আবু সিম্বেলের ইতিবৃত্ত 
ডঃ সঞ্জীব রায়

ভোরের আলো ফোটার অনেক আগেই নীলনদ–ক্রুজের জন্য নির্দিষ্ট জাহাজ ব্লু শ্যাডো থেকে নেমে আমরা গাড়িতে উঠলাম। সঙ্গে মিশর সরকারের একজন বন্দুকধারী রক্ষী। আমাদের গন্তব্য মিশরের অসওয়ান শহরের দক্ষিণ–পশ্চিমে নাসের লেকের তীরে অবস্থিত আবু সিম্বেল মন্দির। সুদান সীমান্তবর্তী এই মন্দিরের দূরত্ব অসওয়ান থেকে ২৪০ কিলোমিটার। পুরো রাস্তাটাই নুবিয়ান মরুভূমির ভেতর দিয়ে। অন্ধকারের পর্দা সরিয়ে দিবাকরের আবির্ভাব হল। ভোরের সেই উদিত সূর্যের আলো অত্যন্ত মনোরম। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে সূর্যস্নাত সোনালী বালির মাঝখান দিয়ে পিচ ঢালা রাস্তা ধরে আমাদের এগিয়ে চলা।

আবু সিম্বেল ইউনেস্কো ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইটের অন্তর্ভুক্ত। এঁকে অনেকে নুবিয়ান মনুমেন্ট নামেও অভিহিত করেন। এখানে দুটি মন্দির। একটি প্রচণ্ড পরাক্রমশালী সুশাসক ফ্যারাও দ্বিতীয় রামেসিসের এবং দ্বিতীয়টি ওনার পত্নী রানী নেফারতারির উদ্দেশ্যে নির্মিত। খ্রীষ্টপূর্ব আনুমানিক ১২৬৪–১২৪৪ সালে কাদেশ যুদ্ধজয়কে স্মরণীয় করে রাখতে দ্বিতীয় রামেসিসের হাতেই এই ভাস্কর্যের সৃষ্টি। দীর্ঘ ২০ বছর ধরে নির্মিত হয়েছিল এই মন্দির দুটি।
রামেসিসের মন্দিরের ভেতরের গভীরতা ১৮০ ফুট। ভেতরের বিরাট হলঘরটি আটটি স্তম্ভের উপর দাঁড়িয়ে। প্রত্যেকটি স্তম্ভের পুরোভাগে রামেসিস। মন্দিরের ভেতরের দেওয়ালে এবং ছাদে নক্ষত্রভরা আকাশ এবং নুবিয়ানবাসীদের বশ্যতা স্বীকারের দৃশ্য খোদাই করা আছে। অবাক হয়ে দেখতে হয় যে হাজার হাজার বছর অতিক্রান্ত হওয়া সত্ত্বেও মন্দিরের দেওয়ালের রঙ অনেকটাই অপরিবর্তিত আছে।

মন্দিরের গর্ভগৃহে বিশাল আকারের পাথরের বেদীতে পরপর চারটি মূর্তি। দেবতায় রূপান্তরিত হওয়া রামেসিসের সঙ্গে তিন দেবতা যথাক্রমে আমন, রা এবং টা— এঁদের মধ্যে রামেসিস নিজেকে যে সূর্যদেবতার সন্তান বলে মনে করতেন তিনি হচ্ছেন ‘রা’। আমন একসময়ে প্রাচীন মিশরের দেবরাজ হিসাবে স্বীকৃত হন এবং টা ছিলেন অন্ধকার জগতের দেবতা। মন্দিরটির কারিগরি নৈপুণ্য অসাধারণ। এটিকে পূর্বদিকে এমনভাবে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে যে বছরের দুটি নির্দিষ্ট দিনে অর্থাৎ ২১ ফেব্রুয়ারি এবং ২১ অক্টোবর সূর্য উদিত হবার সঙ্গে সঙ্গে সোনালী রশ্মি মন্দিরের মূল ফটকের ভেতর দিয়ে প্রবেশ করে রামেসিস ও আমনকে আলোকিত করে। ঐ দিন দুটি যথাক্রমে ফ্যারাও রামেসিসের জন্ম ও রাজ্যাভিষেকের দিন। বর্তমানে ঐ দিন দুটিকে মিশরে সূর্য উৎসব হিসাবে পালন করা হয়। ঐ উপলক্ষে প্রচুর বিদেশী পর্যটকদের মিশরে আগমন হয়।  

দ্বিতীয় মন্দিরটিরও ভেতরে গর্ভগৃহে রয়েছে রানীর মূর্তি। মূর্তির শিল্প কুশলতা নিঃসন্দেহে তারিফ যোগ্য। মূর্তি দেখে পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে যে রানী অসাধারণ সুন্দরী ছিলেন। মন্দিরটি রাজার মন্দিরের তুলনায় ছোট হলেও এই মন্দিরের সৌন্দর্য বা আকর্ষণ কোন অংশেই রাজার মন্দির অপেক্ষা কম নয়। 
নাসের হ্রদের নীল জলের পাশে নিঃস্তব্ধ ধূ ধূ প্রান্তরে রামেসিসের সঙ্গে স্ত্রী নেফারতারির সহাবস্থান যুগ যুগ ধরে বিশ্বপর্যটকদের আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু হিসাবে বিবেচিত হচ্ছে। শেষে বাহবা জানাতেই হয় সেই আবু সিম্বেল নামক বাচ্চা ছেলেটিকে যার অনুসন্ধানে বালির ভেতর থেকে আবিষ্কার হয় মিশরীয় সভ্যতার অমূল্য নিদর্শন এই মন্দির দুটি।

সব ছবি:‌ লেখক

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *