ইউনিভার্সাল হিরো
ডঃ সঞ্জীব রায়
আমেরিকার ৪৫তম রাষ্ট্রপতি ডোনাল্ড ট্রাম্প সম্পর্কে শত্রু–মিত্র সবাই একটি ব্যাপার অকপটে স্বীকার করত যে, ট্রাম্প নিজেকে ছাড়া কখনও কাউকে প্রশংসা করেন না। এহেন ব্যক্তি ২০১৯ সালের অক্টোবর মাসে বিশেষ কাউকে ‘আমেরিকান হিরো’ বলাতে স্বভাবতই বেশ আলোড়ন সৃষ্টি হয়। নানাভাবে অনুরোধ করা সত্ত্বেও ট্রাম্প কিন্তু সেই হিরোর নাম প্রকাশ্যে আনেননি। পরবর্তীকালে জানা যায় যে সেই হিরো হল ‘কোনান’, যে কিন্তু আদৌ মানুষ নয়।
স্বভাবতই কৌতূহল জন্মায় ‘কোনান’ তাহলে কে? জানা যায় সে বেলজিয়ান ম্যালিনয় প্রজাতির এক সারমেয়। এই কোনানের জন্যই মৃত্যুবরণ করতে হয় আমেরিকার মাথাব্যথা আইএস প্রধান আবু বকর আল বাগদাদিকে। তিনি সিরিয়ার ইদলিবে মাঝরাতে মার্কিন সেনাবাহিনীর দ্বারা পরিবেষ্টিত অবস্থায় বিশেষ ধরনের জ্যাকেট পরিহিত হয়ে বাধ্য হন নির্দিষ্ট বোতাম টিপে নিজেকে উড়িয়ে দিতে। তাঁকে সুড়ঙ্গের মধ্যে খুঁজে বের করার সম্পূর্ণ কৃতিত্ব ছিল ‘কোনান’–এর। বাগদাদির নিজেকে উড়িয়ে দেবার সময় প্রায় লেপটে থাকা সারমেয় কোনান নিজেও মারাত্মকভাবে আঘাতপ্রাপ্তও হয়। সে পরবর্তীকালে সুস্থ হলেও তার চলনশক্তি সম্পূর্ণ হ্রাস পেয়েছিল।
আমরা যদি আরও খানিকটা পিছিয়ে যাই তবে একই ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি দেখতে পাব। ২০১১ সালে পাকিস্তানের অ্যাবটাবাদে লাদেন বধ অভিযানেও সেনাবাহিনীকে সঙ্গ দিয়েছিল ম্যালিনয় প্রজাতির এক সারমেয়। সেই চিনিয়ে দেয় অন্ধকারে সুড়ঙ্গের পথ। স্বভাবতই কৌতুহল হয় এই প্রজাতির সারমেয় সম্পর্কে। এদের উচ্চতা মোটামুটি ২২ থেকে ২৬ ইঞ্চি। স্বাভাবিক ওজন ২৫ থেকে ৩৫ কেজি। ৩০/৪০ কিলোমিটার ছুটে টার্গেটের কাছে চলে যাওয়া এদের কাছে নিতান্তই ছেলেখেলা। এদের চেহারার সঙ্গে জার্মান শেফার্ডের কিছু মিল থাকলেও এরা তাদের থেকেও বেশি আগ্রাসী। জঙ্গি দমনে কারা এদের প্রথমে ব্যবহার করেছিল সেই নিয়ে অবশ্য বিতর্ক আছে। বিতর্কটা মূলত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইজরায়েলের মধ্যে।
বর্তমানে অবশ্য এই প্রজাতির সারমেয়রা ভারতবর্ষে খুবই ব্যবহার হচ্ছে। সিআরপিএফ, এনএসজি থেকে শুরু করে সুন্দরবনে চোরা শিকার বন্ধে এরাই ভরসা। ইদানিং নবান্নেও এদের দেখা মেলে। ভারতে ২০১৬–তে পাঠানকোটে জঙ্গি হামলার সময় এরা প্রচণ্ডভাবে কাজে এসেছিল। দুঃখজনক ঘটনাটি ঘটে ২৯–০৭–২২ তারিখে বারামুলায়। জঙ্গি অভিযানে গিয়ে প্রাণ হারাতে হল অ্যাক্সেলকে। জাতিগতভাবে সেও ছিল বেলজিয়ান ম্যালিনয় সম্প্রদায়ভুক্ত। অ্যাক্সেল ছিল যথেষ্ট সতর্ক এবং ক্ষিপ্ত। মাত্র কিছুমাস আগেই সে সোপারের তুলিবান এলাকায় একটি এনকাউন্টার থেকে দুই জঙ্গি নিধনে নেতৃত্ব দেয়। তার শরীরে লাগানো থাকত ক্যামেরা। এই ক্যামেরাই জঙ্গিদের চিনিয়ে দিত।
গত ২৯ তারিখেও অ্যাক্সেল একইভাবে সেনাবাহিনীকে পথ দেখিয়েছিল। সে লোকেশন ট্র্যাক করে গন্তব্যে পৌঁছয়। পৌঁছোনো মাত্র উভয়দিক থেকে গুলি চলতে থাকে। এনকাউন্টার ছিল ঘণ্টা পাঁচেকের মতন। এনকাউন্টার থামার পর দেখা যায় দু’জন জঙ্গি পালিয়েছে। তাদের মধ্যে অন্যতম হুসেন ভাট। এনকাউন্টার চলাকালীন হঠাৎ একজনের মনে পড়ে কী হল! অ্যাক্সেলের সেই বিখ্যাত ডাক তো আর শোনা যাচ্ছে না। বিস্তর খোঁজাখুঁজির পরে ঘরেই মেলে গাঢ় বাদামি রঙের ধনুকের মতন বাঁকানো পিঠ ভেসে যাচ্ছে জমাটবাঁধা রক্তে। ময়নাতদন্তের রিপোর্ট বলেছিল শরীরে অন্তত ১০টি ক্ষতচিহ্ন ছিল। অনেকগুলো হাড় ভাঙা। মাথা থেকেই তিনটি কার্তুজ মেলে। মাত্র দু’বছর আগেই ২৬ নম্বর আর্মি ডগ ইউনিটের সদস্য হয়েছিল অ্যাক্সেল। তাঁর মৃত্যুতে ২৯ রাইফেলস-এ গভীর শোকের ছায়া নেমে আসে।
প্রতিবেদন শেষের আগে বেলজিয়ান ম্যালিনয় সম্পর্কে আরও কিছু তথ্য উল্লেখ করা বিশেষ প্রয়োজন। বিশ্বব্যাপী কোভিড আতঙ্ক শুরু হবার কিছুদিন পর থেকেই বিজ্ঞানীরা বলতে শুরু করেছিলেন যে, কোভিড রোগী নির্ধারণ করতে সারমেয়দের কাজে লাগানো যেতে পারে। অতীতে দেখা গিয়েছিল যে সারমেয়দের দ্বারা অতি সহজেই কোলন ক্যান্সার, ম্যালিগন্যান্ট টিউমার, ডায়াবেটিস, কোলাইটিস, টিবি, মৃগী বা ম্যালেরিয়ার রোগী নির্ভুলভাবে শনাক্তকরণ সম্ভব হয়েছিল। বিজ্ঞানীরা আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে বলেছিলেন যে সারমেয়দের দ্বারা করোনা রোগী শনাক্ত করাও নিশ্চিতভাবেই সম্ভব হবে কারণ তাদের কাছে আছে ৩০কোটি সেন্ট রিসেপ্টর যেখানে মানুষের থাকে মাত্র ০.৫ কোটি। পরবর্তীকালে প্রমাণিত হয় যে বিজ্ঞানীরাই একেবারে সঠিক। আবিষ্কার হয় করোনা রোগীদের গায়ে এক বিশেষ ধরনের গন্ধ হয় যা সাধারণ মানুষের পক্ষে বোঝা বেশ অসম্ভব।
সারমেয়দের সেই গন্ধ পরিচয় করিয়ে দিলেই কেল্লাফতে। এই গন্ধকে সঠিকভাবে নিতে সক্ষম এমন পৃথিবীর বিভিন্ন প্রজাতির মধ্যে ছ’টি প্রজাতির কুকুরকে চিহ্নিত করা হলেও দেখা গেল তাদের মধ্যে পয়লা নম্বর দক্ষ বেলজিয়ান ম্যালিনয় প্রজাতির সারমেয়কুল। বোধকরি তাদের সেন্টরিসেপ্টর নিশ্চিতভাবেই অন্যান্য প্রজাতিদের থেকেও অনেকটাই বেশি।
ছবি সৌজন্যে: আন্তর্জাল
Leave a Reply
Your email address will not be published. Required fields are marked *
Comments