প্রাসঙ্গিকতা মাতৃভাষা
রাণা চ্যাটার্জি
আমরা বাঙালি। বাংলা সাহিত্য, বাংলা ভাষা নিয়ে আমাদের একটা আবেগ ভীষণভাবে কাজ করে। কাজের প্রয়োজনে অন্য ভাষার প্রতি আগ্রহ রাখতেই হয়, প্রয়োজনে সেটাকে রপ্ত করা, রুটি–রুজির প্রয়োজনে। যদিও একে আকর্ষণ ঠিক বলে না, শেখার প্রয়োজনের বাধ্যবাধকতা থেকে আসে। বর্তমানে বিশ্বায়নের প্রভাবকে অস্বীকার করা সম্ভব নয়। তাই অনেককেই নানা ভাষা শিখতে হয়। কিন্তু তার জন্য নিজেদের সংস্কৃতি, ভাষাকে অমর্যাদা করার ভাবনা বা এড়িয়ে যাওয়াটাকেও মন থেকে সমর্থন করি না।
আমরা যারা বাঙালি, সেই ‘আতা গাছে তোতা পাখি’— সহজ পাঠের মন উদাস করা ছবিতে ভাবুক হওয়া শিখেছি, সরস্বতী পুজোর মাদকতা মেখে হাতেখড়ি দিয়ে মা–ঠাম্মার মুখে মুখে শেখানো বুলির মতো অনর্গল কবিতা আউড়ে গেছি, তারা কী করে ভুলে যেতে পারি মাতৃভাষা বাংলাকে! আসলে ভুলে যেতে চাই না, এটা অনুভবে রেখেও সর্বস্তরে নিজেকে, নিজের পরবর্তী প্রজন্মকে কোনও বিদেশি ভাষায় রপ্ত হতে শিক্ষা দিই। কিন্তু সে জন্য একেবারেই বাংলা চর্চাকে সরিয়ে রেখে, ভুলে থাকতে চাওয়ার প্রয়াস কিন্তু উদ্দেশ্য হওয়া উচিত নয়। মাতৃভাষা মাতৃ দুগ্ধসম। এটা মাথায় রেখেও মাতৃভাষায় কথা বলে, পরিচয় দিতে কেন সঙ্কোচ হবে? সত্যিই কি এটা উচিত!!
বাংলা ভাষার মিষ্টত্ব ভোলা সম্ভব নয়। বাংলা ভাষার সুমিষ্টতাকে প্রতি মুহূর্তে তাই উপলব্ধি করি। নিজের ভাষাকে অচ্ছুৎ করে অন্য ভাষা নিয়ে গর্বে ছাতি ফোলানোও কাম্য নয়। কখনো নিজের মাতৃভাষাকে হেয় প্রতিপন্ন করে বিদেশি ভাষাকে বেশি সমৃদ্ধ প্রমাণ করতে চাওয়ার দৃশ্য পরিবার সমাজ সংসারে হামেশাই দেখা যায়। কিন্তু ওসব তাৎক্ষণিক আবেগ–অভিমান সরিয়ে দেখলে বোঝা যাবে, সারা বিশ্বে অগণিত ভাষার মধ্যে বাংলা ভাষাভাষী মানুষের সংখ্যা প্রথম সারিতে এবং বাংলাকে নিয়ে প্রতিনিয়ত চর্চা করার প্রবণতার গ্রাফও বেশ উর্ধ্বমুখী।
প্রতি বছর ২১শে ফেব্রুয়ারি দিনটি ভাষা শহীদ দিবস হিসাবে বাঙালিরা পালন করি। ইতিহাস ঘাঁটলে বুঝতে পারা যায় বাংলা ভাষাকে কেন্দ্র করে ভাষা আন্দোলনের তীব্রতা, রক্তক্ষয়ী আন্দোলন কী ব্যাপক চেহারা নিয়েছিল। ঝরে গিয়েছিল কত তাজা প্রাণ! তারুণ সালাম, বরকত, রফিক, শফিক, জব্বারের রক্তে রাঙা হয়ে পেয়েছি আমরা কাঙ্খিত মাতৃভাষা। বাংলা অত্যন্ত শ্রুতিমধুর ও মিষ্টি ভাষা হিসাবে সারা বিশ্বে পরিগণিত। এই ভাষায় যে পরিমাণ জনসংখ্যার মানুষ কথা বলে, সেই তথ্য আমাদের উৎসাহিত ও গর্বিত করে। কারণ সেই দিক থেকে বাংলার স্থান ভাষা হিসাবে তৃতীয়— বাংলাভাষা ব্যবহারকারীর সংখ্যা বিচারে।
তবু বাংলাভাষাকে সংরক্ষণ, ব্যবহারিক ভাষা হিসাবে রক্ষা করার তাগিদ বর্তমান প্রজন্মের মধ্যে খুব কম পরিলক্ষিত হয়। প্রবাসী বাঙালিরা বাংলা সাহিত্য, বাংলা ভাষা নিয়ে চর্চার ক্ষেত্রে যে পরিমাণ প্রয়াস নেয় তা এখানকার বর্তমান প্রজন্মের মধ্যে সেভাবে দেখা যায় না। এর পেছনে যে কারণটা উঠে আসছে তা হল অধিকাংশ অভিভাবকই চাইছেন, বাংলা নয়, ইংরাজি, বিদেশি ভাষা শিখুক তার সন্তান। নইলে আগামী অন্ধকার, পিছিয়ে পড়বে তারা। সার্বিক বিচারে পিছিয়ে পড়ার যুক্তি প্রতিষ্ঠা হওয়ার লক্ষ্যে অবশ্যই অন্য ভাষা শেখা যেতেই পারে। কিন্তু নিজের ভাষাকে একদম সরিয়ে রাখা, তা পড়তে সন্তানদের উৎসাহিত না করা এটা মোটেও ঠিক নয় বরং সময় সুযোগ মতো নিজ ভাষার গভীরতায় সমৃদ্ধ হতে সন্তানদের কাছে বাংলা সাহিত্য, বাংলা গান প্রভৃতি সহজলভ্য করা দরকার। আমাদের মাতৃভাষা বাংলা যে কতটা সমৃদ্ধ,তার সাহিত্য ভাণ্ডার কতখানি গভীর এই ভাবনার বীজ আগামী প্রজন্মের কাছে,তাদের মনে রোপণসহ এর প্রতি শ্রদ্ধা বৃদ্ধি করানোর কিছুটা দায়িত্ব অভিভাবক, শিক্ষক, বাড়ির বড়দের ওপর বর্তায়। নিজে যদি ভিন্ন ভাবনা পোষণ করি, তাহলে আমার সন্তান সন্ততি আমার আচরণে ঠিক কী শিখবে এটা বুঝতে হবে। এভাবেই সন্তানদের মধ্যে বাংলা ভাষার সমুদ্র সমান গভীরতা, মাদকতা, বাংলার সাহিত্যিক বা কবিদের অমর সৃষ্টিকে জানা,পড়ার ইচ্ছার বীজ সঞ্চারিত হোক। মাতৃভাষাকে নিয়ে মাতামাতি না হোক, কিন্তু বাংলা লিখতে পড়তে শিখবে না সন্তান! এটা সত্যিই বাংলা ভাষার পক্ষে অবমাননাকর।
সরকারি, প্রশাসনিক দিক থেকেও বাংলা ভাষার প্রসারে নানান উদ্যোগ নেওয়া উচিত। কেন আমরা পারবো না বাংলা ভাষভাষী এলাকা বা রাজ্যে বাংলা ভাষাকে অফিসিয়াল ভাষা হিসাবে আনতে বা অফিসের কাজকর্ম চালানোর মাধ্যম হিসাবে সমান্তরাল ভাবে তুলে ধরতে এটা দেখা যেতে পারে। তবুও আশার কথা, বিভিন্ন অফিস, দোকান প্রতিষ্ঠানে বাংলা ভাষাতেই পোস্টার, হোর্ডিং টাঙানোর প্রয়াস বেড়েছ। যা ভাল লাগে। তবু নিজেদের সচেষ্ট হতে হবে বাংলা সাহিত্যের বিপুল গভীরতাকে সন্তানদের পড়তে আগ্রহী করে বাঁচিয়ে রাখতে। তবেই না ভাষা আন্দোলনে শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধার্ঘ্য।ক্যারিয়ারের স্বার্থে বা বৃহৎ প্রতিযোগিতার স্বার্থে অন্য ভাষায় পড়াশোনা হোক, রপ্ত করুক সন্তানরা নানান ভাষা। তাতে ক্ষতি কী? বরং যুগের তালে তাল মিলিয়ে চলতে এটা দরকার। তবুও এর পাশাপাশি কিন্তু প্রাণের ভাষা মাতৃভাষা বাংলাও শিখুক তারা। বাংলা ভাষার যে বিপুল সাহিত্য সমৃদ্ধি, সাগরের মতো গভীর ব্যাপ্তি তা থেকে যেন অবিভাবকদের উন্নাসিকতায় সন্তানরা বঞ্চিত না হয়। বাংলা সাহিত্য, বাংলা গানের জাদু সিডি ড্রাইভে বন্দি হয়ে কেবল যেন ড্রইংরুমের পেল্লাই ওয়াড্রব ঠাসা থাকে না। বরং সঞ্চারিত হোক বর্তমান ও আগামী প্রজন্মের মনন চেতনায়। ছোট ছোট উদ্যোগ যদি নিজেরা নিতে পারি তবেই বাঁচবে আমাদের বাংলা ভাষা, সার্থক হবে ভাষা দিবস ও বাংলাভাষাকে যোগ্য সম্মান দিয়ে প্রতিষ্ঠার জন্য দীর্ঘ লড়াইয়ের ইতিহাস।
একুশ তুমি
বিজন বেপারী
একুশ তুমি বাঙালিদের
ফাগুন আগুন দিন
তোমার কাছে মাথানত
চির জীবন ঋণ।
একুশ তুমি স্মৃতি করুণ
রক্তে মাখামাখি
ভালোবাসার অশ্রু বিন্দু
তোমার পায়ে রাখি।
বুকে সাহস মায়ের প্রতি
থাকলে ভালোবাসা
যুদ্ধ জয়ে বিজয় মালা
দেশ জাতি আর ভাষা।
একুশ তুমি অহংকার আজ
বিশ্বজুড়ে খ্যাতি
বাংলা ভাষা শ্রেষ্ঠ সবার
শ্রেষ্ঠ আমার জাতি।
আফ্রিকার দেশে
‘সরকারি ভাষা’ বাংলা!
প্রীতিময় রায়বর্মন
দুই বাংলা থেকে প্রায় ১৫ হাজার কিলোমিটার দূরে পশ্চিম আফ্রিকার ছোট্ট দেশ সিয়েরা লিওন। যাকে বলা হয় ‘হীরের খনির গরিব দেশ’। যেখানে অন্যতম ‘সরকারি ভাষা’ বাংলা! শুনতে অবাক লাগলেও, সত্যি। সিয়েরা লিওনের আয়তন ৭১,৭৪০ বর্গকিমি। জনসংখ্যা ৭৫ লাখের মতো। দেশটিতে বসবাসকারি ১৬টি ক্ষুদ্র জাতিসত্ত্বার নিজস্ব ভাষা ও সংস্কৃতি রয়েছে। অধিকাংশ দেশবাসীই কথা বলেন ক্রিও ভাষায়। ইংরেজির সঙ্গে স্থানীয় ভাষারগুলির সংমিশ্রণে তৈরি এই ভাষা। সরকারি ভাষা ও শিক্ষার মাধ্যম ইংরেজি, ক্রিও হলে, সেখানে বাংলাও পেয়েছে ‘সরকারি ভাষা’–র মর্যাদা।
১৯৬১ সালের ২৭ এপ্রিল অবসান ঘটে ব্রিটিশ শাসনের। স্বাধীনতা পায় সিয়েরা লিওন। আনন্দ, উৎসবের মধ্যে দিয়ে শুরুটা ভালোই হয়েছিল। বেশ ভালোভাবেই চলছিল মানুষের জীবনযাপন। ১৯৬৪ সালে দেশের প্রধান স্যার মিল্টন মারগাইয়ের মৃত্যুর পরেই ছন্দপতন। দূর্নীতি, অপশাসনের ফলে দেশজুড়ে দেখা দেয় চরম বিশৃঙ্খলা। উপজাতি গোষ্ঠীর মধ্যে শুরু হয় ঝামেলা, হানাহানি। ক্রমে তা রূপ নেয় গৃহযুদ্ধের। দেশ জুড়ে শুরু হয় হিংসাত্মক কার্যকলাপ, ধ্বংসযজ্ঞ। ১৯৯১ সালের ২৩ মার্চ বিদ্রোহীরা চেষ্টা করে রাষ্ট্রপতি জোসেফ মোমাহকে ক্ষমতাচ্যূত করার। শুরু অস্ত্রের দাপাদাপি। শুরু নিজেদের মধ্যে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ। মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন হাজার হাজার মানুষ। বহু মানুষ ঘরবাড়ি ছেড়ে পালায় নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে।
দেশের সরকার পরিস্থিতি মোকাবিলায় ব্যর্থ হলে সমস্যা সমাধানে এগিয়ে আসে প্রতিবেশী দেশগুলো। কিন্তু কিছুতেই পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে না আসায় ১৯৯৯ সালে সিয়েরা লিওনে শান্তি ফেরাতে উদ্যোগ নেয় জাতিসঙ্ঘ। শান্তি মিশনে যোগ দেয় বাংলাদেশসহ ১৩টি দেশ। প্রথমে ওপার বাংলার ৭৭৫ জন সেনার একটি দল দেশটির দক্ষিণে লুঙ্গিতে শান্তি স্থাপনের জন্য গিয়ে পৌঁছায়। এক সময়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে দেশটি ছড়িয়ে–ছিটিয়ে ছিলেন বাংলাদেশের প্রায় ৫,৩০০ জন সেনা। সিয়েরা লিওনে জাতিসঙ্ঘের শান্তি মিশনে প্রায় ১২ হাজার বাংলাদেশী সেনা অংশ নেন। শান্তি ফিরলে ২০০৫ সালে নিজ দেশে ফেরেন তাঁরা।
বিদ্রোহ দমনে সামরিক অভিযানের পাশাপাশি, দেশবাসীকে আবার স্বাভাবিক জীবনযাপনে ফিরিয়ে আনতে সচেষ্ট হন ওপার বাংলার সেনাবাহিনী। মানুষের মধ্যে প্রশাসনিক আস্থা প্রতিষ্ঠায় সচেষ্ট হন তাঁরা। স্থানীয়দের সঙ্গে কথোপকথনে ইংরেজির পাশাপাশি মাতৃভাষা বাংলারও ব্যবহার করতেন তাঁরা। বাংলা ভাষা এতোটাই শ্রুতিমধুর যে সিয়েরা লিওনের মানুষজন ভালোবেসে ফেলে এই ভাষাকে। শিখতে শুরু করেন বাংলা। আপন করে নেন এই ভাষাকে। শুধু ভাষাই নয়, বাঙালীর ঐতিহ্য, সংস্কৃতির সঙ্গে তাঁদের পরিচয় করিয়ে দিতে থাকেন শান্তি স্থাপনে আসা একঝাঁক বাঙালি সেনা।
যেখানে যেখানে বাংলাদেশী সেনারা কর্মরত ছিলেন সেখানকার মানুষজন বিশেষ করে তরুণ–তরুণীরা রপ্ত করে নেয় বাংলা। কথোপকথনে ব্যবহার করতে থাকেন বাংলা ভাষা। সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে স্থান পায় বাংলা গান ও নাচ। বিদ্রোহ দমনের পাশাপাশি স্থানীয়দের আশা–ভরসার স্থল হয়ে ওঠেছিল বাংলাদেশী সৈন্যবাহিনী। বিবাদমান উপজাতি গোষ্ঠীর মধ্যে সম্প্রীতি স্থাপন করেন তাঁরা। তাঁদের আন্তরিকতা মন জয় করে নিয়েছিল সিয়েরা লিওনের বাসিন্দাদের। তাই তো তাঁরা আকৃষ্ট হয়েছিল বাঙালি সংস্কৃতি, ভাষার প্রতি।
২০০২ সালে দেশে ফেরে শান্তি। ১২ ডিসেম্বর তৎকালীন রাষ্ট্রপতি আহমেদ তেজান কাব্বা দেশ পুর্ণগঠন ও শান্তি ফেরানোয় বাংলাদেশী সেনাদের অবদানের জন্য তাঁদের কৃতজ্ঞতা জানানোর পাশাপাশি বাংলা ভাষাকে দেশের অন্যতম সরকারি ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দেন। সরকারি প্রতিষ্ঠান, স্কুল–কলেজে প্রধান ভাষা ইংরেজি ও ক্রিও–র পাশাপাশি বাংলাও সরকারি ভাষা। সিয়েরা লিওনে সরকারি ভাষা হিসেবে বাংলার স্বীকৃতি বাঙালিদের কাছে সত্যিই গর্বের। কুর্নিশ জানাই সেই সব সেনাদের যাঁদের জন্য সূদূর পশ্চিম আফ্রিকায় বাংলা ভাষা ও বাংলার সংস্কৃতি পেল এতোটা সমাদর।
সব ছবি: আন্তর্জাল
Leave a Reply
Your email address will not be published. Required fields are marked *
Comments