গ্রাম বাংলার লোকায়ত চড়কের মেলা শহুরে মেলায় পর্যবসিত হয়েছে

তুষার ভট্টাচাৰ্য

সাম্প্রতিককালে প্রান্তিক গ্রাম বাংলার বিশেষ করে রাঢ় বাংলার গ্রামীণ লোকায়ত গাজন বা চড়কের মেলা প্রায় শহুরে মেলায় পরিণত হয়েছে। লোকায়ত এই গ্রামীণ চড়কের মেলায় এখন আর রাঙা ধুলো মাটির ঘ্রাণ খুঁজে পাওয়া যায় না কোথাও। অথচ এই বাংলার বিভিন্ন গ্রামেগঞ্জে বছর ত্রিশ চল্লিশ আগেও চৈত্রমাস পড়লেই গাজনের (চড়ক পুজোর) প্রস্তুতি শুরু হয়ে যেত। ‘জয় বাবা মহাদেবের জয়’ বলে ভক্তবৃন্দরা লালচেলি কাপড় পরে, ঢাক, কাঁসর ঘণ্টা, ত্রিশূল, রামদা (খড়্গ) ও সিঁদুর মাখানো নরমুন্ডুর খুলি এই সব নিয়ে এবং নীল ঠাকুরের পাট মাথায় করে গৃহস্থের বাড়ি বাড়ি ঘুরে ভিক্ষান্ন, আনাজপাতি, ফলমূল সংগ্রহ করত।

গ্রাম বাংলার লোকায়ত এই চড়কপুজো বা গাজন উপলক্ষে গোটা চৈত্র মাস ছিল বাবা মহাদেবের ভক্তবৃন্দের কাছে এক চরম কৃচ্ছসাধনের মাস।
সারাদিন রাতে একবার মাত্র নিরামিষ অন্নগ্রহণ, তারপরে রাত্তিরে নদীর পাড়ে বট পাকুড় গাছের তলায় গামছা বিছিয়ে নিশ্চিন্তে ঘুম। গাজনের ব্রত পালনকারী সব সন্ন্যাসীকেই এই চরম কৃচ্ছসাধন করতে হত নীলঠাকুরের (শিব) উদ্দেশে ভক্তি নিবেদনের জন্য।

চৈত্রদিনের তপ্ত রাঙা ধুলো উড়িয়ে গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে মাথায় পাট ঠাকুর নিয়ে ঘুরে বেড়ানো সমাপ্ত হলে, দিনান্তের শেষে অস্তরাগের গোধূলি রাঙা আলোয় নীল ঠাকুরের ভক্তবৃন্দরা পেট্রোম্যাক্স (হ্যাজাক লণ্ঠন) নিয়ে কেউ শিব ঠাকুর কেউ বা পার্বতী কিংবা মা কালী সেজে গৃহস্থের বাড়ি বাড়ি নাচ দেখিয়ে ঘুরে বেড়াত সারা চৈত্র মাস জুড়ে।
অনতিঅতীতে চৈত্র সন্ধ্যের সুমন্দ নরম বাতাস বাহিত দিনে গ্রামাঞ্চলের মানুষের বিনোদনেরও একটি অন্যতম মাধ্যম ছিল গাজনের এই নাচ গান।

বিশেষ করে রাঢ় বাংলার প্রান্তিক গ্রামীণ জীবনে এই গাজনের সং-নাচ গানে ছিল মায়ামৃদঙ্গের এক আশ্চর্য মায়াটান। মুর্শিদাবাদ, বীরভূম, বর্ধমান, নদীয়া জেলায় শিব পার্বতীর উদ্দেশে নিবেদিত গাজনের এই পালা গানকে বোলান গানও বলা হয়ে থাকে। মালদা জেলায় শিবের বন্দনা গানকে বলা হয়ে থাকে গম্ভীরা। প্রাচীন লোকায়ত বোলান পালাগানের মুখ্য চরিত্র হলেন শিব। তাঁকে ঘিরেই তৈরি হয় বিভিন্ন ভক্তিমূলক গান। শিব ঠাকুরের বন্দনার মাধ্যমে আসলে সমকালীন গ্রামীণ সমাজের বিভিন্ন সমস্যা তুলে ধরা হয়ে থাকে। মূলত, গ্রাম বাংলার এই লোকায়ত গান কোথাও গাজন কোথাও বোলান আবার কোথাও গম্ভীরা নামে পরিচিত।

আগে গ্রাম বাংলায় হলুদ পাতাঝরা চৈত্র মাসের শেষ দিনে অর্থাৎ চৈত্র সংক্রান্তির দিনে অনুষ্ঠিত হত চড়ক পুজোর মেলা। সন্ধে নামার আগেই মেলা শুরু হয়ে যেত।
বড়শি ফুঁটিয়ে চড়ক গেছে বনবন করে ঘোরানো হত নীলঠাকুরের একজন ভক্তকে। সেই ভক্তের উদ্দেশ্যে মেলায় আগত মানুষজন সিকি, আধুলি টাকা ছুড়ে দিতেন। ঢাক আর কাঁসর ঘন্টার উচ্চ নিনাদে জমে উঠত লোকায়ত চড়কের মেলা।

তেলেভাজার গন্ধ, বাঁশি ভেঁপুর শব্দে আর সন্ন্যাসীদের ‘জয় বাবা মহাদেবের জয়’ ধ্বনিতে গমগম করত গ্রামীণ লোকায়ত এই চড়কের মেলা।
সাম্প্রতিককালে গ্রাম বাংলার চড়ক মেলার সেইসব সোনালি দিন আর নেই।
এখন আর গোটা চৈত্র মাসজুড়ে গ্রামে গ্রামে নীলঠাকুরের পাট মাথায় নিয়ে ঘুরতে দেখা যায় না নীলঠাকুরের ভক্তদের। চৈত্র সংক্রান্তির এক সপ্তাহ আগে দায়সারা ভাবে শুরু হয় নীলঠাকুরের মেলা অর্থাৎ চড়ক মেলার প্রস্তুতি।

প্রাচীন লোকায়ত চড়কের মেলাতে এখন আর আবেগ উচ্ছাস তেমন নজরেও পড়ে না। এখন বেড়েছে মেলার জৌলুষ, চাকচিক্য আর বিজলি বাতির রোশনাই। হালআমলে বিজলিবাতির সৌজন্যে চড়কের মেলা শেষ হয় রাত্রি এগারোটা বারোটায়।
এই লোকায়ত মেলায় এখন মোটর সাইকেল বিক্রির ঋণ মেলা, টিভি, মোবাইল ফোন বিক্রির অস্থায়ী স্টলও খোলা হয় কোথাও কোথাও।

ইদানিং এই লোকায়ত গ্রামীণ মেলায় মাটির হাঁড়ি, কলসি, সরা, লোহার হাতা, খুন্তি প্রভৃতি গ্রামীণ মানুষদের নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিস বিক্রি চড়ক মেলা থেকে হারিয়ে যেতে বসেছে।
বস্তুত, রাঢ় বাংলার লোকায়ত প্রাচীন চড়ক মেলা সাম্প্রতিককালে সম্পূর্ণ শহুরে মেলায় রূপান্তরিত হয়ে গিয়েছে। আধুনিকতার স্পর্শে ইদানীং প্রাণহীন মনে হয় চড়কের মেলাকে। বিশুদ্ধ গ্রামীণ মেলা আর কোথাও নেই। বিশিষ্ট সাংবাদিক, রবীন্দ্র বিশেষজ্ঞ এবং ছড়াকার অমিতাভ চৌধুরী বলেছিলেন— সমগ্র পশ্চিমবঙ্গই এখন বৃহত্তর কলকাতা। গ্রাম বাংলা হারিয়ে যাচ্ছে কলকাতাকে অনুকরণ করতে গিয়ে। 

সব ছবি: শৈবাল দাস

 

চৈত্রশেষে
ঐন্দ্রিলা বন্দ্যোপাধ্যায়

চৈত্র অবসান
কন্ঠে আমার গান
বাজছে আজি বিদায় বাঁশির সুরে।

ছিল যে সব কাছে
হারিয়ে সবই গেছে
চলে গেছে সে সব বহুদূরে।

অতীত কালের দিন,
স্মৃতিতে আজকে ক্ষীণ
অনেক কিছুই গেছে আবার মুছে।

আসছে নতুন কাল,
ধরব এবার হাল
দুঃখ আমার যাবেই এবার ঘুচে।

নতুন দিনের আশা,
বাঁধছে মনে বাসা
নতুন করে করব শুরু এবার।

চৈত্র গেল চলে
কর্ণে গেল বলে—
যাবেই চলে যখন যেটা যাবার।

অতীত দিনের স্মৃতি
থাকবে হয়ে গীতি,
ভাবব সে সব আকাশ পানে চেয়ে।

সব বেদনা ভুলে
উঠবে তরী দুলে,
চলবে আবার জীবনধারায় বেয়ে।

চলার পথের ধারে
সঙ্গে পাব যারে—
তারাই হবে আমার চলার সাথী।

আর যারা সব গেল—
আবার তারা এল
মনের মাঝে, যখন নিঝুম রাতি।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *