ক্ষতিকারক ‘চাইনিজ মাঞ্জা’
সুমন কল্যাণ চক্রবর্তী
তথ্য প্রযুক্তি বাস্তুকার
বিশ্বকর্মা পুজো মানেই নীল আকাশে ‘রঙিন ঘুড়ি’ ওড়ানোর মজা। এই ঘুড়ি ওড়ানোর সঙ্গে একে অপরের ঘুড়িকে কেটে ‘ভোকাট্টা’ করার মজাটাও নিঃসন্দেহে অপূর্ব। আকাশযুদ্ধে কারোর ঘুড়ি ‘ভোকাট্টা’ করতে গেলে ‘মাঞ্জা সুতো’ একটা বিশেষ ভূমিকা বহন করে। বেশ কয়েক বছর আগেও সুতির সুতোর উপর কাচগুড়ো আর আঠা হিসাবে প্রধানত সাবু সহযোগে তৈরি হত ‘মাঞ্জা’। কিন্তু বর্তমানে নাইলন সুতোর উপর সিন্থেটিক আঠা দিয়ে ধাতুর মাঞ্জা দেওয়া হচ্ছে ব্যাপক হারে, যাকে ‘চাইনিজ মাঞ্জা’ আখ্যা দেওয়া হয়েছে।
আগে চিন দেশ থেকে এই সুতো আসলেও বর্তমানে এই দেশেই তৈরি হচ্ছে এই ধরনের রাসায়নিক মাঞ্জা। এই ‘চাইনিজ মাঞ্জা’ নন বায়োডিগ্রেডেবল সিন্থেটিক ফাইভারের উপর ভিত্তি করে তৈরি হয়, যেটি ভীষণ শক্ত প্রকৃতির হয়। এই মাঞ্জা খুব ভালো বিদ্যুৎ পরিবাহীও বটে এবং এতটাই শক্ত ও ধারালো যে, এই মাঞ্জায় মানুষের হাত কেটে যাওয়া থেকে গলা কেটে মৃত্যু পর্যন্ত ঘটেছে। গাছে আটকে থাকা এই ‘চাইনিজ মাঞ্জা’র জন্য কত যে পাখির প্রাণ গেছে, তার ইয়াত্তা নেই।
ঘুড়ি বিক্রেতাদের মতে, নাইলনের এই মাঞ্জার সঙ্গে সাধারণ সুতো ঘষা লাগলেই সাধারণ সুতো কেটে যায়। তাছাড়া, এই চাইনিজ মাঞ্জা সুতোর দাম, সাধারণ সুতো অপেক্ষা অনেকটাই কম। সোনি, অল–আউট, জিরো, রাজা, ডায়মন্ড ইত্যাদি বিভিন্ন ব্র্যান্ডের চাইনিজ মাঞ্জার দাম শুরু হয় মোটামুটি চল্লিশ টাকা থেকে প্রায় পাঁচশ টাকা পর্যন্ত, যেখানে মাঞ্জা দেওয়া সুতির সুতোর দাম অনেকটাই বেশি। একদিকে অল্প দাম ও অপরদিকে অতিরিক্ত শক্ত ও ধারালো প্রকৃতির জন্য, অল্পবয়সীদের কাছে চাইনিজ মাঞ্জার চাহিদা খুব বেশি ও জনপ্রিয়।
এই চাইনিজ মাঞ্জার ক্ষতিকারক দিক নিয়ে ঘুড়ি বিক্রেতা সহ সাধারণ মানুষ খুব চিন্তিত। এই মাঞ্জার মারাত্মক দিকগুলো সম্বন্ধে আরও সচেতন হয়ে চাইনিজ মাঞ্জাকে সম্পূর্ণরূপে ‘ব্যান’ করতে হবে আমাদের। ২০১৬ সালের ১৪ ডিসেম্বর, ‘ন্যাশনাল গ্রিন ট্রাইবুনাল’ এই ‘চাইনিজ মাঞ্জা’র উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছিল। তাতে বলা হয়, আদেশ অমান্যকারী ব্যক্তির পাঁচ বছর জেল ও এক লক্ষ টাকা জরিমানা হবে। ‘পিপল ফর দি এথিক্যাল ট্রিটমেন্ট অফ অ্যানিম্যালস’–এর একটি তথ্য অনুযায়ী, চাইনিজ মাঞ্জায় আটকে বা ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে দেশে বছর বছর বেশ কয়েক হাজার করে পাখি আহত হচ্ছে ও মারা যাচ্ছে।
এই চাইনিজ মাঞ্জা, ঘুড়ি ওড়ানো ছাড়াও মাছ ধরার সুতো ও পাখি ধরার ফাঁদ তৈরিতে কাজে লাগানো হচ্ছে। তাই এই সুতোকে অনেকে ‘মারণ সুতো’–ও বলেন। কলকাতার মা উড়ালপুলে এই চাইনিজ মাঞ্জায় জড়িয়ে অনেক বাইক আরোহীর দুর্ঘটনা ঘটেছে, আর সেই কারণেই উড়ালপুলের গার্ডওয়াল থেকে প্রায় আট ফুট উচ্চতা পর্যন্ত জাল বা নেট লাগানোর কথা ভাবা হচ্ছে।
কলকাতার উপকণ্ঠে এই চাইনিজ মাঞ্জার বিক্রি অবাধে বেড়েই চলেছে। এর বিরুদ্ধে প্রশাসন অভিযান চালালেও কিছু অসাধু ব্যবসায়ীরা এই প্রকারের মাঞ্জা বিক্রি করেই চলেছে। শুধু প্রশাসনের উপর দায়িত্ব না দিয়ে আমাদের সবাইকে একসঙ্গে মাঞ্জা বিক্রি বন্ধের সচেতনতাবোধ গড়ে তুলতে হবে। ঘুড়ি ওড়ানোর আনন্দের দিনে ক্ষতিকারক এই ‘চাইনিজ মাঞ্জা’ ব্যবহার করে অহেতুক বিপদ ডেকে না আনাটাই আমাদের কাম্য হোক; বন্ধ হোক চাইনিজ মাঞ্জার ব্যবহার— কমুক অঘটন, সুস্থ থাকুক প্রকৃতি।
ছবি: আন্তর্জাল
Leave a Reply
Your email address will not be published. Required fields are marked *
Comments