নবপত্রিকার অন্যদিক
ডঃ পার্থ বন্দ্যোপাধ্যায়
‘নবপত্রিকা’ দুর্গাপুজোর এক গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ। এটি হল প্রকৃতির উপাসনা। মোট ন’টি উপাদানকে একসঙ্গে বেঁধে তৈরি হয় প্রতীকী ‘নবপত্রিকা’। ‘নবপত্রিকা’ শব্দের অর্থ ন’টি পাতা। এই গাছগুলির প্রতিটি দেবী দুর্গা এবং তার বিভিন্ন রূপের একেকটি ভিন্নদিককে উপস্থাপন করে।
নরারুণ সমিতি, কোন্নগর। ছবি: প্রীতিময় রায়বর্মন
নবপত্রিকায় থাকা উদ্ভিদসমূহ—
১. কলা গাছ: দেবী ব্রাহ্মণীর প্রতীক।
২. কচু গাছ: দেবী কালিকার প্রতিনিধি।
৩. হলুদ গাছ: দেবী দুর্গার প্রতীক।
৪. জয়ন্তী গাছ: দুর্গার পুত্র কার্তিকের প্রতিনিধি।
৫. বেল গাছ: ভগবান শিবের সঙ্গে যুক্ত।
৬. ডালিম গাছ: দেবী রক্তদন্তিকার প্রতিনিধি।
৭. অশোক গাছের ডাল: দেবী শোকরহিতার প্রতীক।
৮. ধান গাছ: সম্পদের দেবী লক্ষ্মীর প্রতিনিধি।
৯. মান কচু গাছ: দেবী চামুন্ডার প্রতিনিধিত্ব করে।
তাৎপর্য
১. প্রকৃতির প্রতীক: নবপত্রিকা প্রকৃতি ও ঐশ্বরিক মধ্যে সংযোগ স্থাপন করে। প্রতিটি উদ্ভিদ জীবন এবং সমৃদ্ধির একেকটি ভিন্ন দিক উপস্থাপন করে। প্রকৃতির অনুগ্রহকে এভাবেই করা হয় উদযাপন।
২. ঐশ্বর্য ও সমৃদ্ধি: কলা গাছ, ঐশ্বর্য ও প্রাচুর্যের প্রতীক হিসাবে বিবেচিত হয়। আর অন্যান্য গাছগুলো সম্পদ, স্বাস্থ্য ও বিভিন্ন ক্ষতি থেকে সুরক্ষার প্রতিনিধি।
৩. ফসল কাটার উৎসব: দুর্গাপুজো শরতের ফসল কাটার মৌসুমে অনুষ্ঠিত হয় এবং নবপত্রিক ভালো ফসল উৎপাদন ও সামগ্রিক সমৃদ্ধির প্রার্থনার সঙ্গে যুক্ত।
৪. শৈব, বৈষ্ণব এবং শাক্ত ঐতিহ্যের সংমিশ্রণ: ন’টি উদ্ভিদ বিভিন্ন হিন্দু ঐতিহ্যের (শৈব, বৈষ্ণব এবং শাক্ত) একীভূতকরণেরও প্রতীক, যা দেবী দুর্গার সর্বজনীন শক্তির প্রতিনিধিত্ব করে।
দুর্গাপুজোর সপ্তমী দিন গঙ্গা বা নিকটবর্তী নদীতে স্নান করানো হয় নবপত্রিকা। তারপর গণেশের পাশে স্থাপন করা হয়। এই আচারটি প্রকৃতি, ঐশ্বর্য এবং জীবনের চক্রাকার পুনর্নবীকরণের গুরুত্ব তুলে ধরে।
নবপত্রিকায় ব্যবহৃত গাছপালা শুধুমাত্র আধ্যাত্মিক তাৎপর্যই রাখে না। রয়েছে ঔষধি উপকারিতা, স্বাস্থ্য–সম্পর্কিত গুরুত্ব, যা প্রকৃতি ও মানুষের মঙ্গলের সঙ্গে যুক্ত। চলুন দেখে নিই নবপত্রিকায় প্রতিটি উদ্ভিদের স্বাস্থ্য উপকারিতাগুলি—
১. কলা গাছ
আধ্যাত্মিক দিক: দেবী ব্রাহ্মণীর প্রতিনিধি।
স্বাস্থ্যগত গুরুত্ব: ● কলা পাতা ও ফল উভয়েই রয়েছে ফাইবার, পটাসিয়াম, ভিটামিন বি৬ এবং ভিটামিন সি।
● আয়ুর্বেদে গাছের পাতা চর্মরোগ ও হজমের সমস্যাজনিত চিকিৎসায় ব্যবহৃত হয়।
● কলা গাছের ফুল অর্থাৎ মোচার ভূমিকা রয়েছে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে। এছাড়া যা পিরিয়ডের রক্তপাত কমাতে এবং জরায়ুর স্বাস্থ্যকে ভালো রাখতে সাহায্য করে।
২. কচু গাছ
আধ্যাত্মিক দিক: দেবী কালিকার প্রতিনিধি।
স্বাস্থ্যগত গুরুত্ব: ● কচু পাতায় রয়েছে প্রচুর পরিমাণে ফাইবার, অ্যান্টি–অক্সিড্যান্ট, ভিটামিন এ এবং সি।
● প্রচুর পরিমাণে অ্যান্টি–অক্সিড্যান্ট থাকায় কচু হজমের উন্নতিতে যেমন সাহায্য করে, তেমনই সাহায্য করে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে, হৃদরোগ ও ক্যান্সারের মতো দীর্ঘস্থায়ী অসুখের ঝুঁকি কমায়।
● এছাড়া কোলেস্টেরল নিয়ন্ত্রণ এবং শক্তির খুব ভালো উৎস কচু।
৩. হলুদ গাছ
আধ্যাত্মিক দিক: দেবী দুর্গার প্রতীক।
স্বাস্থ্যগত গুরুত্ব: ● অ্যান্টি–ইনফ্লেমেটরি এবং অ্যান্টি–অক্সিড্যান্ট–সমৃদ্ধ খুবই সুপরিচিত উদ্ভিদ হলুদ।
● ক্ষত নিরাময় করে। বাড়ায় রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা। ভালো রাখে ত্বককে। আর্থারাইটিস এবং হজমের সমস্যায় দেয় উপশম।
● হলুদে রয়েছে কারকিউমিন, যা ক্যান্সার প্রতিরোধক।
৪. জয়ন্তী গাছ
আধ্যাত্মিক দিক: কার্তিকের প্রতিনিধি।
স্বাস্থ্যগত গুরুত্ব: ● জয়ন্তী গাছ জ্বর, প্রদাহ, শ্বাসকষ্ট, ত্বকের চিকিৎসায় ব্যবহৃত হয়।
● গাছের পাতা এবং বাকলে রয়েছে অ্যান্টি–মাইক্রোবিয়াল বৈশিষ্ট্য।
● এই গাছ অ্যান্টি–ডায়াবেটিক এবং হেপাটোপ্রোটেকটিভ (লিভার–সুরক্ষা) হিসেবেও পরিচিত।
৫. বেল গাছ
আধ্যাত্মিক দিক: ভগবান শিবের সঙ্গে যুক্ত।
স্বাস্থ্যগত গুরুত্ব: ● বেল গাছের ফল ও পাতা হজমে সাহায্য করে। বিশেষ করে কোষ্ঠকাঠিন্য এবং ডায়েরিয়াতে।
● বেল পাতায় রয়েছে অ্যান্টি–ইনফ্লেমেটরি, অ্যান্টি–অক্সিড্যান্ট ও অ্যান্টি–মাইক্রোবিয়াল উপাদান। আয়ুর্বেদ চিকিৎসায় যা ব্যবহৃত হয় ডায়াবেটিস, রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ানো এবং শ্বাসযন্ত্রের চিকিৎসায়।
● বেল শরীরকে ঠান্ডা রাখতে ও ত্বকের জন্যও উপকারী।
৬. ডালিম গাছ
আধ্যাত্মিক দিক: দেবী রক্তদান্তিকার প্রতিনিধি।
স্বাস্থ্যগত গুরুত্ব: ● ডালিমে রয়েছে ভরপুর অ্যান্টি–অক্সিড্যান্ট। বিশেষ করে পাউনিকাল্যাগিন, যা প্রদাহ উপশমে সাহায্য করে।
● ডালিম হার্টকে ভালো রাখে। কমায় রক্তচাপ। আর্থারাইটিস এবং জয়েন্টের ব্যথায় দেয় উপশম।
● ডালিমে রয়েছে ক্যান্সার–প্রতিরোধক উপাদান। বিশেষ করে প্রোস্টেট এবং স্তন ক্যান্সারের ঝুঁকি কমায়।
৭. অশোক গাছ
আধ্যাত্মিক দিক: দেবী শোকারহিতার প্রতীক।
স্বাস্থ্যগত গুরুত্ব: ● অশোক গাছের ছাল এবং পাতা পিরিয়ডের সমস্যা, জরায়ুর সমস্যা এবং মহিলাদের হরমোনের ভারসাম্যহীনতার চিকিৎসায় ব্যবহৃত হয়।
● গাছটি ব্যথা উপশমকারী, অ্যান্টি–অক্সিড্যান্ট ও অ্যান্টি–ইনফ্ল্যামেটরি বৈশিষ্ট্যের জন্য পরিচিত। আর্থারাইটিস ও অন্যান্য প্রদাহজনতি সমস্যায় দেয় উপশম।
● হজমের সমস্যার উন্নতি ও ত্বকের জন্যও উপকারী গুণাগুণ রয়েছে।
৮. ধান গাছ
আধ্যাত্মিক দিক: দেবী লক্ষ্মীর প্রতিনিধি।
স্বাস্থ্যগত গুরুত্ব: ● ভাত আমাদের অন্যতম প্রধান খাদ্য, যা প্রয়োজনীয় কার্বোহাইড্রেট ও শক্তির জোগান দেয়।
● ভাত সহজপাচ্য অর্থাৎ সহজে হজম হয়। তাই হজমের সমস্যায় ভাত খাবার পরামর্শ দেওয়া হয়।
● চালের জল ত্বকের স্বাস্থ্যকে ভালো রাখতে সাহায্য করে। এছাড়া ডায়রিয়ার চিকিৎসা ও হাইড্রেশনেও সহায়তা করে।
৯. মান কচু গাছ
আধ্যাত্মিক দিক: দেবী চামুন্ডার প্রতিনিধি।
স্বাস্থ্যগত গুরুত্ব: ● পাইলস, ব্রঙ্কাইটিস এবং হজমজনিত রোগের চিকিৎসায় বহু যুগ ধরে ব্যবহৃত হয়ে আসছে।
● এতে ফাইবার ছাড়াও রয়েছে অ্যান্টি–অক্সিড্যান্ট ও বিভিন্ন ভিটামিন। যা সাহায্য করে ওজন নিয়ন্ত্রণে, বাড়ায় হজমশক্তি, ভালো রাখে হার্টকে।
● অ্যান্টি–ইনফ্লামেটরি ও অ্যান্টি–মাইক্রোবিয়াল উপাদানও রয়েছে মান কচুতে।
নবপত্রিকার এই ন’টি উপাদানের একত্রে কিছু তাৎপর্য রয়েছে। যেমন—
সামগ্রিক নিরাময়: নবপত্রিকার গাছপালার সঙ্গে স্বাস্থ্যগত নিরাময়ের সম্পর্ক রয়েছে। আধ্যাত্মিক আচারের সঙ্গে বিভিন্ন প্রকৃতি উপাদানের ঔষধি গুণাগুণকে একত্রিত করে।
আয়ুর্বেদিক সংযোগ: এই গাছগুলির মধ্যে অনেকগুলি বহু যুগ ধরে আয়ুর্বেদিক ওষুধে ব্যবহৃত হয়ে আসছে।
পরিবেশ সচেতনতা: এই উদ্ভিদের পুজো মানুষকে প্রকৃতিকে রক্ষা এবং পরিবেশের সঙ্গে সামঞ্জস্য বজায় রাখার কথা মনে করিয়ে দেয়।
নবপত্রিকা শুধুমাত্র একটি ধর্মীয় আচার নয়, বরং এটি আধ্যাত্মিকতা, স্বাস্থ্য এবং প্রকৃতির মধ্যে গভীর সংযোগের প্রতিফলন। ঐশ্বরিক বা দেবত্ব প্রকৃতিতে বিরাজমান।
ছবি: আন্তর্জাল
Leave a Reply
Your email address will not be published. Required fields are marked *
Comments