ভাইফোঁটার বিবর্তন
ঐন্দ্রিলা বন্দ্যোপাধ্যায়
ভাইয়ের কপালে দিলাম ফোঁটা
যমের দুয়ারে পড়ল কাঁটা,
যমুনা দেয় যমকে ফোঁটা,
আমি দিই আমার ভাইকে ফোঁটা।
চিরাচরিত কাল থেকে চলে আসা ভাইয়ের মঙ্গলকামনায় বোনেদের এই শুভকামনা আজ সময়ের সঙ্গে সঙ্গে অনেকটাই পাল্টেছে। যমুনা যেমন আজন্মকাল যমরাজকে ফোঁটা পরিয়ে বাঁচিয়ে রেখেছে, উল্টোদিকে মর্ত্যবাসী বোনেরাও তাদের ভাইদের যমরাজের কবল থেকে দূরে রাখার জন্য এই অনুষ্ঠানটি পালন করে চলেছে, তা সে যে যেমনভাবে পারে তেমন ভাবেই।
মনে পড়ে, ফেলে আসা শিশুকালের দিনগুলো। মামাবাড়িতে কালীপুজো হত, আমরা সব ভাইবোন একজোট হতাম সেই পুজোকে কেন্দ্র করে। পুরোহিত আসনে স্বয়ং দাদু–ই। আমরা নাতি–নাতনিরা প্রতিমা কেনা, পুজোর জোগাড় এই সব কিছুতে হাত লাগাতাম। বড়রা উপোস করে থাকত সেই রাত অবধি। পুজো শেষ না হওয়া পর্যন্ত তারা শুধু সরবত খেত। আমাদের ছোটদের সে সবের কোনও বালাই ছিল না।
আমরা ছিলাম কাঠবাঙাল। মামাবাড়ির দেশ ছিল ঢাকা। ভাইফোঁটা হত প্রতিপদে। তাই কালীপুজোর পরের দিন ভাইফোঁটার অনুষ্ঠান কাটিয়ে, তারপর যার যার বাড়ি ফেরা। বছরের ওই একটি দিনে সব ভাইবোনদের এক জায়গায় পাওয়া যেত। সেই অনুষ্ঠানে কুশীলবের সংখ্যা নেহাত কম ছিল না। বয়সের নিরিখে একেবারে কুঁচোকাঁচা থেকে শুরু করে ছিল বুড়োবুড়ি, ধুত্তেরি কী যে বলি, দাদু–দিদা।
মায়েরা ছিল তিন বোন, এক ভাই। অতএব তিন জামাই, এক শালা বউ। সবার দুটি করে সন্তান, অতএব আট ভাইবোন। এখানে স্বল্প বিরতি। এবার এল দাদু–দিদাদের পালা। আমরা পাঁচ নাতনি মিলে দাদুকে ফোঁটা দিতাম। দাদুরা সাত ভাই এক বোন ছিল। তাই দাদুর সেই একমাত্র বোনকে আমরা ডাকতাম চম্পাদিদা বলে। হিন্দমোটর থেকে মায়ের এই পিসি চলে এল দাদুকে ফোঁটা দিতে। বাকি ভাইরা দূরে দূরে থাকত, তাই আমাদের নিজের দাদুকেই একমাত্র দেখতাম ফোঁটার দিনে। দিদার নিজের এবং জেঠতুতো মিলিয়ে চারভাইকে আসতে দেখতাম। দাদুদের মেলা লেগে যেত। অনেক বছর পরেও দেখেছি বাবুয়ামামা (ফসফরাস টু হান্ড্রেড) দাদুকে ধরে ধরে ওইদিন নিয়ে আসত, দিদির হাতে দাদু ফোঁটা নেবেন বলে। তিনি ছিলেন হোমিওপ্যাথি ডাক্তার। টুকটাক অসুখে মায়ের আবদারে মুখে মুখেই অনেক ওষুধের নাম বলে দিতেন, আমরা তাই ওনার ওইরকম নামকরণ করেছিলাম।
ফোঁটার দিনে ব্যস্ততা লেগে থাকত সকাল থেকেই। আমাদের ওপর দায়িত্ব ছিল দূর্বাঘাস বেছে নিয়ে আঁটি বেঁধে রাখা। বাগান থেকে মুঠো ভরে ঘাস তুলে এনে তা বাছাই করে রাখা এ এক ঝক্কির কাজ ছিল। তিনটে শিষ রাখতে গিয়ে কখনও একটা বা দুটো ছিঁড়ে যেত। অনেক কসরত করে তা অবশেষে পাতে দেওয়ার উপযোগী হত। এরপর চন্দন বাটা পর্ব। লাল ও শ্বেত চন্দন বেটে দুটো বাটিতে রাখা হতো। শেষমেষ যখন থালাটি গুছিয়ে রাখা হতো, দেখতে ভারী সুন্দর লাগত। ঘি, শ্বেতচন্দন, রক্তচন্দন ও কাজলপাটা। তার পাশে ধান, দূর্বা। বড় পেতলের প্রদীপ ছিল, তাতে সরষের তেল ঢেলে আগুন দিয়ে ধরানো। আমরা মাঝে মাঝে একটা ছোট কাঠি দিয়ে পলতেটা একটু এগিয়ে দিতাম, শিখাটিকে একটু উসকে দেবার জন্য।
উপহার প্রদানের আয়োজন কিছু কম ছিল না। তবে খুব দামী উপহার দেবার চল তখন ছিল না। দেওয়া হতো ঘর গৃহস্থালি, সংসারের প্রয়োজনীয় জিনিস। নকশা করা বাটি, হাতা, জলখাবারের প্লেট এই সবই। ছেলেদের জন্য বরাদ্দ গেঞ্জি, লুঙ্গি, বড়জোর ফতুয়া বা পাঞ্জাবি। দাদু আমাদের নাতনিদের হাতে দিতেন নতুন চকচকে দশ টাকার নোট। সেই সময়ে ওই মনে হতো কত্ত টাকা। ছোট মাসি মজা করে বলতো, ‘আচ্ছা বাবা প্রতিবারই দেখি একই, বাজেটটা একটু বাড়াতে পারো তো।’ দাদু মিটিমিটি হাসতেন।
সন্ধে হলে শতরঞ্জি পেতে টানা সবাই বসে পড়তো। একবারে সবার বসার জায়গা হতো না। ফোঁটা নেওয়ার একটা ব্যাচ শেষ হলে পরেরটা। আমরা ছোটরা অগ্রাধিকার পেতাম। তিনটি ভাই আর দাদু এক সারিতে বসে পড়লে আমরা পাঁচ বোন একেকটা কপাল আঙুলের কাছে পেয়ে পরপর ফোঁটা পরিয়ে যেতাম। পাশে দাঁড়িয়ে চম্পাদিদা ফোঁটার এক বিরাট মন্ত্র ছিল, সেইটা জোরে জোরে আউড়ে যেত। আমরা কান খাড়া করে রাখতাম, যেই শেষ লাইনটা আসত, ‘আমি দিই আমার ভাই... কে ফোঁটা।’ শূন্যস্থানে যেই দিদি যে ভাইয়ের কপালে হাত ছুঁইয়ে রেখেছে, তার নামটা টক করে বলে দিত। পরের ব্যাচে মা, মাসি, মামাদের পালা। তিন জামাই, আর মামা পাশাপাশি বসার পর ওই একইভাবে দেওয়া হতো ফোঁটা। যে যার বরকে বাদ রেখে বাকি ভগ্নীপতি ও ভাইকে ফোঁটা দিত। তারপর হাতে হাতে উপহার বুঝে নেবার পর্ব ছিল। শেষ ব্যাচে দাদুদের দিদার ফোঁটাদান। ফোঁটার আসনে বসে কোনও এক দাদু, দিদার হাতে ফোঁটা নেওয়ার পর চোখ ছলছল করে ফেলত, ‘আগামী বছর তোর হাতে ফোঁটা নিতে পারব কি? বয়স হচ্ছে যে।’ কত আবেগ, কত ভালোবাসা মেশানো ছিল সেইসব দিনগুলোতে।
খাওয়া–দাওয়ার আয়োজনেও কিন্তু কিছু কমতি ছিল না। সামনে মিষ্টির থালা সাজিয়ে ফোঁটা হত বটে, কিন্তু তারপর ছিল ভুরিভোজের ব্যবস্থা। শুক্তো দিয়ে শুরু করে, চাটনি ও পায়েস দিয়ে শেষ, আর থাকতো কতজনের আনা কত রকমারি মিষ্টি।
এরপর আমাদের দাদু গত হলেন। কালীপুজো বন্ধ হল। কালীপুজোর হাত ধরে আসা সেই প্রতিপদের ভাইফোঁটার দিনও ম্রিয়মাণ হয়ে গেল। ভাইরা একে একে বড় হল, পড়াশোনা বা চাকরি সূত্রে বাইরে গেল, বাঁধন হল আলগা। ভাইফোঁটার ধরন গেল বদলে। দিদিদের বাড়ি ঘুরে ঘুরে যদি ভাইরা কখনও ফোঁটা নিতে আসতো তখনই তা হত।
একবার পুজোর ছুটিতে পুরী ঘুরতে গেছিলাম, কথা ছিল কালীপুজোর আগেই ফিরব। যদিও মামাবাড়িতে পুজো ততদিনে বন্ধ। তাই ফেরার তেমন কোনও তাড়া না থাকায় শেষে বেশিদিন থাকায় সাব্যস্ত হল। অথচ ফোঁটার দিন ফোঁটা দেবো তার তো কোনও ব্যবস্থাই নেই। ব্যাংকের হলিডে হোমে উঠেছি, রান্নার উপকরণের ভেতর ছিল ঘি আর সাজগোজের বাক্সে ছিল কাজল। কিন্তু, তিন নম্বর আরেকটা কিছু তো চাই, কারণ ফোঁটা দেব তিনবার। আর কিছু হাতের কাছে না পেয়ে ফেয়ার অ্যান্ড লাভলি ক্রিমের একটা ফোঁটা পরিয়ে দিলাম ভাইয়ের কপালে। সে বার ছিল না কোনও ধান দূর্বা, না ছিল প্রদীপের আলোর ব্যবস্থা।
এরপর ভাই যখন চাকরি সূত্রে হায়দ্রাবাদ গেল তখনও ফোঁটা দেওয়া হত, কিন্তু তা একেবারেই আড়ম্বরহীন ভাবে। বাহ্যিক বাহুল্যবর্জিত এক আবেগমিশ্রিত মুহূর্ত।
সেসব ছবি আর ক্যামেরা বন্দি করে রাখা হয়নি। দেওয়া হয়নি ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপ বা ইনস্টাগ্রামে। মনের ভেতরেই গেঁথে আছে সেইসব দিনগুলো। আজ তো সবই নেটবন্দী। ফেসবুক ভর্তি রাশি রাশি ছবি। হোয়াটসঅ্যাপেও ক্রমাগত আসা যাওয়া করতে থাকে ভাইফোঁটার শুভেচ্ছাবার্তা নানারকম ছবি ও প্রতিকৃতির মাধ্যমে। এদিক–ওদিক ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে কত পাতানো দাদা, কত ভাই। কতজনকে তো চোখেই দেখিনি। না হয়েছে কথা। কেউ মনে করছে প্রিয় দিদিভাই, কেউ বা শালী। কিন্তু কপালে সেই উষ্ণ ছোঁয়ার হাতটুকু আর পড়ছে না, সবকিছুই বড় শীতল। পরিবার, পরিজন, চাকরি সব কিছু নিয়ে ভাইদের ব্যস্ততা এতটাই বেড়ে গেছে যে, সারা বছরে না হলেও এই একটি দিনেও মোবাইল ফোনে না আসে কোনও মেসেজ না একটা ফোন কল। তবুও দিদি মনে মনে বলে যায়— ভাইয়ের কপালে দিলাম ফোঁটা, যমের দুয়ারে পড়ল কাঁটা।
সব ছবি: আন্তর্জাল
Leave a Reply
Your email address will not be published. Required fields are marked *
Comments