বিরসা মুন্ডার জীবন ও সংগ্রাম
ডঃ সঞ্জীব রায়
আদিবাসীদের কাছে বিরসা মুন্ডা, সিধু ও কানুর মতনই প্রিয় একজন। আদিবাসীরা বিরসাকে ভগবান জ্ঞান করত। অত্যাচারী ইংরেজদের বিরুদ্ধে বিরসা মুন্ডা জাতিকে একত্রিত করে যে সংগ্রাম করেছিল তার নাম ‘উলগুলান’। বিরসার নেতৃত্বে ‘উলগুলান’ চলে ১৮৯৫–১৯০০। সংগ্রামে বিরসার পরাজয় হয়। ১৯০০ সালের ৯ জুন কারাগারের অন্ধকারে বন্দি ২৫ বছরের যুবক বিরসার মৃত্যু হয়— যা এককথায় অত্যন্ত মর্মান্তিক। আজ বিরসার জন্মদিন উপলক্ষে তাঁকে নিয়ে স্মৃতিচারণ
অষ্টাদশ শতকের প্রথম থেকেই সিংভূম, রাঁচি, পালামৌ জেলায় মুন্ডা, ওরাও এবং হো আদিবাসীদের বসতি ছিল। ঐ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে অর্থাৎ ১৭৫০–১৮০০ সময়ে বাইরে থেকে আসা জমি মাফিয়ারা এখানে ঢুকে পরে। ক্রমে ক্রমে মুন্ডারা হারায় তাদের স্বাধীনতা, জমি ও ক্ষমতা। পরবর্তীকালে উনিশ শতকের গোড়ার দিকে ছোটনাগপুর যখন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসনে তখনই শোষণ ও অবিচার চরম সীমায় পৌঁছয়। সেই সাহেবদের চোখে আদিবাসীরা ছিল চোয়াড় ও ডাকাত। অন্যদিকে ব্রিটিশ বিচার ব্যবস্থায় আদিবাসীদের অজ্ঞতার সুযোগ নিয়ে তাদের ঠকিয়ে জলের দরে জমি হস্তান্তর করে নেওয়া হত। স্বভাবতই ধীরে ধীরে আদিবাসীদের মনে ব্রিটিশ শাসন ব্যবস্থা সম্পর্কে প্রচন্ড বিতৃষ্ণা জন্মায়। সহজ সরল আদিবাসীদের শেষ সম্বল পঞ্চায়েত ব্যবস্থাও ক্রমশ কোম্পানির কুক্ষিগত হয়ে যায়। খানিক বাধ্য হয়েই পাঁচ হাজার আদিবাসী নিজের মুল্লুক ছেড়ে আসামের চা বাগানে কাজ করতে চলে যায়। এখানেই শেষ নয় তাদের ধর্মের উপরেও আঘাত আসে। হিন্দুরাজা ও জমিদারদের প্রচেষ্টায় হিন্দুত্ববাদ আদিবাসীদের ধর্মে ঢোকানোর চেষ্টা চলে। উপরন্তু মিশনারিরাও স্কুল চালানো ও সেবার পাশাপাশি আদিবাসীদের ধর্মান্তরিত করার নিরন্তন প্রচেষ্টা চালিয়ে যায়। হিন্দুত্ববাদ ও মিশনারিদের চাপে মুন্ডাদের নিজেদের ধর্মসংস্কৃতি ক্রমশই কোণঠাসা হয়ে পড়ে। আদিবাসী সমাজে তখন সবদিক থেকেই এক সর্বনাশের ইঙ্গিত।
বাইরের লোকেরা সাঁওতালদের কাছে ‘দিকু’ নামে পরিচিত ছিল। এই ‘দিকু’দের অত্যাচার ও শোষণ যখন চরমে উঠে তখনই বিদ্রোহ বা বিপ্লবের সূচনা হয়। ১৭৮৯–১৮২০ সাল অর্থাৎ দীর্ঘ ৩১ বছর অনেক রক্তঝড়া সংগ্রামের পরে আদিবাসীরা হার মানে।
পরবর্তীকালে তাদের আন্দোলন থেকেই ১৮৩১–৩২ সালের ভয়ঙ্কর কোলবিদ্রোহ শুরু হয়। তবে দুর্ভাগ্যবশত এদের কোনও বিদ্রোহ বা সংগ্রাম সাফল্যের মুখ দেখেনি। কারণ বন্দুকের সামনে তীর ধনুকের লড়াই মূলত ছিল এক অসম লড়াই। সেই অসম লড়াইতে প্রাণ দিতে হয়েছে বহু আদিবাসী যোদ্ধাদের।
আদিবাসীদের পুরনো ডেরা ছোটনাগপুর সম্পর্কে এক জনশ্রুতি আছে। বহুকাল আগে চুটু আর নাগু নামের দুইভাই ঘর বাঁধার তাগিদে খুঁজে খুঁজে রাঁচি শহরের কাছে ডোমডোগার নদী তীরে পৌঁছয়। পরে তারা সমগোত্রীয় মানুষজনকে নিয়ে সেখানে ঘর বাঁধে। সেই জায়গার নাম হয় চুটিয়া। এই চুটু আর নাগু এই দু’জনের নামে জায়গার নাম হয় ছোটনাগপুর। তারা সেখানে ঘর বাঁধলে কী হবে বাইরের লোক বা ‘দিকু’ এসে তাদের উচ্ছেদ করে। ঘুরতে ঘুরতে তারা একাধিক জায়গায় অনেকগুলো গ্রামের পত্তন করে। উক্ত গ্রামগুলির মধ্যে অন্যতম হল উলিহাতু।
মনে করা হয় এই উলিহাতুর চুটু আর নাগুর বংশধর লাকারি মুন্ডা। তার তিন ছেলে। মেজো ছেলে সুগানার সঙ্গে আয়ুভাতু গ্রামের দিবর মুন্ডার বড়ো মেয়ে করমির সঙ্গে বিয়ে হয়। তাদের আবার তিন ছেলে ও দুই মেয়ে জন্মগ্রহন করে। বড়ো ছেলে কোমতা, তারপরে দুই মেয়ে, এরপরে জন্মায় বিরসা। এই বিরসার জন্মস্থান ও জন্মদিন সম্পর্কে নানা কথার প্রচলন আছে। অনেকেই বলেন যে কুরুমরদা গ্রাম ছেড়ে সুগানা ও করমি যখন বামবা গ্রামে যান সেখানে এক বাঁশের বেড়ার ঘরে বিরসার জন্ম। সেটা ছিল কার্ত্তিক মাস এবং বিষ্যুদবার। বিষ্যুদবারে জন্ম তাই নবজাতকের নাম বিরসা। সেটা ১৮৭৪ বা ১৮৭৫ যে কোনও বছর হতে পারে, যদিও ১৫ নভেম্বর ১৮৭৫–কেই বিরসার জন্মদিন হিসেবে সরকারিভাবে স্বীকৃতি বা মান্যতা দেওয়া হয়।
বিরসার জন্মের কিছুকাল পরে সুগানা পরিবার চলে আসে চালকাদে। সেখানেই বিরসা খ্রীষ্টান হয়েছিল। তখন তার নাম হয় দাউদ মুন্ডা বা দাউদ বিরসা। কৈশোরেই সে আর পাঁচটা মুন্ডা ছেলেদের মতো বোহোনভার জঙ্গলে ছাগল চড়াত। একটু বড়ো হতে না হতেই সে নিজে নিজে বাঁশি বাজাতে শেখে। ছিপছিপে কালো প্রায় সাড়ে ৫ ফুট লম্বা বিরসা অন্য মুন্ডা ছেলেদের থেকে ছিল খানিক আলাদা। বাড়িতে বড়ই অভাব। বিরসার দাদা চলে যায় এক মুন্ডার চাকর হয়ে বরতোলি। সেখানে সে বিয়ে করে সংসার পাতে। বিরসা চলে যায় মামাবাড়ি আয়ুভাতুতে। সেখানে কিছুদিন থাকার পরে চলে যায় ছোটমাসীর সঙ্গে খাটাঙ্গিতে। ছোটবেলা থেকেই ভীষণ ভাবুক ছিল বিরসা। সব সময়েই আনমোনা থাকত সে। একদিন মেসোর ছাগল, ভেড়া চড়াতে গিয়ে সঠিকভাবে নজর না রাখাতে ছাগল, ভেড়া ঢুকে পরে অন্যের খেতে। এই নিয়ে ভালোরকম অশান্তি হয়।
ভাবুক বিরসার পড়াশোনাতেই প্রচন্ড আগ্রহ, তার কি আর ছাগল, ভেড়া চড়াতে মন লাগে? একদিন একা–একাই বাড়িতে কাউকে কিছু না বলে অনেক পথ হেঁটে সে চলে যায় চাঁইবাসার জার্মান মিশনে আপার প্রাইমারি স্কুলে ভর্তি হতে। সেই স্কুলে তখন ভর্তির মরশুম শেষ কিন্তু বিরসার আগ্রহ দেখে স্কুল কর্তৃপক্ষ তাকে ভর্তি নেয়। ১৮৮৬ থেকে ১৮৯০ সাল অবধি স্কুলে পড়াকালিন বিরসার খ্রীষ্টান ধর্মের প্রার্থনা ও অন্যান্য রীতির সঙ্গে পরিচয় হয়। সে মিশনের সাহেবের মুখে শুনেছিল অনেক আশার কথা। তিনি প্রকাশ্যেই বলেছেন, যে খ্রীষ্টান ধর্ম মেনে চললে একদিন তারা সব জমি ফেরত পাবে। দুর্ভাগ্যবশত সুর কেটে যায় একদিন যে দিন তিনিই প্রকাশ্যে বলেন, ‘মুন্ডারা সবাই ঠগ, সবাই জোচ্চোর।’ শুনে তীব্রভাবে প্রতিবাদ করে উঠেছিল বিরসা। বলেছিল, ‘ঠক জোচ্চোর তারাই যারা এতকাল আমাদেরকে ঠকিয়েছে।’ এমন রূঢ় সত্য কথা বলার পর কি আর স্কুলে জায়গা থাকে? বিদায়কালে বিরসা প্রকাশ্যেই বলে যায়, ‘সাহেব সাহেব এক টোপি হ্যায়।’ অর্থাৎ সব সাহেবই এক গোত্রের।
বিরসা চলে যায় বন্দগাঁও। সেখানে জমিদার জগমোহন সিংহের মুনশি আনন্দ পাঁড়ে এবং তাঁর ভাই সুখনাথ পাঁড়ের কাছে কাটায় তিনবছর। তাদের কাছে বিরসা জানতে পারে হিন্দু ধর্ম, বৈষ্ণব ধর্মের খুঁটিনাটি। হঠাৎ করে বিরসার কাছে খবর যায় যে সিংভূম–মানভূম–পালামৌ অঞ্চলের সরকার কানুন জারি করেছে যে গ্রামে যত জমি আছে সব বনবিভাগের। সব বন সংরক্ষিত হতে চলেছে তার অর্থ হয়— আদিবাসীরা আর জঙ্গলকে যথেচ্ছ ব্যবহার করতে পারবে না। আদিবাসীরা স্বপ্নেও ভাবেনি যে অরণ্যের অধিকার তাদের হাতছাড়া হবে। দলে দলে মুন্ডারা এসে বিরসাকে সব জানায়। বিরসার থাকা হল না আনন্দ পাঁড়ের সঙ্গে। আনন্দ পাঁড়ের হাজার বারণসত্ত্বেও বিরসা চলল চাঁইবাসা। সেটা ছিল ১৮৯৪ সাল।
১৮৯৫ সালের মধ্যেই বিরসা বুঝে ফেলে যে খ্রীষ্টান ও হিন্দুধর্মের কাছে তার কিছু পাবার নেই। প্রয়োজন মুন্ডাদের নতুন ধর্ম অর্থাৎ ডাইনি তুকতাক, অলৌকিক পুরোহিতের খবরদারি বর্জন করে নতুন ধর্ম— যা যুদ্ধ করতে, হাতিয়ার ধরতে শেখাবে। মূল শত্রু ইংরেজ হলেও ‘দিকু’রা সবাই অনিষ্ঠ চায়। তাদের মধ্যে অন্যতম মিশনের লোকজন, সরকারি কর্মচারী, উকিল, বিচারক, জমিদার মহাজন, ঠিকাদার সবাই। বিরসার মনে এই তোলপাড়ের সময় দেশজুড়ে এলো খরা। সেই খরায় জঙ্গলের ফলমূল খেয়ে কোনওরকমে জীবনরক্ষা। মারা গেলে অনেকে। বিরসা চলে গেল জঙ্গলে। পাগলের মতো বনে বনে ঘুরে বেড়ায়। সঙ্গীসাথী জোগাড় হয় কিছু। অন্যদিকে বিরসার মা হন্যে হয়ে বিরসাকে খুঁজে বেড়ায়।
একদিন প্রচন্ড ঝড়–জলের রাত। ক্রমাগত বাজ পড়ছে। সেই ঝড়–জলের রাতে করমির কানে এলো অনেক পায়ের শব্দ। তাদের মিলিত গলার আওয়াজ। প্রচন্ড ভয় পেয়ে, প্রলয়ের আশঙ্কা করে করমি চিৎকার করে দরজা খুলে হতচকিত হয়ে যায়। করমির দেহ অবশ। সদর দরজার বাইরে দু’হাত মাথার উপর তুলে দাঁড়িয়ে বিরসা। পেছনে অনেকের হাতে তীর ধনুক, কুঠার। বিরসা চিৎকার করে বলে উঠে, ‘আমি বিরসা নই, আমি ধরতিআবা। এই পৃথিবী আমার সন্তান। আমি মুন্ডাদের নতুন ধর্ম শিখাব। আমি তোদের কোলে নিয়ে ভুলাব না, দুলাব না। আমি মুন্ডাদের মরতে আর মারতে শিখাব।’
ক্রমে ক্রমে যথার্থই ধরতিআবা হয়ে উঠল বিরসা। সবার কাছে বিরসা ভগবান। এই ভগবান সেবকদল নিয়ে ছুটে যায় এখানে সেখানে। বসন্ত রোগের মড়কে মলম ও চন্দন লেপে দেয় রোগীর শরীরে। সকলেই ২০ বছরের যুবক ছেলেটির সেবার মনোভাবে মুগ্ধ। মিশনের সাহেবদের টনক নড়ে। খবর পায় যে গরিব মায়ের মুন্ডা ছেলে ধরতিআবা হয়েছে। বিরসা বলে তোমরা শোনো, সাহেব জমিদার ও মহাজন সবাই আমাদের পরম শত্রু। সিংভূমের গ্রাম থেকে দলে দলে লোক অস্ত্রসহ বিরসার দলে যোগ দেয়। এই সময়ে বিরসা হাঁক দেয়, যতদিন না স্বাধীন মুন্ডারাজ হচ্ছে, ততদিন কেউ খাজনা দেবে না। কুড়ি বছরের এক তরুণ মুন্ডার স্বপ্ন মিলে যাচ্ছে বাবা তিলকা মাঝির, সিদু কানুর স্বপ্নের সঙ্গে। তার মানে সর্বনাশ আসন্ন। রাঁচির ডেপুটি কমিশনার ফতোয়া দিল অবিলম্বে বিরসাকে ধরতে হবে। ধরা হল ফৌজদারি আইনের ৩৫৩ ও ৫০৫ ধারায়। বিরসাকে নিয়ে চলল রাঁচি। ব্রিটিশ শাসকরা ভেবেছিল বিরসাকে গ্রেপ্তার মানেই বিপ্লবের শেষ। কিন্তু ফল হয় উল্টো। কারাবাসের বেশি সময়টাই বিরসা ছিল হাজারিবাগ জেলে। ১৮৯৭ সালে ৩০ নভেম্বর সে ছাড়া পায়।
বিরসার গোছাতে কিছুটা সময় লেগেছিল। ১৮৯৮ সালের ২৮ জানুয়ারি থেকে ১৮৯৯ সালের নভেম্বর, চলতে থাকে বিদ্রোহের প্রস্ততি। এবার কাজের মূল ঘাঁটি হয় ডোমবারি। লক্ষ্য সাহেবদের বড়দিন পালন। ঠিক হয় উৎসবের দিন একাধিক জায়গা থেকে সাহেবদের উপর আঘাত করা হবে। সিংভূমের চক্রধরপুর, রাঁচির খুঁটি, কারা, তোরপা, তামাড় ও বাসিয়া এই ছটি থানায় ১৮৯৯ সালের ২৪ ডিসেম্বর আগুন জ্বলে। মিশনারীর অনেকে আহত ও নিহত হয়। নিহত হয় পুলিস। গির্জা ও মিশনবাড়ি পুড়ে যায়। পুলিস নড়েচড়ে বসে। বিরসাকে ধরার দায়িত্ব দেওয়া হয় রাঁচির ডেপুটি কমিশনার স্ট্রিট ফিল্ডকে।
৮ জানুয়ারি ১৯০০, পুলিস ও সেনাবাহিনী দূরবিনের সাহায্যে বিদ্রোহীদের দেখে ডোমাবারি পাহাড়ে পৌঁছয়। যে পাহাড়ের চূড়ায় রয়েছে সশস্ত্র বিদ্রোহীরা। ক্রমে ক্রমে পুলিসবাহিনী সবদিক থেকে তাদের ঘিরে ফেলে। পুলিসের সঙ্গে সেনাবাহিনীর যৌথ আক্রমণ। ডেপুটি কমিশনার স্ট্রিট ফিলড দোভাষীর সাহায্যে মুন্ডারি ভাষায় জানিয়ে দিলেন, ‘তোমরা হাতিয়ার ফেলে এখনই আত্মসমর্পণ করো।’ উত্তরে ভেসে আসে প্রতিবাদ। ঝাঁকে ঝাঁকে গুলি ছোটে। উল্টোদিক থেকে পাথর, বন্দুকের সামনে একসময় সব থেমে যায়। পুলিস ও সেনাবাহিনী গুলি ছুঁড়তে ছুঁড়তে পাহাড়ের দখল নেয়। পুলিস কাছাকাছি আসতে অবশ্যই কুঠার টাঙ্গির লড়াই হয় বটে। মেয়ে ও কিশোরদের উপর গুলি চলে। দু’দিন পরে গণকবর দেওয়া হয় সেই সব মৃতদেহগুলি।
এতগুলো প্রাণ, এত প্রস্তুতি খানিক বৃথা যায়। দেখা গেল বিরসা আর তার সাথীরা বেপাত্তা। সর্বত্র পাহাড়া বসে। পুলিস গ্রামে গ্রামে ঘুরে চিরুণি তল্লাশি শুরু করে। গ্রামে রটিয়ে দেওয়া হয় বিরসাকে ধরালে ৫০০ টাকা এবং অন্যান্যদের ধরালে ১০০ টাকা করে বকশিস। সঙ্গে গ্রামে অত্যাচার বাড়ে। খোঁজার জন্য পুলিস কুকুর আসে। পাগলের মতন বিরসা ও সাথীরা পালিয়ে বেড়ায়। জঙ্গলে অভুক্ত বিরসাদের ভাত ও পাতা সেদ্ধ রান্না হচ্ছিল। সাতজন গ্রামবাসী সেটা দেখে ফেলে। ঐ সাতজন ধরিয়ে ছিল বিরসাও সঙ্গে থাকা ডোনকার স্ত্রী ও আরও এক রমনীকে। ঐ সাতজন ৫০০ টাকা ভাগ করে নিয়েছিল বলে শোনা যায়।
বন্দি হয় বিরসাসহ সব বিদ্রোহী মুন্ডারা। জেলে অসহ্য কষ্ট। হাতে সর্বদা হাত কড়া, পা ও কোমরে ভারী শিকল। সেই নিয়েই কোর্টে যাওয়া–আসা। বিচার মানে তো প্রহসন। ৩০ মে ১৯০০ বিরসা আদালতে অজ্ঞান হয়ে যায়। তাকে জেলে নিয়ে এসে ওষুধ দেওয়া হয়। ১ জুন জেল কতৃপক্ষ জানায় বিরসার কলেরা হয়েছে, বাঁচা শক্ত। মাঝখানে একদিনের জন্য ভালো হয়ে উঠেছিল। ৯ জুন ১৯০০, সকাল ৮ টায় রক্তবমি করার পরে ৯ টায় তার মৃত্যু হয়।
মৃত্যুর দিন রাঁচি জেল ফেটে পড়েছিল মুন্ডাদের হাহাকারে। নিয়ম মেনে বিরসার মৃতদেহ ময়নাতদন্ত হয়। দেহে পাওয়া যায়নি কলেরার চিহ্ন। সেদিনের কোনও সংবাদপত্র কলেরার গল্প বিশ্বাস করেনি। তাদের আশঙ্কা ছিল আর্সেনিক বিষ প্রয়োগ করে বিরসাকে মারা হয়েছিল। তবে সত্যি বলতে কী বিরসা কোনওদিনই জেল থেকে বেরতে পারতো না, তার ফাঁসির আদেশও প্রায় হয়েই গেছিল। বিরসা চলে গেছে প্রায় ১২৫ বছর হতে যায়। আদিবাসীরা? সত্যি বলতে কী যেখানে ছিল সেখানেই আছে।
তথ্যঋণ:—
১) অরণ্যের অধিকার— মহাশ্বেতা দেবী
২) বিরসা মুন্ডা— মহাশ্বেতা দেবী
সব ছবি: আন্তর্জাল
Leave a Reply
Your email address will not be published. Required fields are marked *
Comments