বাইকে দার্জিলিং ভ্রমণ
অর্ণব আদক

ভ্রমণ পিপাসু বাঙালির ভ্রমণের নেশা খানিকটা মেটে ভ্রমণ গাইড বুক থেকে। তবে বাইকে দার্জিলিং ভ্রমণের কোনো নিদর্শন/হদিস ওই গাইড বুকে আছে কিনা জানি না। এক রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা হয়েছিল আমার এবারের দার্জিলিং ভ্রমণে, অবশ্যই বাইকে চেপে। 
ডাক্তারি পড়া শুরুর আগে এই পেশায় যুক্ত মানুষদের নিয়ে সাধারণ জনমানসে যে ধারণা বিরাজমান সেটা তখন আজকের মত পরিষ্কার ছিল না। বিজ্ঞান পড়ার সহজাত আকর্ষণে এবং সেই সুবাদে জীবজগৎ, বিশেষ ভাবে মানুষের প্রতি আগ্রহ বাড়ে। মানুষের শরীর সম্বন্ধে জ্ঞানার্জন আর রোগ মুক্তির মাধ্যমে যন্ত্রণা মুক্ত করার অভিপ্রায়— এই বিষয়ে পড়াশোনা করার ইচ্ছাকে প্রবল করে তোলে। এই কাজের দায়িত্ব ভালোভাবে পালনের জন্য ব্যস্ততা সম্বন্ধে তখন কোনো ধারণাই ছিলনা। এখন অনুধাবন করতে পারছি আর অভ্যস্ত হয়ে সঠিকভাবে চলার চেষ্টায় আছি।

এমবিবিএস পাস করার পর পরই পোস্টগ্র্যাজুয়েটে ভর্তি হয়েছি। প্রথমদিন থেকেই বিশাল কাজের চাপ। শুনছি নাকি ৩৬৫ দিনই কাজ— কোনো ছুটি নেই। তার উপর বর্তমান পরিবেশ ও পরিস্থিতিতে আমরা আরও জেরবার হয়ে উঠি। রুগী নিয়েই আমাদের দিনরাতের ২৪ ঘণ্টা কেটে যায়– দিনরাতের বিশেষ পার্থক্য বুঝতে পারি না। রুগীদের সুস্থ করার জন্য আমাদের স্বাভাবিক থাকা দরকার। অনেক সময় কাজের চাপ এত বেশি হয় যে ব্রেন কাজ করে না। চায় একটু বিশ্রাম। পরিশ্রান্ত হলে সুযোগ বের করে একটু ঘুমিয়ে নিই আমরা।
এই সময়ে নর্থ বেঙ্গলে একটা সেমিনারে যাওয়ার সুযোগ এল। প্রথমে যেতে ইচ্ছা না থাকলেও পরে যাওয়া ঠিক করি। সঙ্গে পেলাম আমার সিনিয়র এক পিজিটি দাদাকে। ইন্টারনেটে টিকিট কাটতে গিয়ে দেখি রিজার্ভেশনের জন্য কোনো সিট খালি নেই। অগত্যা তৎকালের দ্বারস্থ। এজেন্ট মারফৎ দার্জিলিং মেলের দুটি টিকিট পাওয়া গেল। সামান্য কিছু গোছগাছ করে দার্জিলিং মেলে চেপে পড়লাম। ঠিকমত শীতবস্ত্র, দস্তানা নেওয়া হল না। আমাদের নির্দিষ্ট কোনো প্ল্যানও ছিল না। মনে মনে ইচ্ছা ছিল সেমিনারের সঙ্গে দু’একটা জায়গা বেড়িয়ে আসব। তাই সঙ্গে করে ইন্টারনেট সংযোগের যন্ত্রটা নিতে ভুলিনি। ট্রেনে বসে গরুমারা, জলদাপাড়া, ডুয়ার্স, দার্জিলিং প্রভৃতি দর্শনীয় স্থানগুলির খোঁজ খবর করছিলাম। কিন্তু প্রথম কাজ তো সেমিনারের জায়গায় পৌঁছানো আর রাত কাটানোর জন্য আর একটা হোটেল বুকিং করা। স্নান ও খাওয়া সেরে নিলাম ওই হোটেলে। বন্ধু দাদাটি বাইকে চেপে ঘুরতে চায়। গোয়ার মত বাইকে চেপে ঘুরে বেড়ানোর চল এখানে নেই। বাইক ভাড়াও মেলে না এখানে।

পাহাড়ি পথে চালানোও ঝুঁকির, বিপদ সংকুলও। কিন্তু দাদার প্রবল ইচ্ছাকে প্রাধান্য দিতে এদিক ওদিক বাইকের খোঁজ করা হল। একটা বাইক জোগাড়ও হল। এক ব্যক্তি বেশ কিছু টাকা গচ্ছিত রেখে বাইকটা ব্যবহার করতে দিল ক’দিনের জন্য। খুশি হয়ে বাইক নিয়ে আমরা রওনা দিলাম গরুমারা অভয়ারণ্যের দিকে। জঙ্গল ভ্রমণের অনুমতি পেতে যেতে হল লাটাগুড়ি। এটা বন বিভাগের ইন্টারপ্রিটেশন কেন্দ্র। লাটাগুড়ি ডুয়ার্সের এক রূপসী কন্যা, আরণ্যক শোভা অতীব মনোরম। এই রূপের খোঁজে বনচরেরা বিহারে বের হয়। এখানে এলিফ্যান্ট জঙ্গল সফেরির সুযোগ এল। টিকিট কেটে গাইড নিয়ে জিপে চড়ে জঙ্গলের ভিতরে কিছুটা ঢুকলাম। অনেক জিপ দাঁড়িয়ে আছে দেখে আমরা দাঁড়িয়ে পড়লাম, হাতির দল বাচ্চাদের নিয়ে কীভাবে রাস্তা পার হয় তা দেখার জন্য। এই হাতির দলে দু’টি বাচ্চা হাতিও ছিল। শুনেছি মানুষের মতো ওরা খুব সন্তান বৎসল। বাচ্চাদের নিরাপত্তার জন্য ওরা খুবই তৎপর। জিপের পর জিপ দাঁড়িয়ে থাকা রাস্তায় না গিয়ে ওরা পিছনের পথ ধরল। বড় হাতিরা বাচ্চাদের আড়াল করে এগিয়ে চলল। ওদের ওই দলবদ্ধ ভাবে সন্তান স্নেহের দৃশ্য কিছুটা ক্যামেরা বন্দি করা গেল। তবে ছবি তোলাই সব কথা নয়— এ এক বিশেষ ধরণের অনুভূতি/ উপলব্ধি যা ভাষায় বর্ণনা করা যায় না। এত সুন্দর দৃশ্য মনের মধ্যে এমন তোলপাড় করছিল যে গরুমারা গিয়ে আর হাতি দেখার ইচ্ছা তেমন রইল না। তবে হাতির পিঠে চড়ে জঙ্গল ঘোরার সখ হল। তাই আমাদের বাইক ছুটল জলদাপাড়ার দিকে। পথের দু’পাশে বুক উঁচু ঢেউ তোলা বিস্তীর্ণ চা বাগিচা। চলার পথে এও এক নয়ন লোভন দৃশ্য। শাল, খয়ের, শিশুর গহন অরণ্যের মধ্য দিয়ে আমরা পৌঁছালাম হলং ডাক

বাংলোয়। পাশ দিয়ে বয়ে চলেছে পাহাড়ি নদী তোর্সা ও মালঙ্গী। নদী পারে সল্টলিক— বন্যপ্রাণীরা আসে নুন ও জল খেতে। এই বাংলো থেকে রাত্রে একশৃঙ্গী গণ্ডার, লেপার্ড, বন্য হাতি আর নানা প্রজাতির হরিণ দেখা যায়। এই হলং বাংলোয় আমাদের থাকার জন্য কোনো ঘর খালি পাওয়া গেল না। সন্ধ্যা হয়ে গেছে, ফেরা অসম্ভব। একব্যক্তির কাছ থেকে জানা গেল টুরিস্ট বাংলোয় রাতের আস্তানা মিলতে পারে। বাইক রেখে টুরিস্ট বাংলোয় গেলাম। একটা ঘর মিলল তবে ফোনে যোগাযোগের কোনো ব্যবস্থা নেই। এখানেই হাতির পিঠে চড়ার টিকিট কাটতে হয়। সেইমত পরদিন সকালের জন্য হাতির পিঠে চেপে জঙ্গল ঘোরার ব্যবস্থা হল। পরদিন মাহুত সহ পাঁচজন হাতির পিঠে চেপে বসলাম জঙ্গল আর তার রূপ দর্শণের জন্য। কখনও রাস্তায়, কখনও বনের মধ্য দিয়ে হাতি চলতে থাকল। আমরাও গাছের ডাল সরিয়ে সরিয়ে হাতির পিঠে চেপে বন বিচরণ করতে থাকলাম। এভাবে দেড় ঘণ্টা কখন যে পার হয়ে গেল টের পেলাম না। পথে একশৃঙ্গী গণ্ডার ছাড়া বিশেষ কোনো জন্তু চোখে পড়ল না, তবে বন পরিদর্শনের মধ্য দিয়ে বিশেষ এক রোমাঞ্চের অনুভূতি পেলাম। 

এই সফর শেষ করে দ্রুত বাইক নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম আমরা সেমিনারের উদ্দেশ্যে। মাত্র দু’ঘণ্টা সময় নিল ১৪৫ কিমি পথ যেতে। সেমিনার কক্ষে প্রবেশ করে দেখি বিভিন্ন মেডিক্যাল কলেজ থেকে আসা প্রফেসর মহোদয়গণ একে একে বক্তব্য রেখে চলেছেন পাওয়ার পয়েন্ট প্রেজেন্টেশনের মতো আধুনিক সব ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে। আমি খুব মন দিয়ে শিক্ষামূলক বক্তব্যগুলি শুনলাম। সেমিনার শেষে হোটেলে ডিনার সেরে ঘুমিয়ে পড়লাম। পরের দিনের অভিজ্ঞতা সম্পূর্ণ ভিন্ন ধরণের। অপারেশন হচ্ছিল ওটি-তে, তা সরাসরি প্রোজেক্টর স্ক্রিনে দেখানো হচ্ছিল, চলল দুপুরের লাঞ্চ ব্রেক পর্যন্ত। দিনের দ্বিতীয় ভাগে ছিল পোস্টার প্রেজেন্টেশন পর্ব। আমাদের কোনো পোস্টার ছিল না।

এই ফাঁকে আবার আমরা দু’জনে ওই বাইকে চেপে দার্জিলিং ঘোরার প্ল্যান করলাম। পাহাড়ি উঁচু খাড়াই পথে বাইকে চড়ার কোনো অভিজ্ঞতা ছিল না, তবুও দাদার সাহস ও টাইগার হিলের আকর্ষণ আমাদেরকে টেনে নিয়ে চলল। আমরা টয় ট্রেনের পথ ধরে চলতে শুরু করলাম। সে আর এক রোমাঞ্চকর অনুভূতি। আঁকা বাঁকা পথে যে কোনো সময়ে খাদে পড়ে যাওয়ার ভয়কে সামলে, সাহস অবলম্বনে অতি সন্তর্পনে দাদা বাইক চালিয়ে চলেছে আর আমি তার সহযাত্রী, পিছনের আরোহী ভয় মিশ্রিত চোখে দেখে চলেছি প্রকৃতির অপরূপ শোভা। কার্শিয়াং স্টেশন পৌঁছাতেই সন্ধ্যা নেমে এল। পাহাড়ি পথে রাতে বাইক চালানো উচিত হবে না। তাই এই শহরের একটা হোটেলে রাত কাটালাম। এটি একটি পরিচ্ছন্ন নিরালাশহর, মিলিটারি ক্যাম্পও আছে। পাইন, বার্চ ও ফার-এ ছাওয়া এই শহর। ফুলের বাহারও আছে শুনেছি, তবে রাতের অন্ধকারে দেখা যায়নি। পরদিন সকালে উঠে দার্জিলিং-এর উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম। ক্রমশ ঠান্ডা বাড়ছে, পাহাড়ের উচ্চতাও বাড়ছে— দস্তানা/ গ্লাভস ছাড়াই চালাতে হচ্ছে গাড়ি। দিনটা রৌদ্রজ্জ্বল বলে একটু কম অসুবিধা হয়েছে। দাদা স্থিরচিত্তে বাইক কন্ট্রোল করে এগিয়ে চলেছে— শিক্ষা নেওয়ার মতো। গতি বাড়াচ্ছে, মোড় ঘোরার সময় অদ্ভূত ভাবে নিয়ন্ত্রণ করে চলেছে। বুঝলাম দাদা শুধু বাইক চালাতে ভালবাসে— এমন নয়, বাইক চালানোয় সুনিপুণ। মোটরগাড়ি বা টয়ট্রেনে চড়ে দার্জিলিং আসা যায় কিন্তু বাইকে চেপে আসা— আমার এ এক নতুন অভিজ্ঞতা। শুধু অভিজ্ঞতা বললে ভুল হবে— এ আমার নতুন করে এক সাহস অর্জন।

দার্জিলিং পৌঁছে একটা গাড়ি বুক করলাম সারাদিনের জন্য। ওই গাড়িটাই পরের দিন টাইগার হিলে নিয়ে যাবে। ছোট্ট শহরে রক গার্ডেন, চিড়িয়াখানা দেখে ফিরে এলাম ম্যালে। এরই পাশে তেনজিং নোরগে রক, প্রায় ৬০ ফুট উঁচু। দড়ি ধরে চূড়ায় ওঠা যায়, তবে নামাটা বড় বিপদজনক। পিছলে পড়ার সমস্যা, তবুও রক ক্লাইম্বিং করলাম। একটা নতুন সিনেমা হল হয়েছে— আইনক্স, এখানে একটা মুভি (ছবির নাম নির্জা ) দেখে নিলাম। 
পরের দিন ভোর চারটেয় গাড়ি এল, ২৫৯০ ফুট  উঁচু টাইগার হিল দর্শনের জন্য। উদিত সূর্যের আলোর ডোরাকাটা বিচ্ছুরণ থেকেই এই নাম। গাড়ি চলছে সাঁ সাঁ করে, ভীষণ চড়াই পথ। কিছুক্ষণ পর দেখা গেল রাস্তার দু’ধারে কেবল জঙ্গল। টাইগার হিলে পৌঁছে টিকিট কেটে সানরাইজের জন্য অপেক্ষা করতে হল।  তখনও সূর্যোদয় হয়নি, তবে সারা আকাশ লাল টুকটুকে হয়ে উঠেছে। যেন বালতি বালতি লাল রং ঢালা হয়েছে সারা আকাশের গায়ে। প্রচুর মানুষের সমাগম হয়েছে। শরীর শিউরে ওঠা ঠান্ডায় মানুষের দল ক্যামেরা হাতে রুদ্ধশ্বাসে তাকিয়ে  আছে পাহড়ের কিনারের দিকে। অগাধ বিস্ময়ে প্রথম লক্ষ্য করলাম একটি সরু লাল রেখা। তারপর একটু একটু করে বাড়তে লাগল সেটি। অন্ধকার পাহাড়ের কোল থেকে লাল টকটকে একটা আগুনের গোলা উঠছে ধীরে ধীরে। উন্নত মস্তক সম্রাট কাঙ্গনজঙ্ঘার রূপ মুহূর্তে মুহূর্তে পরিবর্তিত হচ্ছে। লাল আকাশের প্রতিফলন এসে পড়ছে ওর গায়ে। প্রথমে গোলাপী তারপর লাল, পরেই কমলা। একটু পরেই তার সঙ্গে মিশে গেল ডিমের কুসুমের রংটা। কী ঝকঝকে, কী চমৎকার! খানিকপরেই পাহাড়ের কোল ছেড়ে আকাশে উঠে এল সূর্য, তার নিজস্ব তেজ নিয়ে। 

এবার ফেরার পালা। ‘Nature is the King’। প্রকৃতির সৃষ্ট সৌন্দর্যের কাছে মানুষের বানানো কোনো কিছুই বেশি সুন্দর হতে পারে না। এই প্রাকৃতিক সৌন্দর্যই আমাকে কর্মযোগে অনুপ্রাণিত করল। দার্জিলিং মেলে ফেরার পথে আগামী কাজের পরিকল্পনা করতে থাকলাম— যাতে রুগীদের ঠিকমত সেবা করতে পারি আর প্রয়োজনীয় পড়াশোনাটাও চালিয়ে যেতে পারি।

সব ছবি:‌ লেখক‌

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *