অবিশ্বাস্য জীবনশক্তি
ডঃ সঞ্জীব রায়

অনেকবার দেখা গেছে মানুষ অবিশ্বাস্যভাবেই মৃত্যুমুখ থেকে ফিরে এসেছে। সেই রকম একাধিক ঘটনা হয় আমরা প্রত্যক্ষ করেছি নয়তো বা পড়েছি। তাই বলে ফাঁসি হয়ে যাওয়ার পরেও বেঁচে ফেরা! এই ঘটনা যে বাস্তবিকই বিরলের মধ্যে বিরলতম, যেন চোখে আঙুল দিয়ে ‘‌রাখে হরি মারে কে?‌’‌— প্রবাদ বাক্যটিকে সত্য বলে প্রমাণ করে। এই প্রতিবেদন তেমনই এক সত্য ঘটনাকে ইতিহাসের পাতা থেকে তুলে এনে পরিবেশনের চেষ্টা করছে।
অ্যান গ্রিনের (Anne Greene) জন্ম ১৬২৭ সালে অক্সফোর্ডশায়ারের অন্তর্গত ছোট জায়গা স্টেপলে বার্টনে (Steeple barton)। নিতান্ত অভাবী অ্যান গ্রিন লোকের বাড়িতে কাজ করত। এখানে ওখানে কাজ করতে করতে একদিন তার অক্সফোর্ডশায়ারের নামজাদা মানুষ স্যার থমাস রিডের বাড়িতে কাজ জুটে যায়। স্যারের বিশাল বাড়ি ছিল ডানস ট্যুতে। সেই বাড়িতে দাস–দাসীর অভাব ছিল না। অ্যানের চেহারা কিন্তু প্রথম থেকেই আকর্ষণীয় ছিল, যৌবনের পদার্পনের সঙ্গে সঙ্গে তাঁর চেহারার জৌলুস আরও বৃদ্ধি পায়।

স্যারের বাড়িতে ঢোকা থেকে ইস্তক অ্যান একটু স্বচ্ছলতার মুখ দেখে। বিধাতা বোধকরি তার সুখ কোনোদিন সহ্য করতে রাজি ছিলেন না, অ্যানের দুর্ভাগ্য যে স্যার থমাসের নাতির চোখে পরে যায় সে। সেই ছেলে অর্থাৎ জোফার রেড ছিল পয়লা নম্বরের লম্পট। বয়স মাত্র ১৬/১৭ হলে কী হবে সে ছেলে বিয়ের মৌখিক প্রতিশ্রুতি দিয়ে অ্যানের সঙ্গে প্রায়শই শারীরিক সম্পর্ক স্থাপন করত। অ্যানের যে তাতে সম্মতি ছিল তা ঠিক নয়, কিন্তু অ্যান বেচারি ছিল নিরুপায়। তার মনে নিরাপত্তাহীনতা কাজ করত। সেই লম্পট ছেলে প্রতিনিয়ত ভয় দেখাত কাজ ছাড়িয়ে দেবার।
বাড়িভর্তি দাস–দাসী। তাদের কী আর দৃষ্টি এড়ায়। অচিরেই তাদের মধ্যে ফিসফাস, অ্যানকে নিয়ে চটুল মন্তব্য, ঠাট্টা ইয়ার্কি। কপাল যখন পোড়ে যেন সবদিক থেকেই পোড়ে। অ্যানের ক্ষেত্রে ঠিক তাই হল। অ্যান গ্রিন গর্ভবতী হয়ে পরে। এই ঘটনা অনুমান করে অন্যান্য দাসদাসীরাও খানিক বিচলিত হয়ে পরে। তারা উৎকণ্ঠিত ছিল এই ভেবে যে, না জানি তাদের উপরেও কোপ এসে না পরে। অ্যান কিন্তু নিজে বুঝলেও কোনোদিন স্বীকার করে নি। ক্রমশ অ্যানের শরীরে মাতৃত্বের চিহ্ন প্রকট হয়ে উঠলেও সে অস্বীকার করে যায়। তবে সে প্রচণ্ড ভয় ও আশঙ্কায় দিন কাটাতে থাকে। এমতাবস্থা চলাকালীন একদিন সে পেটে প্রচণ্ড যন্ত্রণা অনুভব করতে করতেই একটি অপুষ্ট সন্তানের জন্ম দেয়। সে চেয়েছিল ঘটনাকে গোপন রেখে বাচ্চা নিয়ে কোথাও চলে যেতে কিন্তু সেটা আর সম্ভব হল না। 

অ্যান বাচ্চাটিকে রেখে একটু সময়ের জন্য কোথাও গিয়েছিল সেই সুযোগে দাসদাসীদের মধ্যে থেকে কেউ বাচ্চাটিকে নিয়ে গিয়ে মাটি চাপা দেয়। সেখানেই শেষ নয় খানিক পরে তারাই মালিককে খবর দেয় যে অ্যান একটি অবৈধ সন্তানের জন্ম দিয়ে সত্যতাকে চাপা দেওয়ার জন্য তাকে জ্যান্ত কবর দিয়েছে। স্যার থমাস ছিলেন অত্যন্ত সহজ ও সজ্জন ব্যক্তি তিনি চাকরদের কথাকেই বিশ্বাস করে নেন। তিনি পুলিশে খবর দেন, পুলিশ এসে অ্যানকে গ্রেপ্তার করে। 
শিশুটিকে কবর খুঁড়ে তুলে পোস্টমর্টেম করে দেখা যায় যে সত্যিই তাকে জীবন্ত অবস্থায় কবর দেওয়া হয়েছিল। ১৬৫০ সালে অ্যানকে আদালতে তোলা হয়। মামলা চলে বেশ কিছুদিন। অবশেষে সেই বছরে ১৪ ডিসেম্বর অ্যানকে দোষী সব্যস্ত করে ফাঁসির আদেশ দেওয়া হয়। আদেশনুসারে নির্দিষ্ট দিন অ্যানকে তোলা হয় ফাঁসি কাঠে। তৎকালীন সময়ের রীতি অনুসারে যতক্ষণ পর্যন্ত অপরাধী মৃত্যুবরণ করবে না ততক্ষণ তাকে ঝুলিয়ে রাখা হবে। তার জন্য আধঘণ্টা সময় দেওয়া থাকত। সেই আধঘণ্টা শেষ হলে ধরে নেওয়া হত যে আসামির মৃত্যু হয়েছে, সেই সময় জল্লাদ ফাঁসির দড়ি কেটে দিত। প্রথা অনুসারে অ্যানের মৃতদেহ একটি কফিনে ঢুকিয়ে অক্সফোর্ডশায়ারের সার্জন উইলিয়া পেট্রির হাতে তুলে দেওয়া হয়। পেট্রি রুটিন মতন অ্যানের দেহটিকে কফিন থেকে বার করে পোস্টমর্টেম করার সময় চমকে উঠলেন। তিনি পরিষ্কার টের পেলেন যে অ্যানের ক্ষীণ নিশ্বাস পড়ছে। সে অজ্ঞান হলেও নিঃশ্বাস নিচ্ছে। মুহূর্তের জন্য তিনি চিন্তিত হয়ে পরেন যে মেয়েটিকে বাঁচিয়ে তিনি আইনের মারপ্যাঁচে পরে যাবেন না তো! পরক্ষণেই তার বিবেক জাগ্রত হয় যে তিনি একজন ডাক্তার, রোগীকে বাঁচানোই তার ধর্ম হওয়া উচিত।

শুরু হল রোগীকে নিয়ে ডাক্তার ও তার সহকারীদের লড়াই। মেয়েটির গলার অনেক টিস্যু ছিড়ে গিয়েছিল, জ্ঞান ফেরার পর সে ক্ষীণ স্বরে কাশতে থাকে। কাশির সঙ্গে রক্ত আসতে থাকে। তার হাত–পায়ের আঙ্গুলগুলো সব বেঁকে গিয়েছিল। অতিকষ্টে সেগুলোর কিছুটা ঠিক করা সম্ভব হয়। তার ঘাড়, হাত পায়ে ক্রমাগত কয়েকদিন ধরে ম্যাসেজ চলতে থাকে। বুকে লাগানো হয় হিটিং প্লান্টার। ডাক্তারবাবুর ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় অ্যান নতুন জীবন ফিরে পায়। তাকে সুস্থ করে বাড়ি ফিরে যেতে অনুমতি দেওয়া হয়। অনুমতি পেলেও সে বেচারি যাবে কোথায়। তার ঘরবাড়ি বাঁচার রসদ কিছুই যে নেই। 
ইতিমধ্যে সব দিকে রাষ্ট্র হয়ে যায় যে একজন মহিলা ফাঁসি দেবার পরেও বেঁচে উঠেছেন। ডাক্তারবাবু তাকে বাঁচিয়ে তুলেছেন। দলে দলে লোক সেই মহিলাকে দেখার জন্য ছুটে আসে। 
সার্জেন ডাক্তারবাবু বুদ্ধি করে টিকিটের ব্যবস্থা করে দেন। টিকিট বেঁচে ভালোই অর্থ উপার্জন হয়। সেই অর্থ দিয়েই অ্যান সচ্ছলভাবেই জীবন অতিবাহিত করত। অন্যদিকে সার্জেন নিজের জমানো অর্থ দিয়ে মামলা লড়েন। প্রথমেই সার্জেন আদালতে অ্যানের জামিনের আবেদন করেন। সেই আবেদন মঞ্জুর হয়। তারপরে বেশ কিছুদিন সওয়াল জবাবের শেষে অ্যান নির্দোষ প্রমাণিত হয় এবং বিনা শর্তে মুক্তি পায়। 
মুক্তি পাবার কিছুদিনের মধ্যেই অ্যান বিবাহ করে, সে তিন সন্তানের জননী হয়েছিল। দুর্ভাগ্যবশত চতুর্থ সন্তানের জন্ম দিতে গিয়েই ১৬৬৫ সালে মাত্র ৩৮ বছরে নিভে গেল অ্যানের জীবনদীপ।  সুন্দরী অ্যান কিন্তু তখনও অনেকের কাছেই আকর্ষণীয় ছিল।

সব ছবি: আন্তর্জাল

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *