কালীপুজো বা শ্যামাপুজো সাধারণত অমাবস্যা তিথিতেই সম্পন্ন হয়ে থাকে। এই পুজো আমাদের কাছে শব্দবাহী ও আলোর রোশনাইয়ের পুজো হিসেবে পরিগণিত। হিন্দুদের ঘরে ঘরে এই পুজোকে কেন্দ্র করে জ্বলে ওঠে আলোকসজ্জার এক মনোরম পরিবেশ। পুজোর প্রবর্তন সপ্তদশ শতকে নবদ্বীপের কৃষ্ণানন্দ আগমবাগীশ করলেও নদীয়ার রাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায় কালীপুজোকে জনপ্রিয় করে তোলেন। এই কালীপুজোতেই আমরা কিছু বিশেষ বিধি মেনে চলি।
অশুভকে বিনাশ করে শুভর সূচনা
সুমন কল্যাণ চক্রবর্তী
◗ কালীপুজোয় চোদ্দ শাক খাওয়া হয় কেন?
পুরাণ মতে, চোদ্দ শাক খাওয়ার বিধি বা রীতির প্রচলন হয় ঋক্বেদের বাস্ফল বা শাক দীপ্তি ব্রাহ্মণদের হাত ধরে। এছাড়া আয়ুর্বেদ ও কবিরাজি শাস্ত্রে শাক অত্যন্ত উপকারী খাদ্য হিসেবে বিবেচিত। যেহেতু কালীপুজোর সময় আস্তে আস্তে মরশুম পালটায়, তাই এই সময়ে সহজলভ্য চোদ্দ শাকগুলির বিশেষ কিছু গুণ মানুষকে অসুস্থতার হাত থেকে রক্ষা করে থাকে।
এছাড়া ডাক্তারি মতে, শাক খাওয়া ভাল, তার কারণ শাকে বিদ্যমান ‘ফাইবার’ মানুষের কোষ্ঠকাঠিন্য থেকে রক্ষা করে পেট পরিষ্কার রাখে।
◗ কী কী শাক থাকে চোদ্দ শাকে?
কালীপুজোর সময় আমরা চোদ্দ শাকের বান্ডিল বাজার থেকে কিনে দিব্যি ভাজা বা রান্না করে খেয়ে নিই। কিন্তু কী কী শাক থাকে এই চোদ্দ শাকে, সেটা জানি কি?
সেগুলি হল: নিম, জয়ন্তী, সর্ষে, কেঁউ, ওল, বেতো, পলতা, শৌলফ, শিঞ্চে, হিলঞ্চ, ভঁাটপাতা, শুষণী, গুলঞ্চ এবং কালকাসুন্দে।
◗ ভূত চতুর্দশী কী? ভুত চতুর্দশীর দিন চোদ্দটি প্রদীপ জ্বালানো হয় কেন?
কালের নিয়ম ঠিক থাকলে, কালীপুজোর আগের দিনকে আমরা ভূত চতুর্দশী বলে থাকি। আমাদের দেশে কোথাও কোথাও একে নরক চতুর্দশীও বলা হয়। শোনা যায়, পৌরাণিক মতে, কৃষ্ণপক্ষে, এই দিনেই শ্রীকৃষ্ণ সত্যয়ভামা এবং কালীঠাকুর নরকাসুরকে হত্যা করে অশুভকে বিনাশ করে শুভ–র জয়ের সূচনা করেন। এটি আশ্বিন মাসের কৃষ্ণপক্ষের শেষ চতুর্দশীতেই ঘটেছিল। যেহেতু চতুর্দশীর রাত (মানে সংখ্যা চোদ্দ), তাই চোদ্দটি প্রদীপ জ্বালানো হয়।
আরেকটি পৌরাণিক মতে, নরকাসুর ‘বলি’ রাজা এই তিথিতেই মর্ত্যে নিজের পুজো নিতে আসে তার অসংখ্য ভূত–প্রেত অনুচরকে সঙ্গে নিয়ে। আর, তাদের গৃহস্থে প্রবেশ বাধা দিতে আমরা কালীপুজোর আগের দিন ভূত চতুর্দশীর দিনে চোদ্দটি প্রদীপ জ্বালিয়ে থাকি। আবার অনেকে মনে করেন, ওই দিনে বংশের পূর্বপুরুষদের আত্মাও গৃহস্থে প্রবেশ করে সুখ–শান্তির আশীর্বাদ করে যান। তাই চোদ্দ পুরুষের স্মরণ করার উদ্দেশ্যে চোদ্দটি প্রদীপ জ্বালানো হয়। এভাবেই বর্তমান প্রজন্মের দ্বারা চোদ্দ পুরুষকে আলোদান করা হয় এই ভূত চতুর্দশী তিথিতে।
আরেকটি তথ্যমতে, কীটের উপদ্রবে হৈমন্তিক ফসল নষ্টের হাত থেকে প্রাচীনকালে মানুষ প্রদীপ জ্বালিয়ে কীট নিধন করত, আর সেই থেকেই ওই সময়ে প্রদীপ জ্বালানোর রীতি শুরু হয়ে যায়।
◗ কালীপুজোতে অনেকের ঘরে অলক্ষ্মী পুজো হয় কেন?
প্রধানত বাঙালি হিন্দুদের মধ্যে কালীপুজো উৎসব উপলক্ষে প্রবল উদ্দীপনা লক্ষিত হলেও অনেকের ঘরে সেই দিন অলক্ষ্মী পুজো করা হয়ে থাকে। এই অলক্ষ্মী পুজো করার মধ্যে একটি কাহিনি আছে। পুরাণ থেকে জানা যায়, ‘অলক্ষ্মী’ হলেন দেবী লক্ষ্মীর জ্যেষ্ঠা ভগিনী। লক্ষ্মীদেবী, যেমন সমুদ্র মন্থনের সময়ে তুলে এনেছিলেন অমৃতের কলস ঠিক তেমনই ‘অলক্ষ্মী’ সমুদ্র থেকে বিষের পাত্র তুলে এনেছিলেন। আবার শোনা যায়, লক্ষ্মীর জন্ম, ব্রহ্মার মুখের জ্যোতি থেকে এবং অলক্ষ্মীর জন্ম ব্রহ্মার মাথার পিছনের অন্ধকার থেকে। যেহেতু দেবী লক্ষ্মী এবং অলক্ষ্মীর সহাবস্থান একই সঙ্গে ঘটে, তাই অশুভ শক্তির বিনাশের জন্যই এই বিশেষ দিনটিতে অলক্ষ্মী পুজো করা হয়।
ইনি লক্ষ্মীদেবীর বিপরীত চরিত্রে অবস্থান করেন। আসলে লক্ষ্মী ও অলক্ষ্মী আমাদের মনের দুটি স্বত্তা মাত্র। পুরাণে আছে, অলক্ষ্মীর স্বভাব ও স্বরূপ হল অবিন্যস্ত চুল, গায়ের রং ময়লা, ছন্নছাড়া ও অপরিচ্ছন্ন। অপরদিকে হিংসা, ঝগড়া, ঈর্ষাও অলক্ষ্মীর বিশেষ স্বভাব। এছাড়াও অলক্ষ্মীর বাসস্থান হল অন্ধকার জায়গায়, তাই মনের অন্ধকার, ঈর্ষা মলিনতা ও আসন্ন দুর্ভাগ্যকে ‘অলক্ষ্মী পুজো’ করে দূরিভূত করে ধন ও সৌভাগ্যের দেবী ‘লক্ষ্মীর আরাধানা’ করে ঘরে সুখ ও সমৃদ্ধির প্রতিষ্ঠা করা হয়। মনের ঈর্ষা, অহঙ্কার যাতে আমাদের মনুষ্যত্বকে গ্রাস করতে না পারে, তাই কালীপুজোর দিনে অনেকের ঘরে অলক্ষ্মী পুজো করার প্রচলন আছে।
◗ দশমহাবিদ্যা কি?
সংস্কৃত ‘মহা’ শব্দের অর্থ হল মহৎ বা মহান এবং ‘বিদ্যা’ শব্দের অর্থ হল রূপ বা প্রকাশ। এর সঙ্গে দশ (সংখ্যা) যুক্ত হয়ে ‘দশমহাবিদ্যা’ হয়েছে। হিন্দুধর্মে দেবীর দশটি রূপের সমষ্টিগত নাম–ই হল দশমহাবিদ্যা। মুণ্ডমালা তন্ত্র অনুযায়ী দশমহাবিদ্যা হলেন:—
(১) কালী– জন্ম ও শক্তির দেবী।
(২) তারা– রক্ষাকারিণী, বিশ্বের উৎস হিরণ্যগর্ভের শক্তি ও মহাশূন্যের প্রতীক।
(৩) ষোড়শী– পূর্ণতার স্বরূপ মাত্র। ইনি ত্রিপুরাসুন্দরী নামেও পরিচিত।
(৪) ভুবনেশ্বরী– পার্থিব জগতের শক্তিসমূহের প্রতীক।
(৫) ভৈরবী– ইনি কামনা ও প্রলোভনের স্বরূপ যা মৃত্যুর দিকে টেনে নিয়ে যায়।
(৬) ছিন্নমস্তা– চক্রপথে আত্মধ্বংস ও আত্মপুনরুজ্জীবনের মাধ্যমে সৃষ্ট জগতের অবিরাম বিদ্যমানতার শক্তির প্রতীক।
(৭) ধূমাবতী– অগ্নির দ্বারা জগৎ ধ্বংসের পর ভস্মরাশির মধ্যে থেকে যে ধূম (বা ধোঁয়া) নির্গত হয়, তার স্বরূপই হল ধূমাবতী। ইনি ‘অলক্ষ্মী’ নামেও পরিচিত।
(৮) বগলা– ঈর্ষা, ঘৃণা বিভিন্ন চরিত্রের দিকগুলো উনি নিমন্ত্রণ করেন। উত্তর ভারতে ইনি পীতাম্বরী নামেও পরিচিত। বগলামুখী শব্দটি ‘বগলা’— যার অর্থ ‘ধরা’ এবং মুখ শব্দদুটি থেকে উৎপন্ন হয়েছে। অর্থাৎ ইনি তাঁর মুখ কোনও কিছুর নিয়ন্ত্রণের জন্য নিজের হাতে তুলে নিতে সমর্থ।
(৯) মাতঙ্গী– কর্তৃত্ব শক্তীর দেবী। ইনি জাতিহীন দেবী।
(১০) কমলা– ইনিই ভাগ্যদেবী লক্ষ্মীর অন্যরূপ।
এক্ষেত্রে জানিয়ে রাখি, মহাবিদ্যার সংখ্যা নিয়েও ভিন্ন মত রয়েছে। একটি মতে, মহাবিদ্যার সংখ্যা ২৭ বলা হয়েছে। কামাখ্যা, দুর্গা, অন্নপূর্ণা–ও মহাবিদ্যা হিসেবে বিবেচিত হয়েছে। আবার মালিনী বিজয় গ্রন্থ অনুযায়ী, দ্বাদশ মহাবিদ্যা হলেন:— কালী, নীলা, মহাদুর্গা, ত্বরিতা, ছিন্নমস্তিকা, বাগাদিনী, অন্নপূর্ণা, প্রত্যঙ্গিরা, কামাখ্যাবাসিনী, বালা, মাতঙ্গী এবং শৈলবাসিনী।
সব ছবি: আন্তর্জাল
তথ্যসূত্র: ইন্টারনেট ও বিভিন্ন ওয়েবসাইট থেকে গৃহীত
(এই লেখাটি কাউকে কোনও অসৎ উদ্দেশ্যে লেখা নয়)
Leave a Reply
Your email address will not be published. Required fields are marked *
Comments