কেবিনের পাশে)। ১৯৬৬ সালের পর তিনি চলে আসেন ওয়েলিংটন স্ট্রিটের বাড়িতে, যেখানে তিনি পরবর্তীতে প্যাথোলজিক্যাল ল্যাবরেটরি স্থাপন করেছিলেন।
বিধানচন্দ্র রায়ের একটি বিশেষ প্রতিভা ছিল, যেটির নাম ‘ইনটুইশন’, অর্থাৎ আগে থাকতে রোগ সম্পর্কে ধারণা করা। রোগীর মুখ দেখে রোগ নির্ণয়ের মতো আশ্চর্য ক্ষমতা বিধানচন্দ্র রায়ের ন্যায় পৃথিবীতে খুব কম ডাক্তারেরই ছিল। মানুষের শরীর সম্পর্কে কী অসামান্য জ্ঞান থাকলে এই লেভেলের দক্ষতা থাকতে পারে, তা এই ডাক্তারকে না জানলে বোঝা যাবে না। মহাত্মা গান্ধী বিধান রায় সম্পর্কে বলেছিলেন, ‘বিধান দ্য গ্রেট সেফটি হ্যান্ড অফ ইন্ডিয়া’। জানা যায়, বিখ্যাত এই ডাক্তার একবার কলকাতা মেডিক্যাল কলেজে এম.মি পরীক্ষায় ফেল করেছিলেন, পরবর্তীতে আবার, সম্বল মাত্র ১২০০ টাকা নিয়ে বিলেত গিয়ে এমআরসিপি এবং এফআরসিএস পাশ করেন। বিলেত যাওয়ার আগে কলকাতায় ওঁনার ফি ছিল ২ টাকা। বিধানচন্দ্র রায়-এর পারসোন্যালিটি ছিল এক অন্য মাত্রার। আর এই পারসোন্যালিটির শক্তি উনি ৩ জন ব্যক্তির কাছ থেকে পেয়েছিলেন। প্রথমত, চিকিৎসার ক্ষেত্রে কর্ণেল লুকিস, যিনি ব্রিটিশদের সঙ্গে মাথা উঁচু করে কথা বলতে শিখিয়েছিলেন বিধানবাবুকে। দ্বিতীয়ত, রাজনীতিতে দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাস এবং শিক্ষার প্রসারের ক্ষেত্রে বাংলার বাঘ আশুতোষ মুখোপাধ্যায়। ভারতবর্ষের ইতিহাসের কঠিন সময়ে মাসে লক্ষ টাকারও বেশি উপার্যনের প্র্যাক্টিস ছেড়ে মানুষের সেবায় নিজেকে নিয়োজিত করেছিলেন যিনি, তিনিই এই ডাঃ বিধানচন্দ্র রায়। বিখ্যাত এই ডাক্তার প্রথমে কলকাতার মহানাগরিক এবং পরবর্তীতে বাংলার দ্বিতীয় মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে পরিচিত হন। মুখ্যমন্ত্রী হয়ে সল্টলেক, লেকটাউন, দামোদর ভ্যালি কর্পোরেশন, দুর্গাপুর, শকুন্তলা পার্ক, হরিণঘাটা দুগ্ধ প্রকল্প, কলকাতার মেট্রোরেল ছাড়াও স্টেশন থেকে বাজার, হলদিয়া বন্দর, ফারাক্কা ব্যারেজ, রাস্তাঘাট, সুন্দর সুন্দর বাড়ি, পানীয় জলের ব্যবস্থা, উদ্বাস্তুদের থাকার জায়গা প্রভৃতি তৈরি করেন। এছাড়াও উনি তৈরি করেছিলেন শিক্ষিত বেকারদের জন্য ‘কলকাতা রাষ্ট্রীয় সংস্থা’ এবং দার্জিলিং-এ ভারতের সর্বপ্রথম পর্বতারোহণ শিক্ষাকেন্দ্র। ডাঃ নীলরতন সরকারের মেয়ের সঙ্গে প্রেম থাকলেও সে বিয়ে কোনো কারণে হয়নি বিধাবাবুর। তাই ডাঃ বিধানচন্দ্র রায়, ডাঃ নীলরতন সরকারের মেয়ের নামটি স্মরণীয় রাখতে কলকাতা থেকে মাত্র ৫০ কিলোমিটার দূরে ‘কল্যাণী’ নাম স্থানটি তৈরি করে গেছেন।
দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাসের মৃত্যুর পর ডাঃ বিধানচন্দ্র রায় ওঁনার (চিত্তরঞ্জন দাস) একটি ছবির উপর কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কাছে গিয়ে একটি কবিতা লেখার জন্য অনুরোধ করেছিলেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ওই ছবির উপর লিখে দিয়েছিলেন, ‘এসেছিলে সাথে করে মৃত্যুহীন প্রাণ/ মরণে তাহাই তুমি করে গেলে দান।’ ১৯৪৮ সালে ডাক্তারির পেশা ছেড়ে মুখ্যমন্ত্রী হন তিনি। বিখ্যাত এই ডাক্তার বিধানচন্দ্র রায় প্রতি মাসে ৪২০০০ টাকা আয় করতেন বলে জানা যায়, যার বর্তমান বাজারে মূল্য ১,৩৭,৩৪০০০ টাকারও বেশি। আর ৬৫ বছরে মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পরে নিজের মাইনে নিজেই ঠিক করেছিলেন মাত্র ১৪০০ টাকা; ভাবা যায়! সত্যজিৎ রায়ের অসমাপ্ত সিনেমা ‘পথের পাঁচালী’ (বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় রচিত)-র জন্য সরকারিভাবে অনেক কষ্টে টাকা জোগাড় করে দেন বিধানবাবু, যে সিনেমাটি আজও বিশ্বে এক নামকরা চলচ্চিত্র। একবার তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় প্রমুখ লেখকদের বেশ কিছু বই নিষিদ্ধ করে লালবাজারের পুলিশ। বিধানবাবু ওই সব লেখকদের পাশে দাড়িয়ে নিষেধাজ্ঞা তুলে দিয়েছিলেন। ডাঃ বিধানচন্দ্র রায়ের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে কে.পি টমাস বলেছিলেন, ‘ডাঃ বিধানচন্দ্র রায় কোনোদিনই মদ্যপান বা ধূমপান করেননি।’ একবার এই কে.পি টমাস ডাঃ বিধানচন্দ্র রায়কে রাত নয়টা অবধি কাজ করতে দেখে বলেছিলেন, ‘আপনার কাজের একটা সীমা থাকা উচিত। আপনার পরিবার থাকলে ওনারা নিশ্চয়ই আপনাকে বিশ্রামের কথা বলতেন।’ উত্তরে ডাঃ বিধানচন্দ্র রায় বলেছিলেন, ‘আপনি হয়ত জানেন না কাজের সঙ্গেই আমার বিয়ে হয়েছে।’
একটি তথ্য থেকে জানা যায়, ডাঃ বিধানচন্দ্র রায় প্রতিদিন ভোর চারটের সময় ঘুম থেকে উঠে স্নান সেরে গীতা এবং ব্রহ্মস্তোত্র পাঠ করে ব্রেকফ্রাস্ট করতেন সাড়ে ছয়টায়। ব্রেকফ্রাস্টে খেতেন একটি টোস্ট (পাউরুটি), একটি ডিমসিদ্ধ, বেলের শরবত অথবা পাকা পেঁপে এবং একটু পরে এক কাপ চিনি ছাড়া কফি। তারপর প্রায় দুই ঘণ্টা সময় ধরে জনা ষোলো-কুড়ি রোগী দেখতেন সম্পূর্ণ বিনা পয়সায়, কিন্তু তার পার্সোন্যাল অ্যাসিসটেন্টদের মাইনে দিতেন নিজের ব্যক্তিগত পকেট থেকে। তারপর সকাল নয়টার মধ্যে সোজা রাইটার্স বিল্ডিং। মহাকরণে সকাল নয়টা থেকে দশটা পর্যন্ত জরুরি ফাইল দেখতেন। দশটার পরে সচিবদের সঙ্গে মিটিং কিংবা আলাপ-আলোচনা। সাড়ে বারোটা থেকে একটার মধ্যে দুপুরের খাওয়া ও তারপর সামান্য বিশ্রাম। তারপর আবার প্রশাসনিক কাজ। ডাঃ বিধানচন্দ্র রায় ওঁনার কর্মচারীদের সকাল ১১ টা থেকে বিকেল ৫ টা পর্যন্ত কাজকর্ম করতে নির্দেশ দিতেন। কিন্তু নিজে অফিস থেকে বেরোতেন যখন কাজ সেরে তখন প্রায় রাত ৮ টা হয়ে যেত। এরপর বাড়িতে গিয়ে স্নান সেরে রাতের খাবার খেয়ে মোটামুটি ১০ টার মধ্যে ঘুমিয়ে পড়তেন। যদিও তিনি সবার উদ্দেশ্যে বলতেন, ‘রাত নয়টার মধ্যে খেয়ে ঘুমিয়ে পড়াটা স্বাস্থ্যকর’।
ডাঃ বিধানচন্দ্র রায়ের নিজের বাসভবনের একটি ঘরে তিনি রোগী দেখতেন। ঘরের একটি প্রান্তে একটি চেয়ার থাকত। দরজা দিয়ে ঢুকে রোগীকে হেঁটে ডাক্তারবাবুর কাছে আসতে হত। ঘরে ঢুকে রোগীর ডাক্তারের সামনে হেঁটে আসতেই ডাঃ রায় রোগীকে পর্যবেক্ষণ করে প্রায় রোগ নির্ণয় করে ফেলতেন। ডাঃ বিধানচন্দ্র রায়ের চিকিৎসক হিসেবে অসংখ্য গল্পগাথা আজও মানুষের কাছে ছড়িয়ে আছে। বিখ্যাত এই ডাক্তারকে খুব কাছ থেকে আমার দাদুর সাক্ষাতের সুযোগ এসেছিল। বহু মজার ঘটনার মধ্যে আমার দাদু ‘লেট ডাঃ সুবোধ কুমার চক্রবর্তী’ কয়েকটি ঘটনা আমাকে বলেছেন। ঘটনাগুলি সংক্ষেপে ব্যক্ত করলাম—
১) আমেরিকার রাষ্ট্রপতি জে.এম কেনেডির পিঠের ব্যথা কিছুতেই যাচ্ছিল না। খবর শুনে ডাঃ বিধানচন্দ্র রায় সোজা আমেরিকায়। কিছুক্ষণ কথাবার্তা ও পর্যবেক্ষণ করে রোগটি ধরে ফেললেন ডাঃ রায়, যেটি বহু বড় বড় ডাক্তারও ঠিক ধরতে পারেননি সেই সময়ে। একমাসের একটি প্রেসক্রিপশন করে দিলেন কেনেডিকে। বাকরুদ্ধ কেনেডি জানতে চান, কী করে এটা সম্ভব হল? ডাঃ রায় বলেন, ‘স্যার, আই এম ডক্টর বাই প্রফেসন অ্যান্ড পলিটিক্স ইজ মাই প্যাসান’। মিটিং সেরে বেরেনোর সময় কেনেডির সঙ্গে করমর্দন করার সময় ডাঃ রায় বলেন, ‘আমার ফি টা দিলেন না তো স্যার?’ খুব লজ্জায় পড়ে কেনেডি বলেন, ‘বলুন কত ফি আপনার?’ উত্তরে ডাঃ রায় বলেন, ‘৩০০ কোটি টাকা, যেটি পশ্চিমবঙ্গের উন্নতির জন্য লাগবে।’ কিছুদিনের মধ্যে এই বিপুল পরিমাণ টাকা পেয়ে পশ্চিমবঙ্গের রাস্তাঘাট প্রভৃতি উন্নতি করেন ডাঃ রায়।
২) সাহিত্যিক সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায় ডাঃ রায় সম্পর্কে একটি ঘটনার উল্লেখ করেছিলেন। সঞ্জীববাবুর বাবার বন্ধুর মাথা ঘোরার রোগ অনেক দিন ধরে হচ্ছিল, কিছুতেই কমছিল না। অনেক ডাক্তার দেখিয়েছেন, কেউ বলেছেন স্পন্ডেলাইসিস কেউ বা ভার্টিগো। অবশেষে গেলেন ডাঃ রায়ের কাছে। ডাঃ রায় সবকিছু শুনে একটি কাগজে লিখে দিলেন, ‘রিভার্স ইয়োর হেড’। ওই ভদ্রলোক একটু ক্ষুন্ন হলেন এটা দেখে। এই প্রেসক্রিপশনটা সঞ্জীববাবুর বাবার বন্ধু, সঞ্জীববাবুর বাবাকে ধরিয়ে এর মানে জিজ্ঞাসা করেন। সঞ্জীববাবুর বাবার ওই প্রেসক্রিপশন নিয়ে পুনরায় পৌঁছালেন ডাঃ রায়ের কাছে, এর মানে বোঝার জন্য। উত্তরে ডাঃ রায় বলেন, ‘আমার ধারণা উনি রাতে উত্তর দিকে মাথা করে আর দক্ষিণ দিকে পা করে শোন। এর ফলে পৃথিবীর চৌম্বকক্ষেত্র বরাবর উনি চুম্বক শলাকার কাজ করেছেন যার প্রভাব ওনার মাথায় পড়েছে। তাই আমি ওনাকে উল্টো করে, অর্থাৎ দক্ষিণ দিকে মাথা আর উত্তর দিকে পা করে শোবার কথা বলেছি।’ ডাঃ রায়ের সেই আশ্চর্য প্রেসক্রিপশন-এ মাত্র তিনদিনেই ওই ভদ্রলোকের মাথা ঘোরা সম্পূর্ণভাবে উধাও হয়ে গেছিল।
৩) তিরিশের দশকে একবার কংগ্রেস করার অপরাধে ডাঃ রায় ব্রিটিশদের হাতে গ্রেপ্তার হয়েছিলেন। ওনাকে সাধারণ কয়েদিদের সঙ্গে না রেখে অন্য বিশেষ ব্যবস্থা করার কথা উঠলে ডাঃ রায় পরিষ্কার জানিয়ে দেন ওনাকে সাধারণ কয়েদিদের সঙ্গেই রাখতে হবে। সেইসময় চারিদিকে টাইফয়েড ও নিউমোনিয়ার প্রাদুর্ভাব চলছিল। জেলেও প্রায় কয়েদিরা মারা যাচ্ছিল সেই সময়ে। ডাঃ রায় নিজে জাতি ধর্ম নির্বিশেষে বিনা পারিশ্রমিকে জেলের কয়েদিদের জন্য দিন রাত সেবা করে তাদের সুস্থ করে তোলেন। ডাঃ রায়ের এক ভাইকে দিয়ে জেলের কয়েদিদের ওষুধ ব্যবস্থা করেন তিনি নিজের পকেটের পয়সা খরচ করে।
৪) ডাঃ বিধানচন্দ্র রায়ের কাছে একবার এক ভদ্রলোক ওনার সঙ্গে ওনার স্ত্রীকে নিয়ে এসেছেন। বহু ডাক্তার দেখিয়েও ওই মহিলার কোনো উন্নতি হয়নি। ডাঃ রায় তার নিজের ঘরে ঐ মহিলাকে দেখেই বলেন, ‘আপনি ২৪ ঘণ্টাই মাথার যন্ত্রণায় কষ্ট পাচ্ছেন বলে মনে হচ্ছে? আলোর দিকে তাকাতে কষ্ট হয়?’ কথাগুলো শুনে ওই মহিলা মাথা নাড়েন ‘হ্যাঁ’ বলে। ডাঃ রায় বলেন, আপনি যে সিঁদুরটা ব্যবহার করেন, সেটার বিষক্রিয়ায় এটা হয়েছে। সিঁদুরটা পাল্টে ফেলবেন আর ভালো সিঁদুর বাজার থেকে কিনে লাগাবেন। সিঁদুর পাল্টাতেই ওই মহিলা একেবারে ফিট।
৫) মেডিক্যাল ছাত্র থাকাকালিন একবার বিধানচন্দ্র রায় অপারেশনের এক রোগীকে দেখে বলেছিলেন, ‘যে স্যার এই অপারেশন করবেন তিনি সম্ভবত ভুল জায়গায় অপারেশন করবেন।’ পরে সেটাই সত্যি হয়েছিল। অপারেশনের ওই ডাক্তার বিধানচন্দ্র রায়কে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, ‘তুমি কিভাবে এটা বুঝতে পেরেছিলে যেটা আমি পারিনি?’ বিধানচন্দ্র রায় বলেছিলেন, ‘এটি আমি আমার ইনটুইশান থেকে বলেছিলাম।’
৬) একবার রাইটার্সের এক চতুর্থশ্রেণীর কর্মচারী (সাফাইকর্মী)-র কাশি দূর থেকে শুনে ডাঃ রায় নিজের গাড়িতে করে যাদবপুর টিবি হসপিটালে পাঠানোর ব্যবস্থা করেন ওই কর্মচারীকে। ডাঃ রায় তখনই বলেছিলেন, ‘এর নাম গ্যালপিং টিবি’। পরে হসপিটালের রিপোর্টেও সেটাই পাওয়া যায়। কাশির আওয়াজ শুনে রোগ নির্ণয় করার এক আশ্চর্য প্রতিভা ছিল ডাঃ রায়ের। বিধানবাবু নিজে ওই কর্মচারীর ‘লিভ উইথ ফুল পে’, ওর ফাইলে লিখে নিজে থেকে ছুটি মঞ্জুর করে দিয়েছিলেন।
৭) একবার খুব ভোরে এক ভদ্রলোক ডাঃ রায়ের কাছে এসে বলল তার ছেলের টিবি হয়েছে। আপনাকে একবার আসতে হবে। ডাঃ রায় ওই লোকটির বাড়িতে সিঁড়ি দিয়ে দোতলায় উঠতে উঠতে ছেলেটির কাশির আওয়াজ শুনতে পেলেন। সেই কাশির আওয়াজ শুনেই ডাঃ রায় উপরে আর না গিয়ে সোজা সিঁড়ি দিয়ে নীচে নেমে গেলেন। যাওয়ার সময় ওই লোকটিকে বলে গেলেন, ‘ছেলেকে দেখে লাভ হবে না, ছেলেটি যে গরুর দুধ খায়, সেই গরুর টিবি হয়েছে। আর আপনার ছেলের কাশিটা সাধারণ ঠান্ডা লেগে হয়েছে, আমি ওষুধ দিয়ে দিচ্ছি, ঠিক হয়ে যাবে।’ আশ্চর্য, ছেলেটি কয়েকদিন পরে ডাঃ রায়ের প্রেসক্রিপশনে একদম ঠিক হয়ে যায়।
৮) অস্ট্রিয়ার ভিয়েনাতে চোখ অপারেশন করতে গেছেন ডাঃ রায়। অপারেশন টেবিলে শোওয়ানো অবস্থায় সেখানে উপস্থিত কয়েকজন ডাক্তারের মধ্যে একজন হঠাৎ কেশে উঠলেন। ডাঃ রায় চোখ বোজা অবস্থায় জিজ্ঞাসা করলেন, ‘কে কাশলো?’ উত্তরে এক ডাক্তার বললেন, ‘আমাদের একজন সহকর্মী ডাক্তার স্যার।’ ডাঃ রায় তৎক্ষণাত বললেন, ‘ওনার চেস্ট এক্স রে করান, ওনার টিবি হয়েছে।’ সবাই হতবাক! ডাঃ রায় কিভাবে এটা বুঝলেন। পরে ওই ডাক্তারের চেস্ট এক্স রে-তে টিবি ধরা পড়ে।
৯) ডাঃ রায় চেষ্টা করতেন, যতটা সম্ভব কম অ্যালোপ্যাথি ওষুধ ব্যবহার করে প্রাকৃতিক ভেষজ উপাদান ব্যবহার করতে। ফলের মধ্যে পেয়ারা (আপেলের পরিবর্তে), পেঁপে, পাকা বেল প্রভৃতি বেশি খেতে বলতেন গরীবদের। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ম্যালেরিয়ার ঔষধ ‘কুইনাইন’ একসময়ে বাজারে পাওয়া যাচ্ছিল না। বিকল্প ব্যবস্থা হিসেবে ডাঃ রায় ছাতিম গাছের পাতা থেকে বড়ি তৈরি করেন, যা সেইসময়ে ‘কুইনাইন’-এর পরিপূরক হিসেবে কাজ করেছিল। একথা হয়ত অনেকেরই অজানা।
১০) এক জমিদারের এক পুত্রবধূ লুকিয়ে তামাক সেবন (ধূমপান) করতেন বিয়ের আগে। বিয়ের পর দীর্ঘদিন তামাক সেবন না করার ফলে সেই বউ তার শ্বশুরবাড়িতে অসুস্থ হয়ে পড়ে। কিন্তু বউটি লজ্জায় কাউকে কিছু বলতে পারে না। অনেক ডাক্তার দেখিয়েও কোনো ফল হয়নি। অগত্যা ওনারা ঠিক করলেন, ডাঃ রায়কে দেখাবেন। ডাঃ রায় তখন শিলংয়ে। ডাঃ রায়কে ওই বউটি একাঘরে সবকিছু খুলে বললেন। শুনে বিধানবাবু বউয়ের শ্বশুরবাড়ির লোকদের বললেন, ‘আপনাদের পূত্রবধূর যে রোগ হয়েছে, সেটা সারাতে হলে ওকে একমাস গড়গড়ার তামাক সেবন করতে দিতে হবে, তারপর দুইদিন অন্তর একবার। ডাঃ রায়ের এই প্রেসক্রিপশনের পরে ওই বউটি আস্তে আস্তে সুস্থ হয়ে উঠেছিল।
সাধারণ মানুষের মতন সর্দি কাশি ও টুকটাক পেটের রোগে ভুগলেও জানা যায়, ডাঃ বিধানচন্দ্র রায়ের প্রথম হার্ট অ্যাটাক হয়েছিল ১৯৩০ সালে যখন তিনি কংগ্রেসের কাজে আমেদাবাদ থেকে দিল্লি আসছিলেন। তারপর অতিরিক্ত কাজের চাপের জন্য দ্বিতীয় হার্ট অ্যাটাক হয়, যখন তিনি পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী। ২৪ জুন, ১৯৬২ তিনি শেষ বারের মত মহাকরণে গেছিলেন বলে জানা যায়। দক্ষিণ ২৪ পরগণা জেলার জয়নগরের নিমপীঠের আশ্রমের একজন সন্ন্যাসী সেদিন রাইটার্স-এ গেছিলেন ওঁনার সঙ্গে দেখা করার জন্য। ওই সন্ন্যাসীকে ডাঃ বিধানচন্দ্র রায় তীব্র মাথা যন্ত্রণা নিয়ে বলেছিলেন, ‘শরীর যেমন ঠেকছে, কাল নাও আসতে পারি।’ ডাক্তার শৈলেন সেন ও ডাক্তার যোগেশ বন্দ্যোপাধ্যায়-এর কথা অনুযায়ী, ২৫ জুন, ১৯৬২, ডাক্তার রায়ের হার্ট অ্যাটাক হয়। নিজের বাড়িতে ডাক্তার রায়ের এক বিশিষ্ট বন্ধু সার্জেন ললিতমোহন বন্দ্যোপাধ্যায় হার্ট অ্যাটাকের দিন থেকে ওঁনার পাশেই ছিলেন। ১ জুলাই, ১৯৬২ পরিচারক কৃত্তিবাসের হাত থেকে এক গ্লাস মুসুম্বির রস খান ডাক্তার রায়। বাড়িতে সেই মুহূর্তে উপস্থিত সবাইকে ডাক্তার রায় বললেন, ‘আমি দীর্ঘ জীবন বেঁচেছি। জীবনের সব কাজ আমি সমাধা করেছি। আমার আর কিছু করার নেই।’ আস্তে আস্তে ওঁনার পা ঠান্ডা হয়ে আসতে থাকে, ঢলে পড়েন মৃত্যুর কোলে। কেওড়াতলা শ্মশানের বৈদ্যুতিক চুল্লির সূচনা ডাঃ বিধানচন্দ্র রায়ই করেছিলেন। চুল্লির সূচনার সময় ডাঃ বিধানচন্দ্র রায় বলেছিলেন, ‘ওহে আমাকে এই ইলেকট্রিক চুল্লিতে পোড়াবে। তাই ডাক্তার রায়ের কথামতো ২ জুলাই, ১৯৬২, ওঁনাকে ওই চুল্লিতেই পোড়ানো হয়েছিল। উনি নিজের বাড়িটি ওঁনার মৃত্যুর পর দান করে গেছিলেন, যেটি ওনার মায়ের নামে একটি নার্সিংহোমে পরিণত হয়েছে। অনেকের মতে, ডাক্তার রায় যদি বাংলার মুখ্যমন্ত্রী না হতেন, তাহলে ইতিহাস হয়ত অন্য পথে হাঁটত সে ব্যাপারে নিশ্চিৎ। বহুমুখী সক্রিয় ব্যক্তি হিসেবে নতুন নতুন প্রকল্পের রূপায়ন তিনি নিজের হাতে করে গেছেন, রেখে গেছেন এক অনন্য আবদান।
সময় নষ্ট না করা, সঠিক জায়গায় সঠিক পরিশ্রম, সততা ও অমায়িক ব্যবহারের মানুষ ডাঃ বিধানচন্দ্র রায় দুটি কথা বলতেন, ‘তোমার সাধ্যমত চেষ্টা করে যাও আর বাকিটা ভগবানের উপর ছেড়ে দাও। কিংবা ‘হাত গুটিয়ে বসে থাকার চেয়ে চেষ্টা করে হেরে যাওয়া অনেক ভালো।’ নিজের বাবা-মা-র কাছ থেকে ডাঃ বিধানচন্দ্র রায় শিখেছিলেন, ‘নিঃস্বার্থে সেবা করা ও পরাজয় না মেনে নেওয়া’-র মতো গুরুত্বপূর্ণ দুটি বিষয়। ডাঃ বিধানচন্দ্র রায়ের অসামান্য কৃতিত্ত্বের জন্য ওঁনাকে ৪ ফেব্রুয়ারি, ১৯৬১ ‘ভারত রত্ন’ সম্মান প্রদান করা হয়। অথচ, এই মানুষটির প্রতি একসময়ে কুৎসিত গালাগালি, অপমান, বাড়িতে আগুন ধরিয়েও দিয়েছিল নিন্দুকেরা। যিনি দেশ ও জনগণের স্বার্থে নিজের ব্যক্তিগত সম্পত্তি বিক্রি করেছেন, তাঁকে চোরও বলা হয়েছে, সরকারকে ঠকিয়েছেও বলা হয়েছে। ডাক্তার রায় একবার নিন্দুকদের উদ্দেশ্যে বলেছিলেন, ‘আমি যখন মরব তখন তোমরাই বলবে, লোকটা ভালো ছিল গো, আরও কিছুদিন বাঁচলে পারত।’
জানা যায়, কলকাতা শহরে যখন তিনি প্রথম আসেন, তখন তাঁর হাতে ছিল পাঁচ টাকা পঁচিশ পয়সা। তাঁর মৃত্যুর পর মুখ্যমন্ত্রীর ঘরে পাওয়া যায় এগারো টাকা পঁচিশ পয়সা। সুতরাং সারাজীবন ওঁনার সঞ্চয়ের পরিমাণ ছিল মোট ছয় টাকা। আর তার সঙ্গে ছিল কোটি কোটি মানুষের ভালোবাসা, শ্রদ্ধা ও আশীর্বাদ; তা না হলে তিনি কি আর মানুষের মনে আজও পাকাপাকিভাবে স্থান করে নিতে পারতেন?
Leave a Reply
Your email address will not be published. Required fields are marked *
Comments