কেন কোজাগরী লক্ষ্মীপুজো?
মা লক্ষ্মীর বাহন হিসেবে পেঁচার গুরুত্ব কতখানি?

সুমন কল্যাণ চক্রবর্তী

বাংলার প্রায় প্রতিটি হিন্দু ঘরে কৃষি সমাজের শস্য প্রাচুর্যের ও সমৃদ্ধির দেবী তথা বিষ্ণুপুরাণে খ্যাত ভৃগুপত্নী ‘মা লক্ষ্মী’ বহু বছর ধরে পূজিতা হয়ে আসছেন। বাংলা ছাড়া তামিল ভাষায় মা লক্ষ্মী ‘আলাই মগল’ (সমুদ্রজাত কন্যা বা সিন্ধুজা) নামে পরিচিত, যিনি ধন-রত্ন ছাড়াও জ্ঞান ও সচ্চরিত্র প্রদান করেন জগতের সব মনুষ্যজাতিকে। আশ্বিন মাসের পূর্ণিমার চাঁদকে ‘কোজাগর’ বলা হয়, আর সেই পূর্ণিমা তিথিতে যে লক্ষ্মীপুজো পালিত হয়, তাকে ‘কোজাগরী’ লক্ষ্মীপুজো বলা হয়। এই কোজাগরী পূর্ণিমায় চাঁদ ও পৃথিবী খুব কাছাকাছি চলে আসে, তাই পৃথিবীর বুক থেকে চাঁদের আকার ও ঔজ্জ্বল্য বৃদ্ধি পায়। চাঁদের আলোর ঐ রাতে চাঁদের আলোয় ক্ষির রেখে পরদিন সেটা খাওয়ার রীতি লক্ষ্য করা যায় গুজরাটিদের মধ্যে। এছাড়াও গুজরাটিরা ঐ সময়ে গরবা ও ডান্ডি উৎসবও পালন করে থাকে।

ঐ দিনেই কুমার কার্তিকের জন্ম হিসেবে উড়িষ্যায় পালিত হয় ‘কুমার পূর্ণিমা’ উৎসব। সারা ভারত জুড়ে বিদ্যালী, গজলক্ষী, বিজয়লক্ষী, ধৈৰ্য্যলক্ষী, ধান্যলক্ষী, সন্তানলক্ষী, ধনলক্ষী ও আদিলগ্নী— মোট এই আটটি রূপে পূজিতা হন মা লক্ষ্মী। শাস্ত্রমতে মা লক্ষ্মীর এই আটটি রূপ ও কয়েকটি ক্ষেত্রে বহুভুজা হলেও বাঙালি তাঁকে দ্বিভুজা বানিয়ে আপন করে নিজের ঘরে তুলে নিয়েছে। ‘ধন’ যেহেতু হস্তান্তর হয়, জনশ্রুতি আছে মা লক্ষ্মী তাই নাকি এক স্থানে থাকেন না; অতএব, মা লক্ষ্মী চঞ্চলা প্রকৃতির কিন্তু সদা হাস্যময়ী। ধারনা করা হয়, কুপাত্রের হস্তে অধিক ধন আসলে সে সেই ধনের অসৎ প্রয়োগ করে, ফলে সে লক্ষ্মীকে হারায়। লক্ষ্মীকে, বাঙালি ধন-সম্পদ ও সৌভাগ্যের দেবী মনে করে গৃহস্থে আরাধনা করে চলেছে বহু বছর ধরে। যেহেতু চরিত্রধন মানুষের মহাধন, সে জন্য বলা হয় যার ধন-সম্পদ নেই সে লক্ষ্মীহীন, তেমনিই যার চরিত্রধন নেই সে লক্ষ্মীছাড়া। হিন্দু ধর্ম ছাড়া বৌদ্ধ ও জৈন ধর্মে সৌন্দর্য ও সমৃদ্ধির দেবী হিসেবে বিবেচিত হন মা লক্ষ্মী। ভারতীয় বিভিন্ন শিল্পকলা ও মুদ্রায়, মধ্যপ্রদেশের সাচী কিংবা মহারাষ্ট্রের অমরাবতীতে মা লক্ষ্মীর ভাস্কর্য চোখে পড়ে। মধ্যপ্রদেশের বেসনগরের (বিদিশা) ভারতীয় সংগ্রহালয়ে একটি কল্পবৃক্ষ দেখতে পাওয়া যায়, যেটি সম্ভবত খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয় শতকের বলে গবেষকরা মনে করেন, সেখানেও ধন-সম্পদের সঙ্গে শঙ্খ ও পদ্মের চিহ্ন লক্ষ্য করা যায়। এই কল্পবৃক্ষের সঙ্গে কুবের কিংবা মা লক্ষ্মীর যোগসূত্র আছে বলে অনেকের মুখে শোনা যায়।

পুরাণ থেকে জানা যায়, ‘কো জাগতী’ কথাটি থেকে কোজাগর শব্দটি এসেছে, যার অর্থ ‘কে জেগে আছ’; যার কিছু নেই সে পাওয়ার আশায় জাগে আর যার অতিরিক্ত কিছু আছে সে হারানোর আশায় জাগে। এই পূর্ণিমার দিনে নাকি মা লক্ষ্মী জগৎ পরিক্রমায় বেরিয়ে দেখেন কেউ জেগে আছে কিনা; ওই রাত্রে যে ব্যক্তি জেগে থাকে ও অক্ষক্রীড়া (পাশাখেলা) করে, মা লক্ষ্মী তাকে ধন-সম্পদ ও সৌভাগ্যে ভরিয়ে রাখেন বলে ভক্তদের বিশ্বাস। একটি তথ্যমতে, ‘অক্ষ’ শব্দটির অর্থ ‘ক্রয় বিক্রয়ের চিন্তা’, তাই ব্যবসা-বানিজ্যে উন্নতি করার জন্যও অনেকে এই পূর্ণিমার দিনে মা লক্ষ্মীর পূজা করে থাকেন। আবার, ‘রুদ্রাক্ষ’ বা জপের মালা-র অর্থ বোঝাতে ‘অক্ষ’ শব্দটি ব্যবহৃত হয়, তাই বহু ভক্ত মা লক্ষ্মীর কৃপা পাওয়ার আশায় তাঁর নামের মালা জপ করেন বলে শোনা যায়। লক্ষ্মীপুজোর মাহাত্ম বোঝানোর জন্য জল ও চালের গু‌ঁড়ো মিশিয়ে মানুষের মনের কামনার প্রতিচ্ছবিস্বরূপ ‘আলপনার’ সঙ্গে আঁকা হয় ধানের ছড়া, আমের পল্লব এবং মা লক্ষ্মীর ‘পা’।

আশা করা হয়, ঐ পা ফেলেই ‘মা লক্ষী’ গৃহস্থের ঘরে এসে পূজিতা হয়ে আশীৰ্বাদস্বরূপ ধন-সম্পদ ও সৌভাগ্য প্রদান করবেন। হিন্দুদের অনেক ঘরে বিশেষ করে পূর্ববঙ্গের লোকেদের ক্ষেত্রে ‘পটচিত্রে’ বা সরায় জয়া-বিজয়া সহ কয়েকটি বিশেষ পুতুলকে, রাধাকৃষ্ণ ও সপরিবারে দুর্গা অঙ্কন করে মা লক্ষ্মীর আরাধনা করা হয় এবং ঐ দিন পাঁচ প্রকারের মাছের রান্না করা হয়। অনেকের বাড়িতে লক্ষ্মীপুজোর দিন ‘জোড়া ইলিশ’ খাওয়ার প্রচলন থাকলেও প্রধানত লক্ষ্মীপুজোর ভােগ হিসেবে নারকেল, ভুশ বা তিলের নাড়ু, লুচি-পায়েস সহ খিচুড়ি ও লাবড়া দেওয়া হয়ে থাকে। অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা ‘বাংলার ব্রত’ ও নীহাররঞ্জন রায়ের লেখা ‘বাঙালির ইতিহাস’ বইয়ে বাঙালি তথা হিন্দু সমাজে মা লক্ষ্মীর জনপ্রিয়তাকে তুলে ধরা হয়েছে। তাই বাঙালি তথা হিন্দু সমাজের মানুষেরা পুজোর উপাচারের নৈবেদ্য সাজিয়ে মা লক্ষ্মীর উদ্দ্যেশ্যে অন্তর থেকে বলে ওঠে— এসো মা লক্ষ্মী বসো ঘরে, আমার এ ঘরে থাকো আলো করে।

গ্রিক দেবী এথেনা এবং রোমান দেবতা মির্নাভা-র সঙ্গে মা লক্ষ্মীর দুটি মিল লক্ষ্য করা যায়। একটি হল এঁরা সবাই জ্ঞান প্রদান করেন এবং এঁদের প্রত্যেকের বাহন হল ‘পেঁচা’। ইউরােপ ও আমেরিকাতে এবং বাংলাসহ সারা এশিয়াতে ভুতুম পেঁচা (বৈজ্ঞানিক নাম– কেটুপা জেইলনেনসিস)-কে নিশাচরী স্বভাবের জন্য অশুভ প্রাণী ও মৃত্যুর দূত হিসেবে দেখা হয়। কিন্তু লক্ষ্মীপেঁচা (বৈজ্ঞানিক নাম– টাইটো অ্যাল্বা)-কে আবার মা লক্ষ্মীর বাহন হিসেবে পুজো করা হয়। এর কারণস্বরূপ পুরাণ থেকে জানা যায়, লক্ষ্মীপেঁচা হল ভগবান শ্রীবিষ্ণুর বাহন গরুড়ের পরিবর্তিত রূপ যেটি তার স্ত্রী (মা লক্ষ্মী) ব্যবহার করে থাকেন। মা লক্ষ্মীর দেওয়া ধন যে ব্যক্তি অপচয় ও অপব্যবহার করে, তার কপালে রয়েছে যমের দন্ড। অপরদিকে, ধন-সম্পদের বাড়বাড়ন্ত হলে অশুভ শক্তি বাড়তে থাকে; তাই সতর্কীকরনের বার্তা হিসেবে পেঁচা মানুষকে অবগত করে ‘লোভে পাপ, পাপে মৃত্যু’ কথাটি ব্যক্ত করে।

বাস্তবে, পেঁচা মনুষ্যকূলকে পরমার্থ চিন্তার আদর্শকে শিখিয়ে মা লক্ষ্মীর কৃপা পেতে সাহায্য করে থাকে। অনেকে মনে করেন, ধন-সম্পত্তি সদাজাগ্রত অবস্থায় রক্ষা করতে হয়; রাতে মানুষ যখন ঘুমিয়ে পড়ে, ঠিক তখনই পেঁচা রাত জেগে মানুষের ধন-সম্পদ পাহারা দেয়। দিনে যেহেতু পেঁচা অন্ধ, আমরাও যেন ঠিক পরের ধন সম্বন্ধে অন্ধ হই— এই ধারণা শাস্ত্রে ব্যক্ত হয়েছে। আরেকটি কারণ স্বরূপ বলা হয়, ধানক্ষেত ও গোলাঘরের কাছে ইদুর বসবাস করে শস্য কেটে, নষ্ট করে ও খেয়ে ফসলের প্রভূত ক্ষতি করে। পেঁচা ঐ সকল ইদুর খেয়ে খাদ্যশস্য রক্ষা করে মানুষের উপকার করে। তাই মা লক্ষ্মীর বাহন হিসেবে মা লক্ষ্মীর সঙ্গে পেঁচাও বাঙালির ঘরে ঘরে পূজিত হয়ে আসছে, যেটির যথার্থতা, যৌক্তিকতা ও সার্থকতা রয়েছে বলে ধরে নেওয়া হয়েছে।

ছবি: আন্তর্জাল

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *