বিবর্তনের সব শেষে এসেছে মানুষ। অরণ্য জীবন, গুহা জীবন, যাযাবর জীবন— একে একে সব ছেড়ে সে বেঁধেছে ঘর; কিন্তু তার পথিক–মন, তাকে বাঁধবে কে? তাই পথের নেশায় বারবার সে ছুটে গেছে প্রকৃতির অবারিত মুক্তিঙ্গনে। সে গেছে পর্বত থেকে সাগর, গেছে দারুচিনির দ্বীপে, গেছে সবুজ বনানীর দেশে।
এরকমই এক পথের দেবতার ডাকে ঘরের বাঁধন আলগা করে ঘুরতে গেছিলাম বজ্র ড্রাগনের দেশ ভুটানে। ভারতীয় উপমহাদেশে হিমালয় পর্বতমালার পূর্বাংশে অবস্থিত ভুটান। ভুটান শব্দটি এসেছে সংস্কৃত শব্দ ‘ভূ-উত্থান’ থেকে, যার অর্থ ‘উঁচু ভূমি’।
আমার স্বামী সেই সময় কোচবিহারের এবিএন শীল (গভর্মেন্ট) কলেজে অধ্যাপনা করতেন। তাই কোচবিহার থেকেই ভুটানের উদ্দেশ্যে আমাদের যাত্রা শুরু হয়েছিল। নির্দিষ্ট দিনে, দুই ঘনিষ্ঠ অধ্যাপক পরিবারের সঙ্গে ভাড়া করা গাড়িতে আমার স্বামী ও কন্যা–সহ রওনা দিলাম সুখী মানুষের দেশ ভুটানের উদ্দেশে। ভোরের টিমটিমে আলোয় স্তব্ধতা ভেদ করে চিলাপাতার জঙ্গলের ভেতর দিয়ে যেতে যেতে গাছগাছালির বুনো গন্ধে, পাতা খসানোর শব্দে সে যে কী এক রোমাঞ্চ, তা বোলে বোঝানো যাবে না। ঘণ্টা দুয়েকের মধ্যেই জয়গাঁ পৌঁছে ফুন্টশেলিং হয়ে যখন ভুটান প্রবেশ করলাম মনটা ভরে গেল। আমরা ট্রিনজিট ভিসা/পারমিশন আগে থেকেই বানিয়ে এনেছিলাম বলে মধুমিতার বাড়ি থেকে বানিয়ে আনা কেক ও বিস্কুট খেয়ে থিম্পুর উদ্দেশে আবার যাত্রা শুরু হল। ডুবুরির মতো তন্ময় চোখে দিগন্তজোড়া অপরূপ প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করতে করতে ফুন্টশেলিং থেকে গাড়ি করে থিম্পু আসতে সময় লেগেছিল ২ ঘণ্টা ১৫ মিনিট। মাঝে এক জায়গায় গাড়ি দাঁড় করিয়ে সবাই হালকা লাঞ্চও সেরে নিলাম।
থিম্পু নদীর তীরে চতুর্দিকে পাহাড় বেষ্টিত হিমালয়ের শেষ শৈল সাম্রাজ্য ভুটানের রাজধানী থিম্পু সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ৭,৩৭৫ ফুট উচ্চতায় অবস্থিত। ভগবান বুদ্ধের বলিষ্ঠ মানবতাবাদ ও আধুনিকতার মেলবন্ধনে সমৃদ্ধ সুন্দরী ভুটান আমাদের মতো ভ্রমণ–বিলাসীদের ভ্রমণ নেশাকে যে দ্বিগুন বিস্তৃত করছিল তা বলাই বাহুল্য। থিম্পুতে দুদিনের সফরের প্রথম দিন আমরা দর্দেনমা স্ট্যাচু, চোতেন জং, ন্যাশনাল মেমোরিয়াল, সিটি ভিউ পয়েন্ট, ভুটানের জাতীয় পশু তাকিন সংরক্ষিত চিড়িয়াখানা ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য দ্রষ্টব্যস্থানগুলি দেখে সফর শেষ করেছিলাম। দ্বিতীয় দিন থিম্পু থেকে ৭২ কিমি দূরে অবস্থিত সবুজ বনানী, পাহাড়, ঝর্না দিয়ে ঘেরা বিশেষ মর্যাদাসম্পন্ন পুনাখা জং দেখে বিস্মিত হলাম। আত্মমগ্ন এই পুনাখা জং–এর অনতিদূরে সাসপেনশন ব্রিজের ওপর দিয়ে যেতে যেতে ভুটানের পাহাড় ও ফু ছু নদীর এক অপরূপ দৃশ্য দেখতে দেখতে কত যে মণি মুক্ত কুড়িয়ে এনেছিলাম দু’চোখে তার বর্ণনা করতে আমি সত্যিই অপারগ।
তৃতীয় দিন থিম্পু ছেড়ে গাড়িতে ৫১ কিমি এসে পৌঁছলাম পারো চু নদীর কোল ঘেঁষে গড়ে ওটা অপরূপ পারো শহরে। স্টেডিয়ামের কাছাকাছি একটি ভালো হোটেলে রাত্রিবাস করে ভোরে উঠে তাড়াতাড়ি ব্রেকফাস্ট সেরে গাড়ি নিয়ে আবার বেড়িয়ে পরলাম নিরুদ্দেশের পথে। পারো থেকে ৮০ কিমি উত্তরে খাঁড়া পাহাড়ের চূড়ায় অবস্থিত টাইগার নেস্ট জংটিও দেখা হল তবে তা দূর থেকেই। এরপর সড়কপথে মেঘ–পাহাড়ের মধ্যে দিয়ে যেতে যেতে কখন যে পৌঁছে গেলাম ১৩,০৮৪ ফুট উচ্চতায় অবস্থিত ভুটানের সর্বোচ্চ গিরিপথ চেলে লা পাস বুঝতেই পারলাম না। ২ ঘণ্টার এই রাস্তার পুরোটা জুড়েই কতকত বিস্ময়কর শিল্পবৈভব, ঘন ওক পাইনের জঙ্গল, নানান রঙবেরঙ–এর ফুল, পাখি, আপেল, কমলালেবুর বাগান— আমাদের ভ্রমণ তৃষ্ণাকে অন্তহীন বিশালতার সামনে এনে হাজির করল।
অতীতে এই চেলে লা পাসের গিরিপথ ধরেই নাকি তিব্বতের সঙ্গে চলত বাণিজ্য। সুউচ্চ ওই তুষার শিখরের সামনে দাঁড়িয়ে নিজেদের বিলাস ও বৈরাগ্য সব মিলেমিশে একাকার হয়ে যাচ্ছিল।
চেলে লা পাস থেকে ফিরে এসে গেলাম পারোর পশ্চিমে সিকিমের সীমান্তবর্তী ‘হা’ উপত্যকায়। হা অর্থাৎ হিডেন ল্যান্ড রাইস ভ্যালি। প্রাচীনকাল থেকেই এখানে অবস্থানকারী ভারতীয় সামরিক সেনাবাহিনী, ভুটান আর্মি ও ভুটান রয়েল দেহরক্ষীদের প্রশিক্ষণে সমৃদ্ধ করে আসছেন।
সফরের শেষ দিন সারাক্ষণ বিষন্নতার কান্না, ‘যেতে নাহি দিব, যেতে নাহি দিব’ কানে নিয়েই নিরানন্দ হৃদয়ে ব্রেকফাস্ট সেরে তাড়াতাড়ি আমরা পারোর রিন পুং জং, ন্যাশনাল মিউজিয়াম, টা জং ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য দ্রষ্টব্যস্থানগুলি দেখে ফিরে এসে ভারাক্রান্ত হৃদয়ে জয়গাঁ রওনা দিলাম ঘরে ফেরার তাগিদে।
ছবি: লেখিকা
Leave a Reply
Your email address will not be published. Required fields are marked *
Comments