ঐতিহ্যমণ্ডিত এথেন্স
ডঃ সঞ্জীব রায়

ইউরোপ মহাদেশের অন্তর্গত দেশগুলির আয়তন বা অবস্থান অনেকটাই আমাদের দেশের বিভিন্ন অঙ্গরাজ্য বা প্রদেশের মতন। ছোটো বড়ো মেশানো এই দেশগুলো একে অপরের সঙ্গে সুন্দরভাবে জড়িয়ে আছে। প্রত্যেকটি দেশের স্বকীয়তা দেখে অবাক হতেই হয়। প্রত্যেকের মধ্যে সংস্কৃতি, সমাজ জীবন ও শিল্প সাহিত্যের তারতম্য লক্ষণীয়। আধুনিক সভ্য পৃথিবীর বুনিয়াদ ও প্রস্তুতিতে প্রত্যেকটি দেশের অবদান ইতিহাসে স্বীকৃত। তবে অবদানকারী দেশগুলোর মধ্যে অবশ্যই একেবারে প্রথম সারিতে আসবে গ্রিস।

গ্রিসের রাজধানী এথেন্সের ইতিহাস বেশ প্রাচীন। এর জন্ম খ্রিস্টপূর্বের অনেক আগে। সেই সময় গ্রিসে শহরভিত্তিক ছোটো ছোটো রাষ্ট্র ছিল। তাদের মধ্যে অন্যতম ছিল এথেন্স, স্পার্টা, থিবস। এদের মধ্যে অবশ্য এথেন্সই ছিল সবদিক থেকে সমৃদ্ধ। ধনসম্পদে, জ্ঞান–বিজ্ঞানে এবং রাজনৈতিক আধিপত্যে এথেন্স ছিল রাজা। একাধিক বরেণ্য ব্যক্তিত্বের দ্বারা আলোকিত তৎকালিন এথেন্সের উল্লেখযোগ্য নাম বলতে ছিল রাষ্ট্রনেতা পেরিক্লস, দার্শনিক প্লেটো, সক্রেটিস, ঐতিহাসিক হিরোজোটাস, থুকিডাইটিস, নাট্যকার এসকাইলাস, সেফোক্লিস বা ইউরিপিডিস। এথেন্সের স্বর্ণযুগে একাধিকবার পারস্য গ্রিস আক্রমণ করেছে। আঘাতে জর্জরিত হয়েও এথেন্স গ্রিসের অন্যান্য রাজ্যের সঙ্গে একজোট হয়ে সেই আঘাতের মোকাবিলা করেছে। অন্যদিকে এথেন্সের সঙ্গে স্পার্টার দীর্ঘকাল ধরে যে যুদ্ধ চলেছিল তা ইতিহাসে ‘পেলোপনেসিয়ান ওয়ার’ নামে খ্যাত। এই যুদ্ধে এথেন্সের পরাজয়ের সঙ্গে সঙ্গে তাঁদের গৌরবের দিনও ক্রমশ শেষ হতে থাকে।

দিল্লি থেকে উড়ানে মোটামুটি ঘণ্টা ছয়েক কাটিয়ে এথেন্স বিমানবন্দরে পৌঁছনো গেল। বিমানবন্দরে রুটিন মাফিক এমিগ্রেশন, কাস্টমের একটু কড়া নিষেধ পেরিয়ে লাগেজপত্র নিয়ে বিমানবন্দরের বাইরে এসে দেখি স্থানীয় গাইড সানিয়া আমাদের জন্য অপেক্ষা করছেন। মধ্য চল্লিশের সানিয়ার ইংরেজি বেশ পরিষ্কার, উচ্চারণে আমাদের অসুবিধা থাকার কথা নয়। এখানকার কারেন্সি ইউরো। ইউরো কলকাতা থেকেই নিয়ে আসায় মুদ্রাবিনিময়ের লাইনে আর দাঁড়াতে হয়নি।

আমাদের বাস ধীরে ধীরে বিমানবন্দর সংলগ্ন এলাকা ছেড়ে ক্রমশ শহরতলিতে প্রবেশ করে। যেটুকু একনজরে চোখে পড়ল তাতে এথেন্সকে খুব যে ঝকঝকে সুন্দর গোছানো শহর বলা যাবে তা নয়। তবে রাজনীতিবিদদের কাছে সুখবর এই যে, এ শহরের আনাচে–কানাচে দেওয়াল লিখন যথেষ্ট। বলা বাহুল্য এই দেওয়াল লিখন মূলত কোনো রাজনৈতিক দলের সমর্থনে রচিত। গ্রিস ইউরোপীয় ইউনিয়নের অন্তর্ভূক্ত একটি দেশ হলেও ইউরোপের অন্যান্য দেশের তুলনায় বেশ গরিব। 

যখন থেকে ইউরোপীয় ইউনিয়নের অধীন সমস্ত দেশে একই মুদ্রা বা ইউরো চালু হয় তখন গ্রিসের মানুষজন পড়েছিলেন এক মহাসঙ্কটে। সেই সময়ে গ্রিসের মুদ্রার তুলনায় ইউরোর দাম অনেকটাই বেশি হওয়ার জন্য সেখানকার সাধারণ মানুষের ক্রমক্ষমতা অনেকাংশে হ্রাস পেয়েছিল। দেশের মানুষের ক্রয়ক্ষমতা হ্রাসে গ্রিসে অর্থনৈতিক দিক থেকে এক বড় বিপর্যয় দেখা যায়, যা থেকে কিন্তু গ্রিস এখনো মুক্ত হতে পারেনি। উপরন্তু সমস্যা দিনকে দিন বৃদ্ধি পেয়েই চলেছে।

বিমানবন্দর থেকে বাস শহর প্রবেশের পর দেখা মিলল পার্লামেন্ট, ন্যাশনাল লাইব্রেরি ও বিশ্ববিদ্যালয়। এই দেশ থেকেই অলিম্পিক গেমসের উৎপত্তি। প্রাচীন গ্রিসের অলিম্পিয়া এই গেমসের প্রকৃত উৎপত্তিস্থল। সেই অলিম্পিয়া থেকে অলিম্পিক নামকরণ। ১৮৯৬ সালে এই এথেন্স শহরেই সর্বপ্রথম আধুনিক অলিম্পিক অনুষ্ঠিত হয়। প্রত্যেক চারবছর অন্তর বিভিন্ন দেশে যে অলিম্পিক উদ্বোধন হয়, সেই উদ্বোধনের আগে গ্রিসের অলিম্পিয়া থেকে মশাল জ্বালিয়ে নিয়ে পৃথিবীর নানা দেশ পরিক্রমার পরে আয়োজক দেশে সেই মশাল স্থাপন করা হয়।

হোটেলে পৌঁছে নিয়মানুসারে কাগজপত্র দেখিয়ে চেক ইন করা হল। মাঝারি মানের হোটেল। সময় অক্টোবরের মাঝামাঝি। ঠান্ডা নেই বললেই চলে। হোটেলের ঘরে ঢুকে মালপত্র রেখে খানিক বিশ্রাম নিয়ে বেরনোর পালা। পড়ন্ত বিকেলের রোদ বিদায় নেবার মুখে। বাসে যেতে যেতে প্রথমেই এসে নামা হল প্যানথেনয়িক স্টেডিয়াম, যা কিনা পৃথিবীর একমাত্র স্টেডিয়াম যার সবটাই মার্বেল পাথরে তৈরি। ততক্ষণে চারদিক অন্ধকার নেমেছে সঙ্গে এক ঠান্ডা হাওয়া যার জন্য আমরা অনেকেই প্রস্তুত ছিলাম না। স্টেডিয়াম থেকে একটু পায়ে হেঁটে এগিয়ে যাবার পরে চোখে পড়ল সমতলভূমি থেকে একটি পাহাড় সোজা খাঁড়া উঠে গেছে ৫০০ ফুটের মতন। গাইডের কাছে শুনলাম ওই ছোট্ট পাহাড়ের উপর সমতলভূমিকেই বলে অ্যাক্রোপলিস। এখানেই নির্মিত ছিল পার্থেনন মন্দির। সন্ধ্যার পরে সেখানে যাওয়া সম্ভব নয়। আগামীকাল প্রাতরাশ সেরে আমরা অ্যাক্রোপলিস দর্শনে যাব। খানিক দূরেই রেস্তোরাঁয় রাতের খাবার খেয়ে আমাদের হোটেল ফেরার পালা।

পরেরদিন একটু দেরী করে প্রাতঃরাশ সেরে বেরনো হল। প্রথমেই অ্যাক্রোপলিস। এখানকার পার্থেনন মন্দিরেই ছিলেন এথেন্সের আরাধ্য দেবী এথেনা। মন্দিরটি স্থাপস্ত্য বাস্তবিকই সুন্দর ছিল, কিন্তু বর্তমানে সবই ভগ্নাবশেষ। গাইডের কাছে শোনা যে একসময়ে এথেন্স শহরে নির্দেশ ছিল যে অন্য কোনো স্থাপত্য, ঘরবাড়ি, হোটেল বা মনুমেন্ট কোনোভাবেই উচ্চতাতে অ্যাক্রোপলিসকে অতিক্রম করতে পারবে না। ফলে এথেন্স শহরের যে কোনো জায়গা থেকে খ্রিস্টপূর্ব আটশো শতকে নির্মিত অ্যাক্রোপলিস এবং তার সংলগ্ন বিশাল এলাকাটা দেখতে পাওয়া যায়। অ্যাক্রোপলিসে উঠার সময় চোখে পড়ে অ্যাম্পিথিয়েটারের ভগ্নাবশেষ। এক সময়ে অভিজাত থিয়েটার ছিল এটি। তৎকালীন সময়ের বিখ্যাত নাট্যকার সেফোক্লিস, অ্যাসকাইলাস, ইউবিপিডিস প্রভৃতি ব্যক্তিত্বদের নাটক এখানে নিয়মিতভাবে অভিনয় হত। প্রায় কুড়ি হাজার দর্শক একসঙ্গে বসে নাটক দেখতেন।

প্রসঙ্গক্রমে বলা প্রয়োজনে যে গ্রিস একসময়ে তুরস্কের অধীন ছিল। উনিশ শতকের তৃতীয় দশক থেকে গ্রীকরা স্বাধীনতার যুদ্ধ শুরু করে। সেই যুদ্ধে ইউরোপের বহুদেশ থেকে স্বেচ্ছাসেবকরা এসে গ্রিসের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে যুদ্ধ করছিলেন। সেই স্বেচ্ছাসেবকদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ব্যক্তিত্ব ছিলেন ইংরেজ কবি লর্ড বায়রণ। তিনি দুর্ভাগ্যবশত এখানে কোনোভাবে সমুদ্রে ডুবে মারা যান। তাঁর স্ট্যাচু রয়েছে এথেন্স শহরের কেন্দ্রস্থলে। রাতে রেস্তোরাঁয় ডিনার করতে করতে টের পেলাম গ্রিসের খাবারের একটি বৈশিষ্ট্য— অলিভের যথেষ্ট ব্যবহার। গ্রিসে সামুদ্রিক মাছের যোগান প্রচুর। সেহেতু ‘সি ফিশ’ এখানে সহজলভ্য। 

পরের দিন সকালে প্রাতঃরাশ সেরে রওনা হওয়া গেল ডেলফির পথে। এথেন্স থেকে ডেলফির দূরত্ব ১৫০ কিমি। বাসে থিবস হয়ে ডেলফিতে পৌঁছনো যায়। যাবার পথের দু’ধারে সাইপ্রাস গাছের সারি। দৃষ্টি পড়ল রাস্তার দু’ধারে মাঠে তুলোর চাষ হচ্ছে। গ্রিস দেশের আয়তনের তুলনায় জনসংখ্যা যে খুব বেশি এমনটা নয়। পাহাড়/‌টিলা ভরা এই দেশ নিঃসন্দেহে প্রকৃতির রুক্ষতার শিকার। এরা চাষাবাদে মোটেই আত্মনির্ভরশীল নয়। শিল্পেও তথৈবচ। এদের আয়ের উৎস মূলত ‘মার্চেন্ট নেভি’ অর্থাৎ সারা পৃথিবীতে জলপথে পণ্য পরিবহনে তারা এক নম্বর। এই কারণেই শহরগুলি জনাকীর্ণ। উপার্জনের সুযোগ গ্রামের থেকে শহরে অনেক বেশি। গ্রামে বাস করেন জনসংখ্যার দুই-তৃতীয়াংশ মানুষ। গ্রিস দেশের পর্যটনে আয় বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এথেন্সে সারা পৃথিবীর পর্যটকরা প্রতি বছরই ঝাঁপিয়ে পড়েন।

ডেলফি পৌঁছতে প্রায় ঘণ্টা তিনেক লাগলো। ডেলফির মাউন্ট পর্নেসাস পাহাড়ের উপর অ্যাপোলো মন্দির। পথে একটা লেক দেখতে পেলাম নাম ‘লিকি’। এই লেকের জল পরিশোধিত করে এথেন্সে জল সরবরাহ হয়। কথিত আছে যে ডেলফির অ্যাপোলো মন্দিরের ভেতর থেকে একসময় দৈববাণী শোনা যেত। এই দৈববাণী ইতিহাসে Orcle of Delphi নামে খ্যাত। দূরদূরান্ত থেকে মানুষজন আসতো এই দৈববাণীর মারফৎ নিজেদের ভাগ্য জানতে। শুধুমাত্র ব্যক্তিরাই নয় রাষ্ট্রের প্রতিনিধিরাও আসতেন তাদের দেশের ভবিষ্যৎ জানার জন্য। পারস্যের সঙ্গে যুদ্ধে এথেন্স ও স্পার্টার রাষ্ট্রনায়করা ডেলফির দৈববাণী শুনতে চেয়েছিল যুদ্ধের ফলাফল কারদিকে যাবে তা জানার জন্য। দৈববাণী শোনার জন্য প্রত্যহ বিশাল জনসমাবেশ ও বিশিষ্ট জনদের আনাগোনার ফলে মন্দির নিঃসন্দেহে অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধ হত। তৎকালিন সময়ে মার্বেল পাথরের এই মন্দিরের ভেতর ছিল অসংখ্য সুন্দর মর্মর মূর্তি এবং চিত্রকলা।

নিয়ম অনুসারে কেউ ভবিষ্যৎ জানতে চাইলে তা একটি চিরকুটে লিখে দিত। মন্দিরে মহিলা পুরোহিত (‌পিথিয়া)‌ সেগুলো নিয়ে ভেতরে চলে যেতেন। সেখানে স্নানের ব্যবস্থা থাকত। সেই স্নান সেরে তিনি একটি সোনার তিনপায়া টুলে বসতেন। মেঝের ফাটল থেকে উষ্ণ বাষ্প আসত, সেই বাষ্প পিথিয়া নিঃশ্বাসের সঙ্গে গ্রহন করতেন। সেই বাষ্পকে ভক্তরা ভগবান অ্যাপোলোর প্রশ্বাস বলেই মনে করতেন। এই প্রশ্বাস গ্রহনের পরে ক্রমে ক্রমে পিথিয়া একটু অচৈতন্য হয়ে পড়তেন। তিনি কথা বলতে পারতেন না মুখ দিয়ে গোঙানির মত একটা আওয়াজ বের হত। সেই আওয়াজকেই অন্যান্য পুরোহিতরা নিজেদের মতন করে বাণীতে রূপান্তরিত করে ভক্তদের মধ্যে প্রচার করতেন। পরবর্তীকালে মন্দিরের অনেক কিছু চুরি হয়ে যায়। সম্রাট নিরো এই মন্দিরের অনেক মূর্তি সরিয়ে নিয়ে যান। সম্রাট কন্টেনটাইন সোনার টুলটি নিজের রাজধানীতে নিয়ে আসেন। এই ডেলফিতে যে মিউজিয়ামটি আছে সেটি বেশ ছোটো কিন্তু সুন্দর সাজানো গোছানো। এখানে মার্বেল ও ব্রোঞ্জের অনেক মূর্তি আছে যা নিঃসন্দেহে অত্যন্ত সুন্দর ভাস্কর্যের ঐতিহ্য বহন করছে। আসলে গ্রিস দেশটাই যেন এক মিউজিয়াম। একটু যেতে না যেতেই নিশ্চিতভাবে সামনে পড়বে একটা না একটা মিউজিয়াম।
ডেলফি থেকে ফেরার পথে এলাম একটা পাবে। সেখানেই আজকে আমাদের রাতের খাবারের আয়োজন ছিল। সঙ্গে ছিল স্থানীয় লোকনৃত্য। মন্দ নয়। সেখানে যে জিনিসটা সবচেয়ে বেশি মনকে আকৃষ্ট করলো তা হচ্ছে এ দেশের গ্রিস নাগরিকরা কী পুরুষ, কী নারী প্রত্যেককেই অত্যন্ত সুঠাম, ঋজু, লাবণ্যময় স্বাস্থ্যের অধিকারী। রাতের খাবার সেরে সোজা হোটেল। আগামীকাল কাকভোরে এথেন্সের পিরোস ঘাট থেকে জাহাজে চেপে আমরা পৌঁছে যাবো স্যান্টোরিনি।

সব ছবি:‌ লেখক

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *