বার্লিন
স্মৃতি ও শিল্পকর্মের মেলবন্ধন 
ডঃ সঞ্জীব রায়     

বসে আছি দোহার হামাদ বিমানবন্দরে। ঘড়িতে সময় দেখাচ্ছে বেলা বারোটা। ভারতীয় সময় থেকে এরা ঠিক আড়াই ঘণ্টা পিছিয়ে। আমাদের গন্তব্য বার্লিন হয়ে মধ্য–ইউরোপের বেশ কয়েকটি বিখ্যাত শহর যেমন ড্রেসডেন, সালসবুর্গ, ভিয়েনা, বুদাপেস্ট, প্রাগ, ব্রাতিস্লাভা, ক্র্যাকাও এবং সর্বশেষে ওয়ার্স। দোহায় বার্লিনগামী বিমান ধরার জন্য আমাদের পাক্কা সাত ঘণ্টা অপেক্ষা করতে হল। নানানরকম দোকান ঘুরে, ফটো তুলে, নতুন সঙ্গীদের সঙ্গে পরিচয় পর্ব সেরেও সময় যেন আর কাটে না। ভ্রমণের শুরুতেই ডলার খরচ করে চা খেতেও মন চায়না। সবাই মিলে ট্যুর ম্যানেজারকে অনুরোধ করাতে চা অনুমোদন হল। একেক জনকে বিশাল কাপে এক কাপ করে দুধ চা। সেও এক বিড়াম্বনা। এত চা খেয়ে শেষ করাই যাচ্ছে না! 

বার্লিন ক্যাথিড্রাল

শেষ পর্যন্ত দীর্ঘ অপেক্ষার ইতি। বার্লিন যাবার বিমান ছাড়ল। দোহা থেকে বার্লিন যেতে সময় লাগল ৫ ঘণ্টার একটু বেশি। বার্লিনের টেজেল বিমানবন্দরে নেমে ঘড়িতে দেখলাম ওখানকার সময় রাত্রি ৭টা। বিমানবন্দরের নিয়মকানুন সেরে লাগেজ নিয়ে বাইরে এসে দেখি তখনও দিনের আলো পরিষ্কার। পশ্চিমের দেশগুলির এই এক মজা! অরুণদেব সাধারণত শীতকাল ছাড়া রাত দশটার আগে অস্ত যান না। বাইরে দেখলাম লিমুজিন বাস আমাদের জন্য সাগ্রহে অপেক্ষারত। আমরা সদলবলে লাগেজ নিয়ে উঠে পড়লাম। আলাপ হল বাসের সারথী মিঃ কালিস এবং গাইড মিঃ জনের সঙ্গে। পাক্কা একঘণ্টা লাগল হোটেলে পৌঁছতে। এই এক ঘণ্টায় গাইডের কাছ থেকে শুনে নিলাম বার্লিনের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস।

ওবারবাম ব্রিজ

বার্লিন অত্যন্ত পুরনো ও ঐতিহ্যমন্ডিত শহর। দ্বাদশ শতাব্দীর শেষের দিকে এই শহরের জন্ম। তারপর দীর্ঘ পথ অতিক্রম করে, বিভিন্ন ঘাত প্রতিঘাতের মাধ্যমে বার্লিন পৃথিবীর এক অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ শহর হিসাবে পরিচিতি লাভ করে। ১৮০৬ সালে সম্রাট নেপোলিয়ন এই শহর দখল করেন। ১৮১৫ সালে শহরটি ব্রান্ডেনবার্গ প্রদেশের অন্তর্গত একটি শহর হিসাবে পরিগণিত হয়। উনবিংশ শতাব্দীতে শিল্পবিপ্লবের পর থেকেই বার্লিন খুব দ্রুত অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক দিক থেকে অত্যন্ত উল্লেখযোগ্য ও গুরুত্বপূর্ণ শহর হিসাবে আত্মপ্রকাশ করে। ফলস্বরূপ, ১৮৭১ সালে বার্লিন জার্মান সাম্রাজ্যের রাজধানী হিসাবে বিবেচিত হয়। ওই সালেই ব্রান্ডেনবার্গ প্রদেশ থেকে বেরিয়ে বার্লিন স্বতন্ত্র প্রদেশ হিসাবে গড়ে ওঠে। তখন বার্লিনের আয়তন ছিল ৬৬ বর্গকিলোমিটার। ১৯২০ সালে গ্রেটার বার্লিন অ্যাক্ট চালু হয়। সেই অ্যাক্ট অনুযায়ী বার্লিনের অন্তর্গত এলাকা ৬৬ থেকে ৮৮৩ স্কোয়্যার কিলোমিটার পর্যন্ত বিস্তৃত হয়। অ্যালবার্ট আইনস্টাইন এই শহরে থাকাকালীন ১৯২১ সালে পদার্থবিদ্যায় নোবেল পুরস্কার পান।    

ব্রান্ডেনবার্গ গেটে ঘোরার গাড়ির সামনে

১৯৩৩ সালে হিটলার জার্মানির সর্বেসর্বা হয়ে ক্ষমতায় এলেন। তিনি ক্ষমতায় আসার পরেই তার ইহুদী বিদ্বেষ মাথা চাড়া দেয়।। সেই সময়ে বার্লিনে ইহুদী জনসংখ্যা ছিল ১,৬০,০০০। ১৯৩৩ সাল থেকে ১৯৩৯ সালের মধ্যে ইহুদী জনসংখ্যা ৫০ শতাংশে নেমে আসে। আশি হাজার ইহুদীদের বার্লিন ছাড়তে বাধ্য করা হয়। ১৯৩৯ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়। ১৯৪৩ সাল থেকে ১৯৪৫ সালের মে মাসের আগে অবধি অর্থাৎ যুদ্ধ শেষ হবার আগে অবধি বার্লিন শহরের উপর মিত্র শক্তি ব্যাপকভাবে বোমাবর্ষণ করে। ৬৭,৬০৭ টন বোমা নিক্ষেপে শহরের ৬৪২৭ একর জমি সম্পূর্ণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ১২৫,০০০ জন অসামরিক ব্যক্তির মৃত্যু হয়। যুদ্ধশেষে মিত্রশক্তি বার্লিনে ঘাঁটি গেড়ে বসে। ১৯৪৯ সালে ফেডারেল রিপাবলিক অফ জার্মানির (পশ্চিম জার্মানি) সৃষ্টি হয়। তাদের রাজধানী হয় বন্‌ (Bonn)। অন্যদিকে সোভিয়েত প্রভাবিত জার্মান গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র বা পূর্ব জার্মানির রাজধানী হল বার্লিন। বার্লিন দুভাগ হল— পূর্ব ও পশ্চিম। পূর্বের দখল নিল পূর্ব জার্মানি এবং পশ্চিম বার্লিনের দখল নিল পশ্চিম জার্মানি। 
পৌঁছে গেলাম আমাদের নির্ধারিত হোটেল ‘আজিমুট’এ। কাউন্টারে শুনলাম হোটেল সংলগ্ন অঞ্চলটি একসময়ে পশ্চিম বার্লিনের অংশ ছিল। রুমে চেকইন করে লাগেজ রেখে গাইডের নির্দেশমতো সবাই নীচে লবিতে মিলিত হলাম বাইরের কোন হোটেলে ডিনার করতে যাবার উদ্দেশ্যে। ঐ একই বাসে চললাম ডিনারে। খুব অল্প সময়ের মধ্যেই পৌঁছে গেলাম একটি ইন্ডিয়ান রেস্তোরাঁয়, নাম ইন্ডিশেস রেস্তোরাঁ। ইউরোপিয়ানরা ডিনারের সময়ের ব্যাপারে খুবই শৃঙ্খলাপরায়ণ। ৭টা থেকে ৮টার মধ্যে ডিনার সারতে হবে। কিন্তু আমাদের পৌঁছতে প্রায় ৯টা হয়ে যাবার দরুণ বিশেষ অনুমতি নিয়ে আমরা রেস্তোরাঁয় প্রবেশ করলাম। ঢোকার সঙ্গে সঙ্গেই দক্ষিণ ভারতীয় মালিক নিজের হাতে প্রত্যেককে ওয়েলকাম শ্যাম্পেন দিয়ে অভ্যর্থনা জানালেন। অনিচ্ছুকদের জন্য ঠান্ডা পানীয়। টেবিলে আসন গ্রহণের পর ঠান্ডা বিয়ার পরিবেশন করা হল। মালিকের বয়স ৭০ পেরিয়ে গেছে, দেখে বোঝাই যায় না। কী অফুরন্ত প্রাণশক্তি! অল্পবয়সী ছেলেমেয়েদের সঙ্গে সমান তালে তাল দিয়ে একাধারে পরিবেশনের সঙ্গে সঙ্গে কাউন্টারও সামলাচ্ছেন। দেখে ভালো লাগে এখানকার বয়স্করা কি সুন্দরভাবে বাঁচতে জানেন। আর আমরা? ৬০ হতেই অবসর নিয়ে স্মৃতির বন্দীদশায় নিজেদের বেঁধে ফেলি। 
ডিনারের পর্ব ভালোই চুকলো। মালিককে শুভরাত্রি জানিয়ে রেস্তোরাঁর বাইরে এসে দেখি ঠান্ডা যেন আরও বেড়েছে, সঙ্গে তীক্ষ্ণ হাওয়া নাকে কানে বিঁধছে। কোনওরকমে বাসে উঠে শান্তি হল। হোটেলে পৌঁছেই পরের দিনের প্রস্তুতিপর্ব সেরে তবেই শুতে যাওয়া। বিদেশে বেড়াতে এসে এটা একটা প্রাত্যহিক কাজ। 

ব্রান্ডেনবার্গ গেট

পরেরদিন সকাল সাড়ে ৭টায় ব্রেকফাস্ট টেবিলে মোটামুটি সবাই হাজির। একেবারে চমকে দেওয়া প্রাতরাশ। কী নেই সেখানে! এমনিতেই ইউরোপের ব্রেকফাস্ট মানেই নানানরকম আইটেমের প্রাচুর্যের সমাহার। তারমধ্যে এখানকার ব্রেকফাস্ট তো জার্মানদের চেহারার সঙ্গে একেবারে মানানসই। ব্যুফে ব্রেকফাস্টের মজা হচ্ছে যেটা ইচ্ছে সেটা যতখুশী খাও। কত কিসিমের ফলের রস, গরম, ঠান্ডা দুধের সঙ্গে হরেক রকমের কর্নফ্লেক্স, নানা ধরণের ফলের কুচি, সসেজ, হ্যাম, বেকন, বিচিত্র ধরণের পাউরুটি, কোনটা লম্বা, কোনটা বেঁটে মোটা, কোনটা গোল বা অর্ধেক চাঁদ। ডিমের অনেক প্রকারভেদ— ফুল বয়েলড, হাফ বয়েলড, স্ক্র্যাম্বল্ড, অমলেট। চাইলে সঙ্গে সঙ্গে অমলেট বানিয়ে দিচ্ছে। ডিমের শুধু সাদা অংশ বা শুধু হলুদ অংশ অর্থাৎ কুসুম দিয়েও অমলেট পরিবেশিত হচ্ছে। সঙ্গে চিরাচরিত চা ও কফি তো আছেই। আর কি চাই?  
বাস ছাড়লো সকাল ৯টায়। আমাদের প্রথম গন্তব্য ব্রান্ডেনবার্গ গেট। সেটি ঐতিহাসিক পটভূমিকার বিচারে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বহু রাজনৈতিক মিটিং মিছিলের সাক্ষ্য বহন করছে ঐ গেট। সেটি প্রকৃত অর্থেই বার্লিন তথা জার্মানির স্মারক। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে মিত্র শক্তির কাছে পরাজিত জার্মানির বহু সম্পত্তি, ঐতিহাসিক নিদর্শন ক্ষতিগ্রস্ত হলেও আশ্চর্যজনকভাবে গেটটি বেঁচে যায়। গেটের দু’ধার লিন্ডন গাছ দিয়ে চমৎকার ভাবে সাজানো। দেখে আমাদের শহরের চৌরঙ্গী স্কোয়্যারের কথা মনে পড়ে যায়। সবাই মিলে একাধিক ছবি তোলা, নিকটবর্তী দোকান থেকে ব্রান্ডেনবার্গ স্মারক সংগ্রহ সব কিছুই হলো অত্যন্ত দ্রুততার সঙ্গে কারণ সময় কম। এখানে সব সময়েই উৎসবের মেজাজ বজায় থাকে। অন্যভাবে বললে এই অঞ্চলকে বিদেশীদের মিলনক্ষেত্রও বলা চলে। দেখতে পেলাম সুসজ্জিত ঘোড়ার গাড়ি। ঘোড়াদের চেহারাও পুরো জার্মানদের মতন। আর কোচোয়ান নিয়ে তো কথাই হবেনা, যেমন বিশাল চেহারা তেমনই ভারী গলা, সঙ্গে তার ছায়াসঙ্গী পোষ্য কুকুর ও বাঁদর। 

সিটি হলের সামনে ফোয়ারা

প্রসঙ্গক্রমে জানা দরকার যে বার্লিন যদিও একসময়ে পূর্ব জার্মানির রাজধানী এবং ভৌগলিক অবস্থানগতভাবে পূর্ব জার্মানির অংশ ছিল তথাপি দীর্ঘদিন এই শহরের দুটি অংশ ছিল। একটি পূর্ব বা ইস্ট বার্লিন, অপরটি পশ্চিম বা ওয়েস্ট বার্লিন। ব্রান্ডেনবার্গ গেটে ঢোকার আগের রাস্তাটার একপাশ ছিল পূর্বের, অপর পাশ ছিল পশ্চিমের। পূর্ব জার্মানি ছিল বকলমে রাশিয়ার দখলে। স্বভাবতই কমিউনিস্ট সুলভ গোঁড়ামির যাঁতাকলে পড়ে সেখানকার জনগণের অবস্থা তো একেবারেই সঙ্গীন। অপরদিকে মিত্রপক্ষের তিনদেশ আমেরিকা, ব্রিটেন ও ফ্রান্স যৌথভাবে দখল করেছিল পশ্চিম জার্মানি। এদের সীমানা ছিল এল্‌ব নদীর শেষ পর্যন্ত। পূর্ব অপেক্ষা পশ্চিম জার্মানি ছিল অনেক বেশি গণতান্ত্রিক, খোলামেলা, সহজ সরল জীবনযাপনে অভ্যস্ত এবং অবশ্যই ধনী। চোখের সামনে পাঁচিলের ওপারের লোকেদের সঙ্গে নিজেদের এই বৈষম্য দেখে এবং কঠোর অনুশাসনের বেড়াজালে আবদ্ধ থাকতে থাকতে পূর্ব জার্মানির লোকজন হাঁপিয়ে উঠে পশ্চিমে পালিয়ে যাবার চেষ্টা শুরু করে। সেই পালিয়ে যাবার প্রবণতা কমিউনিষ্টদের শিরঃপীড়ার কারণ হয়ে ওঠে। রোজকার এই অত্যাচার বা অবৈধ পালানো বন্ধ করতে তাঁরা ঠিক করল পাঁচিল তুলে দিয়ে পাঁচিল বরাবর পাহারা বসাবে। যেমনি ভাবা তেমনি কাজ। ১৯৬১ সালের ১৩ আগষ্ট জার্মান গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র (GDR) বা পূর্ব জার্মানির উদ্যোগে শুরু হলো পাঁচিল তোলার কাজ। পাঁচিল গড়ার কাজ শেষ না হওয়া পর্যন্ত অর্থাৎ নভেম্বর মাস অবধি পশ্চিম জার্মানির সঙ্গে পুর্ব জার্মানির যাতায়াত সম্পূর্ণ বন্ধ ছিল। জি ডি আর কর্তৃপক্ষ এই দেওয়ালকে বলতো ফ্যাসিস্ট বিরোধী প্রাচীর (Rampart)। অন্যদিকে পশ্চিম জার্মানির সরকার সেটিকে বলত লজ্জার দেওয়াল (Wall of Shame)। দেওয়াল নির্মাণের আগে ৩.৫ মিলিয়ন পূর্ব জার্মানির নাগরিক দেশ ছেড়ে পশ্চিম জার্মানিতে চলে যায়। তাদের মধ্যে কিছু সীমান্ত পেরিয়ে এবং কিছু ইউরোপের বিভিন্ন দেশ ঘুরে পশ্চিম জার্মানিতে আশ্রয় নেয়। পাঁচিল তৈরীর পর অর্থাৎ ১৯৬১ সাল থেকে ১৯৮৯ সালের মধ্যে আরও লক্ষ লক্ষ মানুষ পাঁচিল ডিঙ্গিয়ে পশ্চিম জার্মানিতে যাবার চেষ্টা করে। তাদের মধ্যে মাত্র পাঁচ হাজারের মতো যেতে সমর্থ হয়। এই কাজে লিপ্ত হবার জন্য পূর্ব জার্মানির সেনার হাতে প্রাণ যায় দুশো জনের কিছু বেশী এবং বন্দী হয় অগুন্তি। যদিও প্রকৃতপক্ষে গণতান্ত্রিক স্রোতে ফেরার জন্য পাঁচিল টপকাতে গিয়ে পূর্ব জার্মানির কত লোকজন গুলিবিদ্ধ হলো তার সঠিক হিসাব বা তথ্য আজও অজানা।

বার্লিনের পরিচ্ছন্ন রাস্তা

সত্যি কথা বলতে কী পশ্চিম জার্মানির সঙ্গে পূর্ব জার্মানির ভাগাভাগি মূলত ক্যাপিটালিজম বনাম কমিউনিজমের লড়াই। আরও সহজ করে বললে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বনাম সোভিয়েত ইউনিয়নের ঠান্ডা লড়াই। এই দুই তৎকালীন শক্তিধর দেশের লড়াইয়ের মাঝখানে পরে পশ্চিম বার্লিনের লোকজনও পূর্ব বার্লিনে তাদের আত্মীয় স্বজনদের সঙ্গে সহজে মিলিত হতে পারছিলেন না। ফলে তাদেরও যথেষ্ট ক্ষোভ ছিল। পশ্চিমের লোকজনদের পূর্বে যেতে হলে ভিসা করতে হতো।
বার্লিন দেওয়ালের আলোচনায় অবশ্যই ‘‌চেক পয়েন্ট চার্লি’‌র গুরুত্ব উল্লেখের দাবী রাখে। পূর্ব ও পশ্চিমের মাঝখানে এই সীমারেখা খুবই পরিচিত ছিল। এই চেক পয়েন্ট দিয়ে শুধুমাত্র বিদেশীরা, সাংবাদিকরা বা কূটনীতিকরা বৈধ কাগজপত্র দেখিয়ে পারাপার করতে পারতেন। চার্লি ছাড়াও আরও দুটি চেক পয়েন্ট গুরুত্বপূর্ণ ছিল— তাঁরা হল যথাক্রমে আলফা ও ব্রাভো। তবে ধারে ও ভারে সর্বদাই এগিয়ে থাকতো চার্লি, একাধিকবার খবরের শিরোনামে এসেছিল। তেমনই একটি ঘটনার উল্লেখ করা যাক। তারিখটি ছিল ১৯৬১ সালের ২২ অক্টোবর অর্থাৎ যখন সদ্য পাঁচিল দিয়ে পূর্ব–পশ্চিম ভাগ হয়েছে। তৎসঙ্গে জন্ম হয়েছে চার্লি চেক পয়েন্টের। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অত্যন্ত পরিচিত কূটনীতিক এবং নাট্যপ্রেমিক অ্যালান ইষ্ট বার্লিনের একটি অপেরা হাউসে অনুষ্ঠান দেখার উদ্দেশ্যে চার্লি অতিক্রম করে যেতে উদ্যত হলে ইষ্ট জার্মানির বর্ডারে তাঁকে আটকানো হয়। সঙ্গে সঙ্গে উনার পাসপোর্ট দেখতে চাওয়া হয়, কিন্তু তিনি তা দেখাতে অস্বীকার করেন। তার যুক্তি ছিল তিনি একমাত্র সোভিয়েত ইউনিয়নের কাছেই পাসপোর্ট দেখাতে বাধ্য, পূর্ব জার্মানির কাছে কোনওভাবেই না। কারণ একমাত্র সোভিয়েত ইউনিয়ন ছাড়া পৃথিবীর সব দেশেই তার অবাধ গতি। পূর্ব জার্মানির সেনা আধিকারিকরা সব শুনেও তাঁকে পূর্ব জার্মানিতে প্রবেশের অধিকার দিতে অস্বীকার করেন। অ্যালান বাধ্য হয়ে ফিরে যান। কিছুক্ষণ বাদে তিনি আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের সৈন্যসামন্তসহ ফৌজি গাড়িতে করে আবার চেক পয়েন্টে আসেন। সীমান্তে উত্তেজনা বাড়তে থাকলেও পূর্ব জার্মানি তাদের সিদ্ধান্তে অনড় থাকে। ফলস্বরূপ, উভয় সীমান্তেই অস্ত্রশস্ত্রসহ একাধিক সাঁজোয়া গাড়িতে প্রচুর সৈন্যসামন্ত জড়ো হতে থাকে। এই বুঝি শুরু হয়ে গেল তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ। উত্তেজনা যখন চরমে সেই সময় আমেরিকার তৎকালীন রাষ্ট্রপতি জন কেনেডি সোভিয়েত যুক্তরাষ্ট্রের কমিউনিস্ট নেতা ক্রুশ্চেভকে মধ্যস্থতা করার অনুরোধ করাতে পরিস্থিতি শান্ত হয়।

বার্লিন দেওয়ালের অংশ

বার্লিন শহরের ভেতর দিয়ে প্রবহমান স্প্রি নদী। এটি আক্ষরিক অর্থেই উভয় জার্মানির সীমারেখাকে চিহ্নিত করে। নদীর আয়তন খুব একটা বেশী নয়। নদীর পার দিয়ে হাঁটার সময় হাল্কা গানের সুর কানে আসতেই লক্ষ্য করে দেখি যে অল্পবয়সী একটি ছেলে পিয়ানো একর্ডিয়ান বাজাচ্ছে। আমাদের ভারতীয় বুঝতে পেরে নিমেষেই সুর পরিবর্তন করে বাজাতে শুরু করল সঙ্গমের সেই বিখ্যাত গানের সুর ‘‌মেরে মন্‌ কি গঙ্গা আউর তেরে মন্‌ কি যমুনা.‌.. বোল রাধা বোল’‌। আমরা সবাই তো একেবারে অবাক। এই প্রসঙ্গে জানা যায় যে এককালের কম্যুনিস্ট অধ্যূষিত দেশগুলিতে রাজকাপুর ও মুকেশের যুগলবন্দী দারুণভাবে জনপ্রিয় ছিল। সেই কারণেই মস্কোয় এবং বুদাপেস্টের ডাইনিং হলে শুনেছিলাম ‘‌মেরা জুতা হ্যায় জাপানী’‌। এই ছোট্ট স্প্রি নদী ছাড়াও কেল্টিক উপজাতি অধ্যূষিত ইউরোপের এই রাজধানী শহরে ঢোকার মুখেই আমরা পার হয়েছিলাম এল্‌ব নদী। এটি ইউরোপের অন্যতম বৃহৎ নদী।

রেষ্টাগ বিল্ডিংয়ের সামনে

ফিরে আসি বার্লিন দেওয়াল প্রসঙ্গে। অন্ধকারের পর তো সূর্যোদয় হবেই। অবশেষে ১৯৮৯ সালে বিশ্বজুড়ে শুরু হয় কমিউনিষ্ট জমানার অবসানের সূত্রপাত। প্রবল শক্তিধর সোভিয়েত যুক্তরাষ্ট্র তখন ভেঙ্গে টুকরো হবার জন্য প্রহর গুনছে। কম্যুনিস্ট ঘেঁষা পোল্যান্ড এবং হাঙ্গেরীতে বিপ্লব শুরু হয়েছে। তার সঙ্গে সঙ্গে পূর্ব বার্লিনেও প্রচন্ড আন্দোলন শুরু হল। বেশ কিছুদিন ধরে বিদ্রোহ, আইন অমান্য, ভাঙচুর চলার সঙ্গে সঙ্গে জনরোষ আছড়ে পড়ে বার্লিনের দেওয়ালে। ভেঙ্গে যায় পাঁচিলের বেশ কিছু অংশ। কাতারে কাতারে লোকজন তখন পরস্পর পরস্পরের সঙ্গে আলিঙ্গন–বদ্ধ। অবশেষে, প্রচন্ড চাপের মুখে GDR কর্তৃপক্ষ ৯ নভেম্বর, ১৯৮৯ সালে একটি সরকারি বিজ্ঞপ্তি মারফৎ জনগণকে অবগত করলেন যে পুর্ব জার্মানির লোকজন এবার থেকে পশ্চিম বার্লিনে যেতে পারবে। সরকারীভাবে অবশ্য বার্লিন দেওয়ালের পতন হল ৩ অক্টোবর, ১৯৯০। এই পতনের সঙ্গে সঙ্গে অবসান হল এক জমানার। হাঁটতে হাঁটতে দেখতে পেলাম নানান রঙে রাঙিয়ে তোলা হরেক চিত্র সম্বলিত দেওয়ালের এক একটি বিশেষ অংশ। সঙ্গে থাকা গাইডের নির্দেশে সেখানেই দাঁড়িয়ে পড়লাম। আমাদের সকলকে অবাক করে দিয়ে গাইড বললেন, ‘‌এই সেই বিখ্যাত বার্লিন দেওয়ালের অংশ’‌। এই ওয়াল ভাঙ্গার সময় শতাধিক চিত্রশিল্পীর প্রতিবাদ উঠেছিল। তাদের আবেদন ছিল, ঐতিহাসিক স্মৃতি বিজড়িত ঐ দেওয়াল একেবারে শেষ না করে দিয়ে নিদেনপক্ষে এর কিছু অংশ রেখে দেওয়া হোক। তাঁরা সবাই রং তুলির সাহায্যে রাঙিয়ে তুলবেন সেই অংশ। অনুমতি মিলল। স্মৃতির সঙ্গে শিল্পকর্মের মেলবন্ধন— আজও সমগ্র পৃথিবীর পর্যটকদের আকর্ষণ করে। ছোট্ট পাঁচিলটি আজও পরিষ্কারভাবে ইঙ্গিত করে— ‘‌আমার এক দিক ইষ্ট আর অন্যদিক ওয়েস্ট’‌।

স্প্রি নদীর তীরে

বার্লিন শহরের আরও একটি বিশেষ আকর্ষণ হল ট্রাম নেটওয়ার্ক। এই নেটওয়ার্ক কিন্তু পুরোটাই ইষ্ট বার্লিনের অবদান। বার্লিন ভাগ হবার পর যানবাহনে গতি আনার জন্য পশ্চিম বার্লিন থেকে ট্রাম তুলে দেওয়া হয়। এখন বার্লিনে দেখা যায় ঝাঁ চকচকে হরেক রকমের রঙিন সাজে সজ্জিত ট্রামগুলো সগর্বে ছুটে চলেছে। পাশাপাশি কলকাতার ট্রামগুলির হতশ্রী চেহারার কথা মনে পড়াতে মনটা বিষণ্ণ হয়ে গেল। বার্লিনের সৌন্দর্য বৃদ্ধিতে ট্রামগুলি নিঃসন্দেহে একটি পালকের সংযোজন করেছে। পায়ে হেঁটে দেখা হলো রেষ্টাগ বিল্ডিং, বার্লিন ক্যাথিড্রাল, টাউন হল, টিভি টাওয়ার এবং একটু দূর থেকে দেখা বার্লিনের বিখ্যাত হোটেল এড্‌সন।
অনেকক্ষন ঘোরাঘুরি করে সবাই খুব ক্লান্ত। সময়াভাব সত্বেও জনগণের দাবীকে সম্মান জানিয়ে একটা চা বিরতি দিতে রাজী হলেন আমাদের গাইড এবং ম্যানেজার দুজনেই। অনেকটা হেঁটে গিয়ে তবেই চা মিলল। যাবার পথে একটু দূর থেকেই দেখেনিলাম ওয়ার মেমোরিয়াল এবং আইনষ্টাইন ও কার্লমার্ক্সের স্মৃতি বিজড়িত হ্যামবোল্ট বিশ্ববিদ্যালয়। শহরের শিক্ষার মান অত্যন্ত উচ্চমানের। একাধিক বিশ্বমানের বিশ্ববিদ্যালয় এই তথ্যকেই সমর্থন জানায়। 
প্রসঙ্গক্রমে জানিয়ে দেওয়া দরকার শিক্ষা ছাড়াও তথ্যপ্রযুক্তি, ঔষধ, মেডিক্যাল যন্ত্রপাতি, কারিগরি ও ইলেকট্রিক দ্রব্যসামগ্রী প্রস্তুতে জার্মানীর আধিপত্য আগেও ছিল, এখনও আছে। এই সমস্ত দ্রব্যের ব্যবসা বানিজ্য মূলত নিয়ন্ত্রিত হয় বার্লিন থেকে। সেই অর্থে বার্লিনের গুরুত্ব অপরিসীম। 

বার্লিন দেওয়ালে শিল্পীর আঁকা

চা খেয়ে অনেকটা তৃপ্তি ও এনার্জি নিয়ে এলাম আমাদের শেষ দ্রষ্টব্য ‘‌বুক বার্নিং স্কোয়্যার’‌–এ। এই সেই জায়গা যেখানে ১৯৩৩ সালের ১০ মে চল্লিশ হাজার মানুষের সামনে জার্মান ছাত্র সংগঠন প্রতিবাদস্বরূপ পঁচিশ হাজার বই পোড়ানোর মতো কর্মকান্ড সংগঠিত করেছিল। অভিযোগ ছিল উক্ত বইগুলিতে জার্মান সরকারের সমালোচনা করা হয়েছে এবং হিটলারকে স্বৈরাচারী আখ্যা দেওয়া হয়েছে। সরকার বিরোধী সেইসব বই, নানাবিধ প্রবন্ধ, তৈলচিত্র সবগুলিকে ‘জার্মান সুলভ নয়’ (Un-German) তকমা দিয়ে আগুনে নিক্ষেপ করা হয়। অভিযুক্ত লেখকদের মধ্যে পৃথিবী বিখ্যাত লেখকের সংখ্যা নেহাৎ কম ছিলনা। যাঁদের লেখা বই পোড়ানো হয় তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন আইনস্টাইন, ভিক্টর হুগো, ম্যাক্সিম গোর্কি, লিও টলষ্টয়, লেনিন, দৃষ্টিহীন লেখক হেলেন কেলার এবং আরও অনেকে। স্বভাবতই ঐ কাজ দেশে বিদেশে কঠোরভাবে সমালোচিত হয়। 
প্রতিবাদ চলাকালীন হিটলারের প্রচার সচিব গোয়েবলস্‌ ছাত্রদের উদ্দেশ্যে জ্বালাময়ী ভাষায় বক্তব্য রাখেন। তিনি জার্মান ছাত্রদের প্রতি আহ্বান জানান সদলবলে যুদ্ধে অংশগ্রহণের জন্য এবং সেদিনকার মতন একইভাবে ভবিষ্যতেও সরকার বিরোধী তথ্য, পুঁথি, চিন্তাভাবনা পুরিয়ে ছারখার করে দেবার। কর্মকান্ড মিটে যাবার পর হেলেন কেলার একটি চিঠি লিখে সেটিকে মুদ্রিত করে সমগ্র ইউরোপে ছড়িয়ে দেন। জার্মান ছাত্রদের উদ্দেশ্যে লিখিত সেই খোলা চিঠির বিষয় বস্তু ছিল এইরূপ— ‘‌তোমরা আমার বই এবং তৎসঙ্গে ইউরোপের অনেক স্বনামধন্য লেখকদের বই পুরিয়ে ফেলতেই পারো কিন্তু বইগুলির অন্তর্নিহিত চিন্তাভাবনা, মতামত, ধ্যানধারণা এবং বিচার বিশ্ল্বেষণ লক্ষ ছিদ্রপথ দিয়ে আগে যেমন সমগ্র পৃথিবীকে সুবাসিত করেছে, ভবিষ্যতেও তা’ নিশ্চিতভাবেই করবে’‌।

টাউন হল

বার্লিন বিদায় আসন্ন। আমাদের লোকাল গাইড লারাকে বিদায় জানানোর পালা। ঘড়ির কাঁটা দুপুর চারটে পেরিয়ে গেছে। এবার আমরা যাব জার্মানির আরও একটি সুন্দর শহর ড্রেসডেন, পরিভাষায় যাকে বলা হয় ‘‌Florence at the Elbe’‌. বার্লিন ছাড়ার পরেই শুরু হয়ে গেল মাইলের পর মাইল অপূর্ব সুন্দর হলুদ রঙের ক্ষেত। প্রথম দর্শনে সবাই একে সর্ষের ক্ষেত বলে ভুল করেছিলেন, কিন্তু বাস চালক কালিসের থেকে জানা গেল ওগুলি আসলে ক্যানোলা চাষের ক্ষেত। বায়ো ফুয়েল হিসাবে ব্যবহৃত হয়। দূরে দেখা গেল সারি সারি উইন্ডমিল। হাওয়ার আনুকূল্য পেয়ে সেগুলি তখন আপন গতিতে ঘুরতে শুরু করেছে। সে এক দেখার মতো দৃশ্য!‌

সব ছবি:‌ লেখক

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *