কিন্নরের পথে পথে বেড়ালে নির্জনতা ও নৈসর্গের নিবিড় নৈকট্য মেলে। প্রশান্তি জাগায় নতুন আস্থা। এই সার্কিট বেড়াতে কালকা বা সিমলা থেকে গাড়ি ভাড়া করে নেওয়াই ভাল। তাতে সুবিধা বেশি। সময়ও সাশ্রয় হয়।
সিমলা
রাজ্য রাজধানী ও পাহাড়ের রানি সিমলা। আমরা অবশ্য এই সার্কিটে সিমলাতে বেশি সময় নেব না। বড় জোর একদিন কাটিয়ে কিন্নরের পথে রওনা হব।
যাবেন: ১২৩১১ কালকা মেল সন্ধ্যা ৭.৪০ মিনিটে হাওড়া ছেড়ে ৩য় দিন ভোর ৪.৪০ মিনিটে কালকা পৌঁছায়। দিল্লি হয়েও কালকা যাওয়া যেতে পারে। কালকা থেকে সিমলা চলুন সড়কপথে কিংবা টয় ট্রেনে।
এ শহরের একটা বিদেশি ‘লুক’ আছে। ব্রিটিশ চলে গেলেও সিমলাতে তাঁদের অস্তিত্ব অনুভব করা যায়।
দি রিজ: সিমলা ম্যালের অন্য নাম। একধারে নিও–গথিক স্থাপত্যের অ্যাঙ্গলেশিয়ান ক্রাইস্ট চার্চ। পাশে রাজ্য গ্রন্থাগার, টাউন হল, মিউনিসিপ্যালিটি বিল্ডিং, গেইটি থিয়েটার। কাছেই লক্কর বাজারে মিলবে কাঠের কাজের জিনিস ও কুলু শালের দোকান।
জাকু হিলস: শীর্ষে হনুমান মন্দির। বিশ্বাস করা হয়, গন্ধমাদন পর্বত আনার সময় পবনপুত্র হনুমান এখানে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়েছিলেন।
সেন্ট মাইকেল ক্যাথেড্রাল: ম্যালের কাছে জেলা আদালতের তলায় দৃষ্টিনন্দন রঙিন কাচের এই চার্চ।
কালিবাড়ি: ১৮৪৫ সালে তৈরি এই মন্দির সিমলায় বিখ্যাত। থাকার ব্যবস্থা আছে।
ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ অ্যাডভান্সড স্টাটিজ: অবজারভেটরি হিলসের ওপরে লর্ড ডাফরিনের জন্য নির্মিত বিশাল এই প্রাসাদটির সঙ্গে বহু ইতিহাস জড়িয়ে।
অন্যান্য: জনিজ ওয়াক্স মিউজিয়াম, স্টেট মিউজিয়াম, আন্নাডেল (৪.৫ কিমি), প্রসপেক্ট হিল ও কামনা দেবী (৬ কিমি), সঙ্কট মোচন (৭ কিমি), সামার হিলস ও চ্যাডউইক ফলস ইত্যাদি।
কাছেপিঠে: কুফরি–ফাগু–চিনিবাংলো–মলদেরা–তত্তপানি কিংবা ফাগু–মতিয়ানা–নারকাণ্ডা দেখবার মতো।
বেড়াবেন: এমনিতে সিমলার দ্রষ্টব্য পায়ে হেঁটেই দেখতে পারেন। রাজ্য পর্যটনের মোড়ক সফরে সামিল হয়ে কিংবা গাড়ি ভাড়া করেও বাকি দ্রষ্টব্য দেখা সম্ভব।
থাকবেন: রাজ্য পর্যটনের দুটি ব্যবস্থা। হলিডে হোম (০১৭৭–২৮১২৮৯০) ও হোটেল পিটার হফ (২৮১২২৩৬)। মন্দির মার্গের সিমলা কালীবাড়ি (২৬৫২৯৬৪) ছাড়াও বহু বেসরকারি হোটেল আছে।
রামপুর
চীন ও তিব্বতের সঙ্গে ব্যবসার সুবাদে শতদ্রু নদীর তীরের প্রাচীন এই জনপদের প্রসিদ্ধি ছিল।
যাবেন: সিমলা থেকে রামপুর ১৩৫ কিমি। ২২ নম্বর জাতীয় সড়ক ধরে এগোলে পথে পড়ে কুফরি, নারকাণ্ডা ও ফাগু। কিঙ্গল থেকে শতদ্রু নদী সঙ্গী হয়, নোগলিতে সে যেন পাশের সহযাত্রী। ভোরে রওনা হলে দুপুর দুপুর পৌঁছে যাবেন রামপুর।
রাজপুত বুশাহার রাজাদের রাজধানী ছিল এই রামপুর।
পদম প্যালেস: ১৯১৯ সালে পদম সিংয়ের তৈরি রামপুরের এই বিখ্যাত দ্রষ্টব্য বাস রাস্তার ওপরেই। প্রাসাদটি পাথর ও কাঠের সংমিশ্রণে তৈরি মনোহর স্থাপত্যরীতির। নিচতলা পাথরের, ওপরতলা কাঠের।
লক্ষ্মীনারায়ণ মন্দির: বাজারের নিচে অবস্থিত প্রাচীন এই মন্দিরটি পায়ে হেঁটে দেখে আসা যায়।
অন্যান্য: আছে বৌদ্ধমন্দির ও অযোধ্যানাথ মন্দির। নভেম্বর মাসে জনপ্রিয় মেলা এখানে লাভি মেলা বসে।
থাকবেন: রাজ্য পর্যটনের হোটেল বুশাহার রিজেন্সি (০১৮৭২–২২৩১০২) ছাড়াও বেসরকারি ব্যবস্থা আছে। তবে এ যাত্রায় রামপুরে থাকার দরকার হয় না। একটু বেড়িয়ে বাস স্ট্যান্ডের আশেপাশের দোকান থেকে দুপুরের খাবার খেয়ে চলতে থাকুন।
সারাহান
রামপুরে প্রাসাদ তৈরির আগে এখানে বুশাহার রাজারা বাস করতেন।
যাবেন: রামপুর ছাড়িয়ে ২৩ কিমি দূরের জিওরিতে পথ ভাগ হয়েছে। জাতীয় সড়ক ছেড়ে ডানহাতি পথ ধরলে ১৭ কিমি দূরে সারাহান। রামপুর বেড়িয়ে বিকেল বিকেল সারাহান পৌঁছে যান। সিমলা–সারাহান ১৭২ কিমি। সিমলা থেকে বাসও চলে।
৭,০০০ ফুট উঁচ্চতার সারাহানের পূব–পশ্চিম জুড়ে বরফ মোড়া শ্রীখণ্ড (১৭,০০০ ফুট) ও গিসু–পিসু শিখর (১৮,৫০০ ফুট)। পাহাড়ের গায়ে সাজানো আছে আপেল বাগান। কিন্নর জেলায় উৎকৃষ্ট মানের আপেল হয়। সারাহানের সমস্ত দ্রষ্টব্য হাঁটাপথে দেখে নেওয়া যায়।
ভীমাকালী মন্দির: বুশাহার রাজাদের কুলদেবতা অসুরনাশিনী দেবী ভীমাকালীর তিব্বতি শৈলীর ত্রিতল মন্দিরের দেওয়াল জুড়ে কাঠের অসাধারণ কারুকাজ। সর্বোচ্চ তলে দেবীর অবস্থান। বিগ্রহটিকে বৌদ্ধমূর্তি বলে ভুল হতে পারে। সন্ধ্যারতির ঘন্টাধ্বনিতে গমগম করে চারধার। দশেরায় মন্দিরকে ঘিরে চলে জমকালো উৎসব। চৈত্রমাসে নবরাত্রিতেও ভীমাকালী মন্দিরে বিশেষ পুজো হয়।
বার্ড পার্ক: মন্দিরের পেছন দিকের রাস্তা ধরে সামান্য চড়াই পথে আন্তর্জাতিক খ্যাতি সম্পন্ন বার্ড পার্ক। মোনাল ও ত্রাগোপান পাখির কৃত্রিম প্রজনন ঘটানো হয় এখানে। পক্ষীবিহার থেকে নিচের ভীমাকালী মন্দিরসহ সারাহান উপত্যকা দারুণ সুন্দর।
থাকবেন: রাজ্য পর্যটনের হোটেল শ্রীখণ্ড ও শ্রীখণ্ড কটেজে থাকতে পারেন (০১৭৮২–২৭৪২৩৪)। ভীমাকালী মন্দিরের অতিথি নিবাসেও (২৭৪২৪৮) থাকা যায়। আছে বেসরকারি হোটেল।
সাংলা
সবুজ সুন্দর সাংলা। ৮,৭৪০ ফুট উঁচু সাংলা বসপা উপত্যকা নামেও পরিচিত। বুক চিড়ে গেছে বসপা নদী। আপেল, পিচ, বাদাম বাগানের মাঝে ছোট ছোট কিন্নরি গ্রাম।
যাবেন: সারাহানে রাত কাটিয়ে, পরদিন প্রথমার্ধে সারাহান দেখে সাংলা চলুন। সারাহান থেকে সাংলা ৯৪ কিমি। কারছাম থেকে একটু এগিয়ে ডান হাতি রাস্তা ধরে শতদ্রু পেরিয়ে সাংলা যেতে হবে। কিন্নর–কৈলাস শৃঙ্গের সঙ্গে আপনার প্রথম মোলাকাত হবে এ পথেই। বারে বারে লুকোচুরি খেলবে সে।
এপ্রিল–মে’তে আপেল ফুলের সাদায় ছেঁয়ে যায় সাংলা। আপেল ফলে আগস্ট–সেপ্টেম্বরে।
কামরু দুর্গ: নিউ সাংলা থেকে ১ কিমি হাঁটা পথে কামরু গ্রাম পেরিয়ে কামরু দুর্গ, বুশাহার রাজাদের আদি বাসস্থান। কাঠের তৈরি প্রাচীন পাঁচতলা দুর্গে আসাম থেকে আনা দেবী কামাখ্যা অধিষ্ঠিত। বসপা নদী–সহ গোটা উপত্যকাকে দারুণ লাগে এখান থেকে।
মন্দিরগুলি: কামরু দুর্গ থেকে একটু নিচে বদ্রীনাথ ও অন্নপূর্ণার মন্দির। অন্যদিকে সাংলা বাজার থেকে সাংলা গ্রাম পেরিয়ে কাঠ–পাথরের বেরিনাগ মন্দির। তার গম্বুজ সোনার তৈরি। স্থাপত্য ভারী সুন্দর। মন্দির চত্বরে একটা প্যাগোডা আছে। কাছেই বসপা নদীর সেতু। তলা দিয়ে তুঁতে রঙা বসপা নদী বিপুল বেগে ছুটে চলেছে।
কাছেপিঠে: সাংলা থেকে সামান্য দূরত্বে কয়েকটি ছোট ছোট গ্রাম আছে।
রকছাম: ১৪ কিমি দূরে রকছাম গ্রাম। বাস বা গাড়ি বসপা নদীর পাশ দিয়ে এখানে নিয়ে যাবে। পথে পড়বে অজস্র ঝর্না, খেত, জুনিপারের জঙ্গল, রঙবেরঙের পাহাড়ি ফুল আর বরফঘেরা তুষারশিখর। রকছামের আগের বটসেরি গ্রামেও অনেকে রাত কাটান।
ছিটকুল: অপ্রতিরোধ্য এই পথে রকছাম পেরিয়ে আরও ১১ কিমি গেলে একেবারে তিব্বত সীমান্তে অসাধারণ প্রকৃতির মাঝে এই ছোট্ট জনপদ। উচ্চতা ১১,৩০০ ফুট। ছিটকুলে দেখুন ৫০০ বছরের পুরনো চিত্রলেখা মন্দির। চারদিকে তার ভুর্জগাছের বন, যার ছালে আগে লেখা হত।
মস্তরঙ: ছিটকুল থেকে আরও ৬ কিমি চারধারে বিরাট সব পাহাড়ের মাঝে অপরূপ মস্তরং উপত্যকা। মস্তরংয়ে থাকার ব্যবস্থা আছে।
থাকবেন: সাংলাতে বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় থাকতে হবে। সাংলা ও কাছাকাছি অঞ্চল ঘুরে দেখার জন্য অন্তত দু’রাতের প্রয়োজন হবে।
রেকংপিও/কল্পা
কিন্নর জেলার সদর রেকংপিও বা শুধু পিও বেশ জমজমাট। প্রচুর আপেল ও আঙুরের খেত এখানে। রেকংপিও ও কল্পার জন্য অন্তত দু’রাত দরকার।
যাবেন: সাংলা থেকে কল্পা ৫১ কিমি। কারছাম পর্যন্ত পিছিয়ে এসে জাতীয় সড়ক ধরতে হবে আবার। কল্পার ১৩ কিমি আগে রেকংপিও। পথটি অসম্ভব সুন্দর। রেকংপিও থেকেই স্পষ্ট কিন্নর–কৈলাশ কল্পায় তা স্পষ্টতর, যেন হাতছোঁয়া দূরত্বে। কৈলাস শৃঙ্গের একটু ডাইনে রাজার মতো দাঁড়িয়ে গ্রানাইট পাথরের এক শিলা। স্থানীয়রা একে শিবলিঙ্গ হিসেবে পুজো করেন। শিবভক্ত বাণাসুর নাকি এর প্রতিষ্ঠাতা। দিনের বিভিন্ন সময়ে শিলাটি রঙ বদলিয়ে লাল, বেগুনি, হলুদ কিংবা কখনও কখনও সাদা হয়ে ওঠে।
রেকংপিও: ১৯৯২ সালে দলাই লামার কালচক্র ভাষণের স্মারক হিসেবে নির্মিত মহাবোধী গুম্ফা মূল দ্রষ্টব্য। অক্টোবরের শেষ থেকে নভেম্বরের শুরু পর্যন্ত বসে আদিবাসী মেলা। ৩ কিমি দূরের কোঠী গ্রামের চণ্ডিকা মন্দিরটিও দেখতে পারেন। বিগ্রহটি সোনার।
কল্পা: ৮,৫০০ ফুট উচ্চতার কল্পার মেয়ে মহাভারতের দ্রৌপদী। পারলে পূর্ণিমার রাত বা অন্তত কোনও শুক্লপক্ষের রাত কল্পার জন্য রাখুন। বাজার সংলগ্ন প্রাচীন বৌদ্ধ মন্দিরের বাইরের কারুকাজ মুগ্ধ করার মতো। হেঁটে দেখে নিতে পারেন হু–বু–লাঙ্কার গুম্ফা ও নারায়ণ–নাগিনীর মন্দির। পাইন, ফার, জুনিপার, দেবদারু ঢেকে রেখেছে এখানকার দিগন্ত। সেপ্টেম্বরে প্রচুর পাকা আপেল ছাড়াও পিচ, নাসপাতি, আখরোট, ব্রকোলি, আঙুর, অ্যাসপারাগাস পাওয়া যায়। এ ছাড়াও চিলগোজা ফলের শাঁস রোদে শুকিয়ে বাদাম জাতীয় খাদ্য প্রস্তুত করা হয়। আঙুরের রস তৈরি হয় সুস্বাদু সুরা।
কাছেপিঠে: ৫ কিমি ও ১০ কিমি দূরে যথাক্রমে বর্ধিষ্ণু গ্রাম রোধি ও পাঙ্গি। রোধি গ্রামটি হেরিটেজ সম্মানে ভূষিত। এখানে প্যাগোডা আকারের নারায়ণ মন্দির আছে। পাঙ্গি গ্রাম অপেক্ষাকৃত বড়। এখানেও একটি সুদৃশ্য মন্দির আছে।
থাকবেন: রাজ্য পর্যটনের হোটেল কিন্নর কৈলাসে (০১৭৮৬–২২৬১৫৯) থাকতে পারেন। আছে বেসরকারি ব্যবস্থাও।
কাছেপিঠে: রোটাং পাস ও সোলাং ভ্যালি দেখতেই হবে। রোটাং পাস পেরিয়েই মানালিতে আসতে হয়। তাই বিস্তারে গেলাম না। নভেম্বর থেকে জুন পর্যন্ত সোলাং ভ্যালিতে চলে স্কি। এছাড়াও হেলি স্কি, প্যারাগ্লাইডিং, রেফটিং, রিভার ক্রসিংয়ের মতো দুঃসাহসিক অ্যাডভেঞ্চারের ব্যবস্থাও রয়েছে।
থাকবেন: রাজ্য পর্যটনের হোটেল বিয়াস (০১৯০২–২৫২৮৩২), হোটেল রোটাং (২৫২৩৩২), হোটেল কুনজম (২৫৩১৯৭), হামতা হাট (২৫৩২২৫) ছাড়াও বহু বেসরকারি হোটেলে থাকার ব্যবস্থা আছে।
ফিরবেন: মানালি থেকে চণ্ডীগড় হয়ে কলকাতা ফেরার ট্রেন ধরুন। চণ্ডীগড় থেকে ১২৩১২, কালকা মেল ধরা যেতে পারে।
কেনাকাটা: কিন্নর থেকে শাল, টুপি, রূপো ও পাথরে তৈরি কিন্নরের অলঙ্কার, মধু কিংবা শুকনো ফল সংগ্রহ করতে পারেন।
বিশদে: হিমাচল প্রদেশ পর্যটন উন্নয়ন নিগম, ২ এইচ, ইলেকট্রনিক সেন্টার, ২য় তল, ১/১এ, বিপ্লবী অনুকুল চন্দ্র স্ট্রিট, কলকাতা– ৭০০ ০৭২, ফোন: ২২১২-৬৩৬১ ওয়েবসাইট: www.hptdc.in ই-মেল: Kolkata@hptdc.in
Leave a Reply
Your email address will not be published. Required fields are marked *
Comments