মহাসঙ্কটের আবর্তে আমাদের শিক্ষা
ডঃ সঞ্জীব রায়
অনেকেই মনে করছেন যে অতিমারির প্রভাবে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে পর্যটনশিল্প। সন্দেহ নেই পর্যটন শিল্পের সঙ্গে জড়িত লোকজন নিশ্চিতভাবেই আজ এক সঙ্কটের মধ্যে। তবে আশা করা যায় যে অতিমারির প্রভাব আরও খানিক কমলে তাদের সুদিন কিছুটা ফিরবে। যথার্থই গভীর সঙ্কটে আজ আমাদের শিক্ষাক্ষেত্র। সেখানে যে পরিমাণ ঘন কালো মেঘ ছেয়ে রয়েছে তা থেকে উদ্ধার পাওয়া কি আদৌ সম্ভব হবে?
অতিমারি আবহে পৃথিবীর সবাই অল্পবিস্তর ক্ষতিগ্রস্ত। অনেকে চাকরি হারিয়েছেন, অনেকের আয় কমেছে, অনেকের ব্যবসা তেমনভাবে লাভের মুখ দেখছে না। এই প্রসঙ্গ নিয়ে ট্রেনে, বাসে কথা কমই শোনা যায়, কারণ লোকে আজকাল কথা কমই বলে, সারাক্ষণ মোবাইলে ডুবে থাকে। হ্যাঁ, কদাচিৎ স্কুল সম্পর্কে কথা শুনেছি তবে কোনওটাই গঠনমূলক নয়। যেমন ‘ছোঁড়াগুলো গোল্লায় গেল’, ‘মাস্টাররাই ভালো আছে’, ‘প্রাইভেট পড়ানো রমরমিয়ে চলছে’ ইত্যাদি। বলা বাহুল্য যে, প্রকৃত সমস্যা নিয়ে আমরা ভাবি না কারণ আমরা রাজনীতি সচেতন নাগরিক। রাজনীতি সম্পর্কীয় কথা আলোচনা করতেই অধিকতর স্বচ্ছন্দ বোধ করি।
অতিমারি শুরু হবার বছর খানেক পর একটি শিক্ষাবর্ষ শেষ অর্থাৎ ২০২১ সালের গোড়ায় বিশ্বব্যাঙ্কের সহায়তায় ইউনেস্কো এবং ইউনিসেফ যৌথভাবে একটি রিপোর্ট বের করে। গবেষণার নামকরণ করা হয়েছিল ‘দ্যা স্টেট অফ দ্যা গ্লোবাল এডুকেশন ক্রাইসিস’ অর্থাৎ বিশ্বব্যাপী শিক্ষাব্যবস্থার দুর্ভোগ। রিপোর্টে দেখা যায় বিশ্বব্যাপী অতিমারির প্রভাবে প্রভাবিত হয়েছে ১৬০ কোটি স্কুল পড়ুয়া। দুর্ভাগ্যবশত তাদের মধ্যে ১৩০ কোটির বাড়িতেই কোনও ইন্টারনেট নেই। এই রিপোর্টের কিছুদিন পরে (অক্টোবর ’২১) ইউনেস্কো এবং ইউনিসেফ যৌথভাবে শুধুমাত্র ভারতের অবস্থা যাচাই করার অভিপ্রায়ে এককভাবে শুধু ভারতের উপর একটি রিপোর্ট তৈরি করে (ইন্ডিয়া কেস স্টাডি)। এই রিপোর্ট অনুসারে ভারতের দুই-তৃতীয়াংশ স্কুল পড়ুয়া হোয়াটস অ্যাপ বা ই-মেলে পাওয়া শিক্ষা থেকে কোনওভাবেই উপকৃত হয়নি। এই বিপুল সংখ্যক ছাত্রছাত্রীদের কাছে অনলাইন বার্তা পৌঁছনোর ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় প্রতিবন্ধকতা ছিল তাদের অভিভাবকদের আর্থিক অনটনের সঙ্গে ছেলেমেয়েদের যথাযথভাবে অনলাইন চালোনা করার মতো শিক্ষার অভাব।
এই রিপোর্ট সম্পর্কে আরও একটি কথা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ যে, এই রিপোর্টকে অবলম্বন করে যদি আমরা পূর্ণাঙ্গ চিত্রটিকে ভেবে নিই তাহলে মস্ত বড় ভুল হবে কারণ ইউনেস্কোর রিপোর্ট মূলত একটি শিক্ষাবর্ষের ক্ষতির ভিত্তিতে, কিন্তু বাস্তবে ক্ষতি হয়েছে দু-দুটি শিক্ষাবর্ষের। অতএব নিশ্চিতভাবেই ক্ষতির পরিমাণ অনেক বেশি হবে। অতি সম্প্রতি ইউনেস্কো আরেকটি রিপোর্ট প্রকাশ করে। সেখানে বলা হচ্ছে যে, বিশ্ব করোনা পরিস্থিতিতে পঠনপাঠন বন্ধ থাকায় ক্ষতি হয়েছে ১৭ লক্ষ কোটি ডলার। ক্ষতিটা কেন? অতি সহজ করে বলতে গেলে বলতে হয় এই প্রজন্মের ছাত্রছাত্রীরা ওই টাকা রোজগার করতে ব্যর্থ হবে এবং ওই ব্যর্থ হওয়াতে গোটা পৃথিবীর জিডিপি-তে ক্ষতি হবে ১৪ শতাংশ। তাদের স্টাডিতে ‘Path to recovery’ নামক শব্দ বসিয়ে বিস্তারিত গবেষণা চালানো হয়। সেই গবেষণা বলছে, যে এই ১৪ শতাংশ ক্ষতির হাত থেকে নিস্কৃতি পেতে হলে অবিলম্বে ১০ লক্ষ কোটি ডলার বিনিয়োগ প্রয়োজন। মূল সমস্যা হচ্ছে ভারত-সহ বিশ্বের অধিকাংশ দেশই শিক্ষাক্ষেত্রে ব্যয় বরাদ্দ করার অনুমতি দেয় না। শিক্ষাক্ষেত্রটি বরাবরই অবহেলিত ধনী-নির্ধন সবার কাছেই।
আশার কথা শেষ পর্যন্ত স্কুল খোলা গেছে। এটা পরীক্ষিত সত্য যে ১২-১৮-এর বয়ঃসন্ধির ছেলেমেয়েরা নিজের বাবা-মার থেকে বেশি পছন্দ করে সমবয়সি বন্ধু-বান্ধবদের সঙ্গ। সর্বোপরি সেই সঙ্গতে জাতপাত নেই। শিশু কোমল মন নিঃসঙ্কোচে ব্রাহ্মণ সন্তান হয়েও নীচু জাতের সন্তানকে বুকে জড়িয়ে ধরতে পারে। নিজের চোখে দেখা একটি মুসলিম ছেলে বাবার টুপি লুকিয়ে ব্যাগের মধ্যে নিয়ে এসে হিন্দু ছেলেকে পরিয়ে দু’জন পরস্পরকে আলিঙ্গন করছে। সুস্থ সমাজ তৈরি হবার জন্য এই আলিঙ্গনের মূল্য অপরিসীম। অন্যদিক থেকে দেখতে গেলে স্কুল বন্ধ থাকায় বেড়েছে নারী নির্যাতন। মনে রাখা দরকার স্কুল মেয়েদের নিরাপত্তা ও ভালো থাকাকে নিশ্চিত করে। সমস্যা হল অভিভাবক সহ মাস্টারমশায়ের একটি বড় অংশ বুঝতে চান না যে স্কুল শুধুমাত্র ছাত্রছাত্রীদের পড়াশোনার জন্যই নয়, তাদের সর্বাঙ্গীণ বিকাশের জন্যই প্রয়োজন। তবে এক্ষেত্রে বর্তমান অবস্থা একটু অন্যরকম চায়। সেটি কি রকম? এতকাল অভিভাবকরা স্কুলে এসেছেন এবার কিন্তু স্কুলকেই পৌঁছতে হবে অভিভাবকদের কাছে।
এবার স্কুল খোলার পরে যে সমস্যা দেখা গেল সেদিকে একটু দৃষ্টিপাত করা যাক। অবশ্য এই সমস্যা হবে তার অশঙ্কা ছিল। কথিত আছে এবং সর্বৈব সত্য, অন্য সকল বিদ্যার ন্যায় পুঁথিগত বিদ্যাও ‘অনভ্যাস বিদ্যা হ্রাস করে।’ গত দু’বছরে পড়াশোনার সঙ্গে বিন্দুমাত্র যোগাযোগ না থাকায় যেটুকু তারা শিখেছিল তার সিংহভাগই তারা ভুলে মেরে দিয়েছে। সেক্ষেত্রে একটা ব্যবস্থা করা যেত তাদেরকে পুরনো ক্লাসে রেখে দেওয়া। নানাবিধ কারণে সেটা সম্ভব হচ্ছে না। ফলে তাদের যার পর নাই ক্ষতি। যেমন ধরা যাক অতিমারির আগে মাস্টারমশাই অনেক কষ্ট করে হাফ প্যান্ট পরা বাচ্চাটিকে ক্রয়মূল্যের উপর লাভ এবং বিক্রয়মূল্যের উপর লাভের পার্থক্য বুঝিয়েছিলেন। সে বেচারি তা এখন বেমালুম ভুলে গেছে উল্টে সে এখন অনেক উঁচু ক্লাসে উঠে গেছে (যেহেতু পাশফেলের গল্প নেই)। ফুলপ্যান্ট পরে এসে সে শিখতে চলেছে বীজগণিতের ফর্মুলা সঙ্গে চৌবাচ্চাতে জল ভর্তির দায়িত্ব নতুবা কলকাতা থেকে বর্ধমান ছেড়ে চলে যাওয়া দুটো ট্রেনের মিলনের চেষ্টা (Time & Distance)। নানাবিধ চাপে তার অবস্থা নির্ঘাৎ তেল মাখানো বাঁশে চড়া সেই বাদরের মতো। অন্য বিষয়ের অবস্থাও তথৈবচ। ধরা যাক, যে ছেলে বা মেয়েটিকে বাক্য গঠন শেখানো হয়েছিল, এবার এসে তাকে ভাবসম্প্রসারণ করতে বলা হচ্ছে। ১০-১৫ বছর বয়সেই অঙ্ক-সহ লিখতে পড়তে পাড়ার ঘাটতি সবচেয়ে বেশি। ফল কী হতে চলেছে, নিশ্চিতভাবে সেই ছেলেটি এর থেকে বাঁচতে স্কুল-ছুট হবে।
সত্যি বলতে কী ভারত তথা বিশ্বের অর্থনৈতিকভাবে পিছিয়ে পড়া দেশগুলিতে এই চিত্র দেখে অবাক হবার কিছু নেই। ভারতের ১০ শতাংশ মানুষের হাতে আছে দেশের ৬৫ শতাংশ সম্পদ এবং নীচের দিক থেকে ৫০ শতাংশ মানুষের কাছে আছে সম্পদের মাত্র ৬ শতাংশ। কী নিদারুণ বৈষম্য! এই ১০ শতাংশের জন্য ভালো মাস্টার, ভালো বই থেকে শুরু করে সর্বদা জামাই আদর। সর্বোপরি তাদের অভিভাবকরা শিক্ষিত এবং বিত্তশালী, ফলে অতমারির সময়ে শিশুদের প্রতি যথাযথ যত্ন নেবার ক্রমাগত চেষ্টা করে গেছেন। বাকিদের মধ্যে সিংহভাগ কিন্তু শিক্ষার ক্ষেত্র থেকে চিরতরে হারিয়ে গেল বা স্বেচ্ছায় বিদায় জানাল।
এমতবস্থায় স্কুল খুলে দেওয়া কোনওমতেই সমস্যার একমাত্র সমাধান নয়। তবে স্কুল খোলা নিশ্চিতভাবেই প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ তা বলার অপেক্ষা রাখে না। বাস্তবিকই সমস্যার শেকড় অত্যন্ত গভীরে তাই চটজলদি সমাধান কোনও মতেই সম্ভব নয়। রাজ্য ও কেন্দ্রকে যৌথভাবে সৎ উদ্দেশ্য নিয়ে এগিয়ে আসতে হবে। পারস্পরিক দোষারোপের নাটক বন্ধ হওয়া দরকার। কারণ এ সমস্যা তো বন্যা বা খরা নয়, যে হেলিকপ্টার থেকে জল মাপতে হবে বা চাষের জমির ফাটল দেখতে হবে। সমস্যার ভেতর না ঢুকতে পারলে সমগ্র জাতির চরম দুর্দিন আসন্ন কারণ মনে রাখা দরকার শিশুরাই জাতির মেরুদণ্ড। ‘শিক্ষা ব্যবস্থা’-র গোটাটাকে নিয়েই নতুনভাবে ভাবার সময় এসেছে। প্রয়োজনে ছাত্রছাত্রীদের জন্য মাস্টারমশাইদের বেশি সময় দিতে হবে ক্ষত মেরামতের জন্য। শিশুদের আর্থিক প্যাকেজ দিতেই হবে। সহজ কথাতে বলতে গেলে বর্তমানে নিশ্চিতভাবে আমরা এক মহাসঙ্কটের মুখে। এমতবস্থায় সরকার সঠিকভাবে চিন্তাভাবনা বা গুরুত্ব না দিলে একটা গোটা প্রজন্মই নষ্ট হয়ে যাবার সম্ভাবনাই প্রবল।
(মতামত লেখকের একান্তই ব্যক্তিগত)
সব ছবি: আন্তর্জাল
Leave a Reply
Your email address will not be published. Required fields are marked *
Comments