৩৫০ বছর পেরিয়েও
অটুট সেই আড়ম্বর, নিষ্ঠা

কালি কলম মনন–এর প্রতিবেদন:‌ দেবীর স্বপ্নাদেশে ওপার বাংলায় শুরু হওয়া ঐতিহ্যবাহী ভোজেশ্বর পালচৌধুরি পরিবারের পুজো এবার ৩৫৫ বছরে। সাধারণত দুর্গার ডানদিকে লক্ষ্মীর পাশে থাকে গণেশ আর বাঁদিকে সরস্বতীর পাশে থাকে কার্তিক। কিন্তু এখানে ডানদিকে লক্ষ্মীর পাশে কার্তিক ও বাঁদিকে সরস্বতীর পাশে গণেশ— স্বপ্নে এভাবেই ছেলে–মেয়েদের নিয়ে দেখা দিয়েছিলেন মা দুর্গা। সেই রীতি আজও অক্ষুন্ন। দেবীর আশীর্বাদে ব্যবসার বিপুল মুনাফা দিয়েই শুরু হয় মা দুর্গার আরাধনা। এরপর তাঁদের উন্নতির অশ্বমেধের ঘোড়া ছুটতে থাকে। তাঁরা হন ভোজেশ্বরের জমিদার। পরবর্তীকালে ইংরেজদের কাছ থেকে পান ‘‌চৌধুরি’‌ উপাধি।

দেশভাগের পর এপার বাংলায় স্থানান্তরিত হয় পুজো। ওপার বাংলা থেকে ঘটের মাটি এনে পুজো প্রতিষ্ঠিত হয় এপার বাংলায়। পুজো পরিচালনা ও দেখভালের জন্য রয়েছে ট্রাস্টি বোর্ড। শরিকি এই পুজো পালা করে অনুষ্ঠিত হয়। সবচেয়ে কম ৪ বছর এবং সবচেয়ে বেশি ১৬ বছরের পালা। অর্থাৎ কোনও শরিকের বাড়িতে ৪ বছর অন্তর আবার কোনও শরিকের বাড়িতে ১৬ বছর অন্তর পুজো অনুষ্ঠিত হয়। শরিকদের ভাগ করা হয়— পুবেরদ্বার, পশ্চিমেরদ্বার, উত্তরেরদ্বার ও দক্ষিণেরদ্বারে। কোন দিকে কোন শরিকের বাড়ি সেই অনুযায়ী পুজোর স্থান পরিবর্তন হয়। ঠিক যেভাবে ওপার বাংলায় হতো।

এ বছর পুজো অনুষ্ঠিত হল শোভাবাজারে। রূপোর অলংঙ্কারে সাজানো হয় মা দুর্গাকে। খাঁড়া থেকে ত্রিশূল, পদ্ম সবই রূপোর। মায়ের জন্য একেকদিন একেকরকম ভোগের ব্যবস্থা থাকে। যেমন মন্ডা–মিঠাই, ক্ষীর, ছানা, নানারকম সন্দেশ, উপ্‌রা ইত্যাদি। রোজই মাকে উৎসর্গ করা হয় কুমড়ো, চাল কুমড়ো, মানকচু, নারকেল, বাতাবি লেবু ও আখ। মহালয়ার আগে পঞ্জিকানুযায়ী শুভ তিথিতে পরিবারের সব মহিলা সদস্যরা‌ এক জায়গায় মিলিত হয়ে বানান দুর্গা ও লক্ষ্মী পুজোর নারকেল নাড়ু, ক্ষীরের নাড়ু, মোয়া, উপ্‌রা ইত্যাদি।

পুজোর দিনগুলোতে রোজই ভালো–মন্দ খাবারের বন্দোবস্ত থাকলেও এলাহি আয়োজন নবমীর দিন। মেনুতে থাকে ইলিশ মাছের পদ আর দশমীতে পুঁটি মাছ ভাজা। পরিবারের রীতি মেনে দশমীর পর আর বাড়িতে আসে না ইলিশ মাছ। আবার ইলিশের আগমন হয় পরের বছর ১লা মাঘ। এই পুজো যদি ঢাকার না হয়ে, কলকাতায় শুরু হতো, তাহলে এটি পশ্চিমবঙ্গের অন্যতম প্রাচীন পুজোর মধ্যে পড়ত।

ভোজেশ্বর পালচৌধুরি পরিবারের পুজোর অন্যতম এক আচার ‘টাকা–যাত্রা’। আগেকার দিনে ব্যবসা করতে যাওয়াকে ‘টাকা–যাত্রা’ বলা হত। তখন মানুষজন ব্যবসার কাজে দু–তিন মাসের জন্য বাইরে যেতেন। তখনকার দিনে বাড়িতে থাকা স্বর্ণমুদ্রা মা দুর্গার পায়ে ছুঁয়ে বাড়িতে রাখা থাকত। সেই মুদ্রায় প্রণাম করে ব্যবসার কাজে যেতেন তাঁরা। পালচৌধুরি পরিবারে এখনও চলে আসছে সেই ‘টাকা–যাত্রা’–র রীতি। মায়ের পায়ে ছোঁয়ানো হয় সোনা, রূপো বা অন্য ধাতুর মুদ্রা। দশমীর দিন দর্পণ বিসর্জনের পর হয় এই ‘টাকা–যাত্রা’।

দশমীর দিন নিয়ম মেনে দর্পন বিসর্জন এবং পঞ্জিকার সময় অনুযায়ী ঠাকুর বিসর্জন। বিসর্জনের পর সিঁদুর খেলা এবং তারপর সন্ধ্যায় শান্তি আশীর্বাদ। নবমীতে হোমের তিলক এই শান্তি আর্শীবাদেই দেওয়া হয়। মূলঘট বিসর্জন দেওয়া হয় না। সেই ঘটেই হয় লক্ষ্মীপুজো। লক্ষ্মীপুজোর সরায় আঁকা থাকে দুর্গার চালচ্চিত্র। এক কথায় বলতে গেলে ভোজেশ্বর পালচৌধুরি পরিবারের পুজোয় যেমন আছে আড়ম্বর, তেমনই আছে নিষ্ঠা। ‌

সব ছবি: কৃশাণু মোদক

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *