রোমানিয়ার রাজধানী বুখারেস্ট থেকে রওনা হয়ে সড়কপথে দীর্ঘ যাত্রার পর বুলগেরিয়ার রাজধানী সোফিয়ার নির্দিষ্ট হোটেলে পৌঁছতেই রাত সাড়ে দশটা। পথেই নজরে এসেছে পুরো শহর তন্দ্রাচ্ছন্ন। আমরা যে হোটেলে ‘চেক ইন’ করলাম তার নামটা একটু অন্যরকম। সোফিয়ায় ‘বুদাপেস্ট’ নামধারী হোটেল বেশ অবাক করল।

রিসেপশনে জানতে চেয়েছিলাম বুলগেরিয়ার রাজধানীতে হাঙ্গেরির রাজধানীর নামাঙ্কিত হোটেলের অস্তিত্বের কারণ। ভাষা সমস্যার জন্য না পারলাম বোঝাতে না কিছু বুঝতে। বোঝা গেল ইংরাজি ভাষা এখানে বহুল চর্চিত নয়।

ইউরোপের দক্ষিণপূর্ব অংশে প্রজাতান্ত্রিক বুলগেরিয়া। দেশের সীমানার উত্তরে রোমানিয়া, পশ্চিমে সার্বিয়া ও ম্যাকেদোনিয়া, গ্রীস ও তুরস্ক রয়েছে দক্ষিণে এবং পূর্বে কৃষ্ণসাগর। দেশের বিস্তার প্রায় ৪৩,০০০ বর্গ কিমি। বুলগেরিয়া দেশটা মোট তেত্রিশটা পর্বতমালা দিয়ে বেষ্টিত। তার মধ্যে অন্যতম বিতসা পর্বতমালা।

বুলগেরিয়া শব্দটি এসেছে বুলগারস (BULGARS) থেকে। এটি তুর্কি শব্দ। যার অর্থ মেশানো বা ঝাঁকানো (Shake)। দেশের জনসংখ্যা প্রায় সাড়ে সাত মিলিয়ন। তারা ছড়িয়ে রয়েছে দেশের ২৮ টি প্রদেশে। দেশের অধিকাংশই অর্থডক্স খ্রিষ্টান। সরকারি ভাষা বুলগেরিয়ান। কারেন্সি বা মুদ্রার নাম লেভ।

                                       চেঞ্জ অফ গার্ড

 

পরদিন ভোরবেলা বেশ ঠান্ডা অনুভব হল। ঘর থেকে বেরিয়ে লবির জানলা দিয়ে চোখ পড়লো দূরে ভলকানিক রেঞ্জ। খুবই উপভোগ্য। একপাশে সূর্যের আলোর প্রভাবে দারুণ লাগছে। হোটেল ছেড়ে একটু হাঁটা শুরু করলাম। হোটেলটি সোফিয়ার সেন্ট্রাল রেল ষ্টেশন থেকে হাঁটাপথে ১০ মিনিট।

ষ্টেশন দেখে হোটেলের রিসেপশন থেকে নেওয়া ম্যাপে দেখলাম আমাদের হোটেলটি শহরের সিটি সেন্টার এবং সোফিয়ার বিখ্যাত ন্যাশনাল আর্ট গ্যালারির খুবই কাছে। সবদিক থেকেই হোটেলটি শহরের প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত।

তাড়াতাড়িই ফিরে এলাম হোটেলে। এবার বেড়তে হবে। প্রাতরাশ করাও দরকার কারণ কাল রাতে ঠিকমতো খাওয়া হয়নি। যদিও কন্টিনেন্টাল ডিশ ছিল কিন্তু মূলত আলু নির্ভর খাবার। 

সোফিয়া শব্দের অর্থ প্রজ্ঞা। শহরটাকে দেখলে আমাদের পুরনো কিছু শহরের কথা মনে পড়ে। সোফিয়াকে বলা হয় বলকান দেশগুলির শহরের মধ্যে শিল্প সাহিত্য ও সংস্কৃতির তীর্থভূমি। শহরের একদিকে কৃষ্ণসাগর ও অন্যদিকে ভূমধ্যসাগর।


                                    গান গেয়ে উপার্জন

 

শহরের উপকণ্ঠে বসবাস করেন ১.২৬ মিলিয়ান মানুষ কিন্তু সোফিয়া প্রদেশে বসবাস করে আরও ১.৬৮ মিলিয়ান লোক। সোফিয়া শহরের আয়তন ৪৯২ স্কোয়ার কিলোমিটার। সোফিয়া প্রদেশকে ধরলে আয়তন দাঁড়ায় ১,৩৪৪ স্কোয়ার কিলোমিটার। এই শহরের অবস্থান বলকান বদ্বীপের মাঝখানে এগিয়ান সমুদ্রের নিকটবর্তী। সোফিয়াকে প্রথম দর্শনেই মনে ধরে।

চমৎকার সাজানো গোছানো শহর সোফিয়া। রাস্তার দুধারে ছোটবড় পাকা বাড়ি। সব বাড়ি ঘিরে আছে সবুজ বৃক্ষের সারি। দূরে দাঁড়িয়ে তুঁতে রঙের পাহাড়। লক্ষ্য করলে দেখা যায় পাহাড়ের গায়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা বরফ। সারা বছরই বরফ থাকে অল্পবিস্তর, কেবল শীতকালে চারিদিকে সাদা হয়ে বরফে ঢেকে যায়।

সকালবেলা রাস্তায় স্বল্পসংখ্যক লোকজন হাঁটে। অধিকাংশের হাতে ধরা পোস্য সারমেয়দের শেকল, কারও বা হাতে ধরা প্র্যামে শোয়ানো বাচ্চা। রাস্তার দুধারে ঘাসের মধ্যে ফুটে রয়েছে অজস্র ধরণের ফুল, তাদের রঙের বাহার বাস্তবিকই দুচোখ ভরে দেখতে হয়। 

সোফিয়া ইউরোপের প্রাচীনতম শহরগুলির মধ্যে অন্যতম। রোমান সম্রাট মারকাস উলপিয়াস ট্রায়ানাস খ্রিষ্টাব্দ ৯৭–১১৭ নাগাদ দেশটি দখল করেছিলেন। রোমানরা উপজাতি ‘সারডি’ এবং সম্রাট উলপিয়াসের যৌথ নামানুসারে শহরের নামটি ‘‌উলপিয়া সারডিকা’‌ রেখেছিল।

নবম শতাব্দীতে বুলগেরিয়ান রাজা ডানুরিয়ান সোফিয়া দখল করেন। পরবর্তীকালে ১০১৮ সালে ডানুরিয়ান সাম্রাজ্যের পতন হলে তার নাম হয় ট্রাইডিসা। রোমান সম্রাট কন্সটান্টাইন এই শহরকে ‘‌আমার রোম’‌ বলে আখ্যা দেন এবং বাস্তবিকই শহরটি তার কাছে রাজধানীর সমান গুরুত্ব পায়। 

চতুর্দশ শতকে জার আসেনের আমলে সোফিয়া নামটি প্রথম শোনা যায়। তারপর থেকেই সোফিয়া জনপ্রিয়তা পেয়ে আসছে। মনে করা হয় যে সোফিয়া নামটি এসেছে সেন্ট সোফিয়া চার্চ থেকে। এই শহরের যমজ শহর হিসাবে রুমানিয়ার বুখারেস্ট ও স্লোভাকিয়ার রাজধানী ব্রাতিস্লাভাকে চিহ্নিত করা হয়। 


                                সিটি সেন্টার সংলগ্ন স্থাপত্য

 

ইউরোপের অন্যান্য রাজধানী শহর অপেক্ষা এই শহরের চেহারাটা একেবারেই আলাদা। এই শহরে কোন বড় মাপের নদী বা ব্রিজের অস্তিত্ব নেই। তার বদলে আছে চারিদিকে ঢাকা পাহাড়। আর আছে অজস্র গোলাপ। এই সোফিয়া গোলাপের জন্য বিখ্যাত। যেখানেই যান দেখতে পাবেন গোলাপের সমারোহ।

প্রত্যেক বাড়ি, সরকারী ভবনে আর কিছু থাক বা না থাক, গোলাপ গাছ থাকবেই। গোলাপী গোলাপ বুলগেরিয়ার জাতীয় ফুল হলেও সোফিয়ায় চোখে পড়লো অজস্র লাল গোলাপ। লাল ছাড়াও গোলাপী, সাদা ও হলুদ রঙের গোলাপও যথেষ্ট সংখ্যায় দেখতে পাওয়া যায়।

গোলাপের নির্যাস থেকে প্রস্তুত এদেশের সুগন্ধীর বিশ্বজোড়া খ্যাতি।সকালে বেরিয়ে খানিকটা যাবার পর নজরে এল ছোট্ট একটা ব্রিজ। এর নাম লায়ন্স ব্রিজ। ব্রিজের সুন্দর চারটি স্তম্ভের ওপর ব্রোঞ্জের চারটি সিংহের মূর্তি। বুলগেরিয়ায় সিংহ নেই কিন্তু এদেশে সিংহ সর্বদাই সমাদৃত।

বুলগেরিয়ার কারেন্সী ‘লেভ’এ একসময়ে সিংহের ছবি ছাপা থাকত। গাইডের কাছে শুনলাম এই ব্রিজের উপর নাকি কোনও এক বলিউড ছবির আউটডোর স্যুটিং হয়েছিল। গাইড অবশ্য ছবির নাম বলতে পারেননি।

ঈগলস ব্রিজ পারলোভস্কা নদীর উপর প্রস্তুত। এটি লেভস্কি ন্যাশনাল স্টেডিয়ামের কাছে। এই সেতুর নির্মাণকাল ১৮৯১ সাল, একজন চেক বাস্তুকারের সহায়তায়। এখানেও চারটি স্তম্ভের উপর চারটি ঈগলের মূর্তি। ২০০৯ সাল থেকে ব্রিজটি সোফিয়া বিশ্ববিদ্যালয় মেট্রো ষ্টেশন হিসাবে জনগণের সেবায় নিয়োজিত হচ্ছে। ব্রিজের একটি কলাম ও একটি ঈগলের ছবি বুলগেরিয়ান কারেন্সির ২০ লেভে ১৯৯৯ সাল থেকে ২০০৭ অবধি মুদ্রণ হয়েছিল।

সোফিয়া শহরের আধুনিকতা বহু বছরের পুরনো নয়। বিশ শতকের গোড়া থেকে এই শহরের চেহারায় বদল আসতে শুরু করে। ওই সময় থেকেই শহরে বিজলী বাতির প্রচলন শুরু হয়। বিজলী বাতির সঙ্গে সঙ্গে দাপিয়ে বেড়াতে শুরু করে ট্রাম। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে সোফিয়া আরও সুন্দর করে নিজেকে মেলে ধরে। পরপর দেখা হল সোফিয়া বিশ্ববিদ্যালয়, একাডেমি অফ মিউজিক, ন্যাশনাল লাইব্রেরী।

এই লাইব্রেরীর সামনে বসা দুই ভাইয়ের মূর্তি। গাইডের কাছ থেকে জানতে পারলাম এরা দুজন সিরিলিক অ্যালফাবেট বা বুলগেরিয়ান অক্ষরমালা প্রস্তুত করেন। এদের নাম যথাক্রমে সিরিল এবং মেহডিন্স। ওনাদের সৃষ্ট অক্ষরমালা এখন সমগ্র বুলগেরিয়ার ভাষায় ব্যবহৃত অক্ষর। প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য যে এই অক্ষরমালা রাশিয়ান ভাষাতেও ব্যবহৃত হয়েছিল। পরে অবশ্য ‘পিটার দি গ্রেট’ এই বর্ণমালাকে কিছুটা সংশোধন ও পরিবর্তন করেন।


                                           রাশিয়ান চার্চ

 

চলতে চলতে উপস্থিত হলাম সোফিয়ার বিখ্যাত আলেকজান্ডার নেভস্কি ক্যাথিড্রাল চার্চের চত্বরে। সোফিয়ার সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ এই ক্যাথিড্রালের নির্মাণকাজ ১৮৮২ সালে শুরু হলেও এর ভিত্তি প্রস্তর স্থাপিত হয় ১৯ ফেব্রুয়ারি ১৮৭৯। ক্যাথিড্রালের নির্মাণকাজের অধিকাংশই সম্পন্ন হয়েছিল ১৯০৪ ও ১৯১২ সালের ভেতর। যার নামাঙ্কিত এই চার্চ তিনি অর্থাৎ সেন্ট আলেকজান্ডার নেভস্কি ছিলেন একজন রোমান যুবরাজ। এই ক্যাথিড্রাল নির্মাণের মূল উদ্দেশ্য ছিল রাশিয়ান সেনাদের স্মৃতিতে সম্মান প্রদর্শন। রাশিয়ান যোদ্ধারা ১৮৭৭–৭৮ সালে তুর্কীদের সঙ্গে যুদ্ধে প্রাণ বিসর্জন দেন। শেষে অবশ্য রাশিয়ান সৈন্যরাই জয়লাভ করেন এবং সৈন্যদের জয়লাভের ফলে বুলগেরিয়ায় অটোম্যান রাজত্বের অবসান হয়। 

এই নেভস্কি ক্যাথিড্রাল এক কথায় বলতে গেলে অসাধারণ ও অপূর্ব। চার্চের ডোমগুলি সোনার জল দিয়ে রং করা। চার্চের মধ্যে একটি ঘরে ৫০টিরও বেশি ঘণ্টা রাখা আছে। তাদের কোনটারই আয়তন নিতান্ত ছোট নয়। সবচেয়ে বড় ঘণ্টাটির ওজন প্রায় ১০ টন। এই ক্যাথিড্রাল বলকান উপদ্বীপের সবচেয়ে বড় অরথডক্স খ্রিষ্টান ক্যাথিড্রাল (চার্চ)। এর ভেতরে হলঘরে সহজেই দশ হাজার মানুষ একত্রিত হতে পারেন।

দেশবিদেশের সহায়তায় এই ক্যাথিড্রাল নির্মিত হয়েছিল। নির্মাণের কাজে ব্যবহৃত সমস্ত মার্বেল পাথর আনা হয়েছিল জার্মানির মিউনিখ শহর থেকে। লোহা সহ সমস্ত ব্যবহৃত খনিজ পদার্থ এসেছিল জার্মানির রাজধানী বার্লিন থেকে। ক্যাথিড্রালের মূল ফটক প্রস্তুত করেছিল ভিয়েনার বিশ্বখ্যাত কোম্পানি কার্ল ব্যাম্বারি এবং মোজাইক টাইলসের অংশ বিশেষ এসেছিল সুদূর ভেনিস থেকে। দিনের বেলায় এই চার্চ দেখতে একরকম।

সূর্যাস্তের পর রাতের বেলায় এই ক্যাথিড্রালের আলোকসজ্জা বাস্তবিকই অসাধারণ। আলোকসজ্জার প্রয়োজনীয় সব কিছুই করেছিল জার্মানির মিউনিখের একটি কোম্পানি। ক্যাথিড্রাল দর্শন সেরে এগিয়ে যাবার পর এল আরেকটি সুন্দর স্থাপত্য। বুলগেরিয়ার স্বনামধন্য কবি ও সাহিত্যিক ইভান ভাজভের নামে নামাঙ্কিত দি ইভান ভাজভ ন্যাশনাল থিয়েটার। রাস্তায় পরপর অবস্থিত একাধিক থিয়েটার হল নজরে এল। নাট্যচর্চায় সোফিয়া খুবই অগ্রণী।

এখানে নিয়মিত নাটক হয় এবং দর্শকের সংখ্যাও প্রচুর। এই থিয়েটারটি একসময় কাঠের তৈরি ছিল। ১৯৭৬ সালে সেটিকে ভেঙে নতুন রূপ দেওয়া হয়। স্থাপত্যের সামনের অংশটি বাস্তবিকই অসাধারণ— ছটি স্তম্ভের উপর অ্যাপোলো ও দেবকন্যাদের মূর্তি খচিত।


                                   সোফিয়ার লাল গোলাপ

 

মধ্য ইউরোপ বা পূর্ব ইউরোপের শহরগুলিতে একটি ব্যাপারে খুবই মিল লক্ষ্য করা যায়। সেটা হল রাস্তায় যন্ত্রসঙ্গীত পরিবেশনের মাধ্যমে উপার্জন। অন্যান্য সমাজতান্ত্রিক দেশগুলির মতন দেখলাম এদেশেও রাজকাপুর ও মুকেশের যুগলবন্দীর জনপ্রিয়তা জনগণকে খুবই আকর্ষণ করে। সেইরকমই একটি দল আমরা ভারতীয় বুঝতে পেরে গেয়ে উঠলো ‘মেরা জুতা হ্যায় জাপানী’।থিয়েটার হল ছাড়িয়ে এগিয়ে চললাম আরও খানিকটা।

এখানকার রাস্তা একটু সরু, গাড়ি ঘোড়া চলাচল করতে পারেনা। দুধার দিয়ে লোকজন চলাচল করছে। গাইডের নির্দেশ মতন একটা গোলাপ বাগানের ভিতর দিয়ে সরু কাঁচা রাস্তা ধরে চলতে থাকলাম। বাগানে অজস্র গোলাপ ফুটে আছে। বাতাসে ম ম করছে তার সুবাস। এই শহর গোলাপের জন্য বিখ্যাত। সরু রাস্তা পেরিয়ে আবার বড় রাস্তায় পড়লাম। নজরে এলো ফ্লিমেন্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস। খুব সুন্দর পরিবেশ, অনেকটা শান্তিনিকেতনের মতন।

১৯২৬ সালে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সোফিয়া আসার আগে ও পরে এই বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা সাহিত্য ও রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে অনেক চর্চা হয়েছে। তবে এখন তা একেবারেই অস্তমিত। ভাষাতত্ত্ব বিভাগে হিন্দি ভাষা ও সাহিত্য নিয়ে ভালই চর্চা হয়। ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে অনেকেই বৃত্তি পেয়ে দিল্লির জহরলাল নেহেরু বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে যায়।

সারাদিন ঘোরাঘুরি করে সন্ধে নাগাদ ডিনারের জন্য একটি বেশ বড় রেস্তোরাঁয় ঢুকলাম। সেখানে তখন বুলগেরিয়ান ব্যালে চলছিল, তার সঙ্গে নাচের উপযুক্ত বাজনা। বুলগেরিয়ান খাবারের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হচ্ছে খাবারের শুরুতেই প্লেটভর্তি স্যালাডের আয়োজন। সেই স্যালাডে মূলত থাকে শশা, পেঁয়াজ, টম্যাটো এবং কুচি করে কাটা বাঁধাকপি এবং অন্যান্য শাক। স্যালাডের মধ্যে টম্যাটোর ভাগটাই সবচেয়ে বেশি।

এখানে টম্যাটোর ফলনও প্রচুর। টেবিলে সাজানো থাকে ছোট ঝুরির মধ্যে বিভিন্ন সাইজের অনেকগুলো কাঁচা পাউরুটি। এটা বলকান অঞ্চলের বৈশিষ্ট্য। খিদের সময় অনেকদিন কাঁচা পাউরুটি খেয়ে ফেলেছি কিন্তু কোনওরকম শারীরিক অসুবিধা হয়নি। সেটি খাদ্যগুণে নাকি আবহাওয়ার গুণে, সেটি বলা মুশকিল। মূল খাবারের সঙ্গে রোস্টেড আলু থাকবেই। বুলগেরিয়ায় আলুর ব্যবহার খুবই বেশি।

আরেকটা জিনিষ লক্ষ্য করলাম যে খাবার টেবিলে নুন ও গোলমরিচের সঙ্গে রাখা থাকে অলিভ অয়েল। স্থানীয় লোকজন সবকিছু খাবারের সঙ্গে ঐ অলিভ অয়েল ছিটিয়ে খাচ্ছিলেন।

দ্বিতীয় দিন সকালে বেরিয়ে সিটি সেন্টার থেকে কিছু কেনাকাটা করে রওনা দিলাম সোফিয়া শহর থেকে ৫০ কিলোমিটার দূরে ‘কাজানলাক’ বলে এক জায়গায়। সেখানে যাবার পথে নজরে এল গোলাপের ক্ষেত। বিশাল জায়গার যতদূর দৃষ্টি যায় শুধুই গোলাপ। তবে সব গোলাপের রং গোলাপী। রাস্তার দুধারেই চাষ হয়েছে। অধিকাংশ গাছেই ফুটে আছে বড় বড় সাইজের গোলাপ। এই ঐতিহ্যমণ্ডিত ‘কাজানলাক’ অত্যন্ত ছোট শহর হলে কি হবে, এর কিন্তু আলাদা গুরুত্ব আছে।

প্রত্যেক বছর জুন মাসের প্রথম সপ্তাহের ছুটির দিন দুপুর বারোটার সময় এখানে গোলাপ উৎসবের সূচনা হয়। ঐ উৎসব দেখার জন্য দেশ বিদেশের বহু পর্যটক এসে উপস্থিত হন এবং সেই উপলক্ষে প্রত্যেক বছর বুলগেরিয়ায় গোলাপ সুন্দরী বা রোজ কুইন নির্বাচিত করা হয়।তৃতীয় দিন সকাল সকাল গেলাম সামোকভ শহরের পথে। এই শহরটি সোফিয়া থেকে ৬৫ কিমি দূরে। এটি বুলগেরিয়ার দক্ষিণ ঘেঁষা।

শহরটির নামকরণের সময় দুটি শব্দকে জুড়ে একটি শব্দ করা হয়েছে। বুলগেরিয়ান ভাষায় ‘সামো’ শব্দের অর্থ নিজে এবং ‘কভ’ শব্দের অর্থ হাতুরি। এইরূপ নামকরণের কারণ মূলত মধ্যযুগে এই শহর লৌহ সামগ্রী প্রস্তুতের কেন্দ্র হিসাবে পরিচিত ছিল। রিলা পর্বতের ধার ঘেঁষে সামোকভ যাবার পথ। ভারি চমৎকার রাস্তা। রাস্তায় যেতে যেতে দেখলাম পথের দুধারে প্রচুর আলু বিক্রি হচ্ছে। এছাড়াও কিছু লোক নিজহাতে প্রস্তুত জ্যাম, জেলি ও মধু বিক্রি করছে। এখানকার মধু মূলত লিন্ডেন ফুল থেকে প্রস্তুত করা হয়। সেই মধু বুলগেরিয়ার সর্বত্রই দেখতে পাওয়া যায় এবং এই মধু দিয়ে প্রস্তুত চা বুলগেরিয়ার লোকজনদের কাছে খুবই প্রিয়।


                                        পাঞ্চালেভ লেক

 

পথে পড়লো পাঞ্চালেভো লেক। বিশাল এই প্রাকৃতিক লেকের সৌন্দর্য অস্বীকার করার উপায় নেই। এই লেকের উৎপত্তি ইস্কার নদী থেকে। এই নদী থেকে লেকের উৎপত্তির কারণে অনেকে আবার এই লেককে ইস্কার লেক নামে চেনেন। লেকের ধারে কিছুটা সময় কাটিয়ে আবার রওনা দিলাম সামোকভের পথে। সুন্দর ছোট শহর সামোকভ। এখানে কেবল–কারে চড়ে পাহাড়ের চূড়ায় পৌঁছনোর সুযোগ আছে। এই কেবল কারকে স্থানীয় ভাষায় বলা হয় গন্ডোলা রাইড। সেটি এখন বন্ধ। ফলে পাহাড়ের চুড়ায় পৌঁছানো এ যাত্রায় আর হয়ে উঠল না।

সামোকভ থেকে সোজা রাস্তা চলে গেছে রিলা মনাস্ট্রি। রিলা পর্বতশ্রেণীর উত্তর–পশ্চিমে এটি বুলগেরিয়ার সবচেয়ে বড় ধর্মস্থান। মনাস্ট্রির দূরত্ব সোফিয়া থেকে ১১১ কিমি। এটি ইউনেস্কোর ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট হিসাবে স্বীকৃত। এই রিলা মনাস্ট্রি প্রতিষ্ঠা করেন ইভান রিস্কি। তাঁকে বলা হতো ‘জন অফ রিলা’। তুর্কিদের আক্রমণে এই মনাস্ট্রি একসময় সম্পূর্ণ নষ্ট হয়ে যায়। পরবর্তীকালে সুন্দর করে এটিকে পুনরায় নির্মাণ করা হয়। সেটি ১৩৩৪–৩৫ সালের ঘটনা। মনাস্ট্রির পাশেই চমৎকার সাজানো অতিথি নিবাস।

এখানে এসে অনেকেই রাত্রিটুকু অতিথি নিবাসে থাকতে পছন্দ করেন। শোনা যায় এখানকার পানীয় জল খুবই উপকারী। হজমের জন্য একেবারে ধন্বন্তরি।এবার ফেরার পালা। গন্ডোলা রাইড চড়তে না পারার আফশোসটা রয়েই গেল। ফেরার পথে পাহাড়ের কোলে জঙ্গল ঘেঁষে কয়েকটি ক্যারাভান নজরে এল। গাইডের থেকে জানতে পারলাম যে এরা এখানেই অস্থায়ী আস্তানা গড়ে নিয়ে থাকবে শীতকাল অবধি। তাদের তো শীতকালীন ক্রীড়ায় অংশগ্রহণের কথা আছে। কথা আমাদেরও আছে সোফিয়া বিমানবন্দর থেকে রাতের বিমান ধরে দোহায় পৌঁছনোর।


                         রাতের আলোয় নেভস্কি ক্যাথিড্রাল

 

রুটম্যাপ

যাওয়া :

এমিরেটসের বিমানে দুবাই হয়ে পৌঁছে যান রুমানিয়ার রাজধানী বুখারেস্ট। ইচ্ছা করলে কাতার এয়ারলাইন্সের বিমানেও দোহা হয়ে পৌঁছতে পারেন বুখারেস্ট। দিন তিনেকের মধ্যে দেখে নিন রুমানিয়ার দ্রষ্টব্য গুলি। একইভাবে দিন তিনেক নির্ধারিত করুন বুলগেরিয়ার জন্য। যাতায়াত নিয়ে আটদিনের মধ্যে হয়ে যাবে। ফেরার সময় সোফিয়া থেকে একইভাবে দুবাই বা দোহা হয়ে ফিরুন। তবে যদি ১৫/১৬ দিন সময় দিতে পারেন তবে ঐ দুটো দেশের সঙ্গে তালিকায় ক্রোয়েশিয়া, স্লোভেনিয়া ও সার্বিয়া যোগ করতে পারেন। সেক্ষেত্রে অবশ্য স্লোভেনিয়া দিয়ে এই বলকান অঞ্চলে ঢুকে পড়াটাই শ্রেয়। পরিকল্পনা সেভাবে করলে আপনাকে দুবাই বা দোহা থেকে পৌঁছতে হবে ইতালির ভেনিসে অথবা স্লোভেনিয়ার রাজধানী লুবলজানা (LJUBLJANA)। ফেরাটা বুলগেরিয়া দেখে সোফিয়া বিমানবন্দর থেকে।   

থাকা :‌

পশ্চিম ইউরোপের শহরগুলির অপেক্ষায় পূর্ব বা মধ্য ইউরোপের শহরগুলিতে থাকা বা খাওয়ার খরচ তুলনামূলক ভাবে অনেকটাই কম। সোফিয়ায় থাকার জন্য থ্রি স্টার হোটেলের খরচ রাত প্রতি ৫ থেকে ৭ হাজার টাকা। আরেকটু নিম্নমানের হোটেল চাইলে প্রতি রাতের জন্য ৩ বা ৪ হাজার টাকা খরচ করলেই হবে যা কিনা ইউরোপের অনেক রাজধানী শহরেই সম্ভব নয়। মধ্যবিত্তদের থাকার উপযোগী কয়েকটি হোটেলের নাম দেওয়া হলো যেমন সেন্ট্রাল হোটেল, সোফিয়া‌; বেস্ট ওয়েস্টার্ন প্রিমিয়ার‌; বেস্ট ওয়েস্টার্ন প্লাস ব্রিস্টল‌; রামাদা সোফিয়া সিটি সেন্টার‌; বেস্ট ওয়েস্টার্ন প্লাস‌; সিটি মেট্রোপলিটান‌। এ ছাড়াও শহরের কেন্দ্রস্থল বুদাপেস্টে হোটেল থাকার পক্ষে ভালই। হোটেল নির্বাচনের আগে অবশ্যই ইন্টারনেটের সাহায্যে সবজান্তা গুগুলের শরণাপন্ন হতে ভুলবেন না।

সব ছবি:‌ সঞ্জীব রায়‌‌

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *