আধুনিক সুপরিকল্পিত শহর চণ্ডীগড়। পাঞ্জাব ও হরিয়ানার রাজধানী। স্বাধীন ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী পন্ডিত জওহরলাল নেহরুর স্বপ্নের শহর চন্ডীগড়। পোল্যান্ডের স্থপতি ম্যাথিউ নরউইকি এবং তাঁর পরবর্তী ফরাসী স্থপতি লে কর্বুসিয়ারের মতো রূপকারদের অক্লান্ত পরিশ্রমে চণ্ডীগড় শহরটি গড়ে ওঠে। শহরের প্রত্যেকটি কোণায় কোণায় আছে পরিশীলিত, পরিমার্জিত, সুসভ্য, কর্মমুখী নাগরিকদের ছোঁয়া। ছবির মতো সাজানো গোছানো শহরটিতে দেখার জায়গা প্রচুর।

রক গার্ডেন, শুকনা লেক, রোজ গার্ডেন থেকে শুরু করে আরও কত কি। তাই তো চণ্ডীগড়ে পৌঁছে চটপট দর্শনীয় স্থানগুলো দেখে নিলাম। তবে আমি যেখানেই যাই না কেন সেই জায়গার আশেপাশে জানা–অজানা ঐতিহাসিক স্থানের খোঁজ করি।

আর সে জন্যই হয়ত চণ্ডীগড় থেকে মাত্র ১৪ কিমি দূরে ৩০০ বছর আগে ঘটে যাওয়া এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের সাক্ষ্মী ঐতিহাসিক ছপ্পড় ছিড়ির প্রান্তর আমাকে হাতছানি দিয়ে ডাক দিয়ে গেল। শিখ খালসা বাহিনীর শৌর্যবীর্য বীরত্বের ঘটে যাওয়া এক মর্মস্পর্শী কাহিনীর স্থান ছপ্পড় ছিড়ির ইতিহাস অনেকের কাছেই হয়ত এখনও অজানা।

শ্রেষ্ঠ মুঘল সম্রাট আকবর সারা ভারতবর্ষকে যে সম্প্রীতির বন্ধনে আবদ্ধ করেছিলেন, তাঁর মৃত্যুর পর বংশ পরম্পরায় সেই সম্প্রীতি ধীরে ধীরে ফিকে হতে থাকে। সময়টা ছিল ১৭১০ সালের আশেপাশে। মুঘল সম্রাট ঔরঙ্গজেবের মৃত্যু হলেও সমস্ত ভারতবর্ষ তখনও মুঘলদের কুক্ষিগত। সেই সময় পাঞ্জাবের সরহিন্দ প্রদেশ শাসন করতেন মুঘল সুবেদার ওয়াজির খান।

এই অত্যাচারী শাসক এবং তার হিন্দু দেওয়ান সূচানন্দের অত্যাচারে রাজ্যবাসীর অবস্থা শোচনীয়। ইতিমধ্যে শিখদের দশম গুরু গোবিন্দ সিংজী খালসা বাহিনী গঠন করে শিখদের ইতিহাসে এক নতুন অধ্যায় শুরু করেছেন। ফলে সরহিন্দের সুবেদার ওয়াজির খানের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে প্রচুর মানুষ গুরু গোবিন্দ সিংজীর খালসা বাহিনীতে যোগদান করতে থাকে।

এই ঘটনায় ভীষণ ক্ষুব্ধ ওয়াজির খান সূচানন্দের প্ররোচনায় গুরু গোবিন্দ সিংকে শায়েস্তা করার জন্য তাঁর নাবালক দুই পুত্র ও মাকে ধরে নিয়ে আসেন এবং তাঁদেরকে মৃত্যুদন্ডে দন্ডিত করেন।



 

এ রকম বিশৃঙ্খল অবস্থায় গুরু গোবিন্দ সিংজীর সঙ্গে দেখা হয় জম্মুর লছমন দেবের। যদিও তিনি তখন মাধো দাস সন্ন্যাসী নামেই সমধিক পরিচিত। কিন্তু গুরু গোবিন্দ সিংজীর সংস্পর্শে এসে মাধো দাস নিজেকে তাঁর পায়ে সমর্পণ করেন।

গোবিন্দ সিংজী তাঁকে খালসা বাহিনীতে নিযুক্ত করে নতুন নাম দেন বান্দা সিং বাহাদুর। অসম সাহসী, অত্যন্ত রণনিপুণ বান্দা সিং বাহাদুরের ওপর গুরু গোবিন্দ সিংজী দায়িত্ব দেন সরহিন্দের অত্যাচারী শাসক ওয়াজির খানকে পরাজিত করার। ইতিমধ্যে এই মুঘল সুবেদারের ষড়যন্ত্রে মৃত্যু হয় দশম গুরু গোবিন্দ সিংজীর।

১৭১০ সালের ১২ মে ক্রোধে আক্রোশে বান্দা সিং বাহাদুর সরহিন্দ থেকে ২০ কিমি দূরে ছপ্পড় ছিড়ি প্রান্তরে মাত্র ছ–সাত হাজার সৈন্য নিয়ে ক্ষুধার্ত সিংহের মত ওয়াজির খান এবং তাঁর বিশাল সেনাদলের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েন। এই যুদ্ধে তাঁর সঙ্গে ছিলেন আরও ৫ জন সেনানায়ক। তাঁরা হলেন ভাই ফতেহ সিং, ভাই বাজ সিং, ভাই মালি সিং, ভাই আলি সিং এবং ভাই রাম সিং। এই সেনা নায়করা প্রত্যেকই ছিলেন কোনও না কোনও শিখগুরুর আত্মীয়।

ভয়ঙ্কর যুদ্ধের শেষে বাজিমাত করেন বান্দা সিং বাহাদুর। ভাই ফতেহ সিং–এর হাতে যুদ্ধক্ষেত্রে নিহত হন অত্যাচারী মুঘল সুবেদার ওয়াজির খান। আর সেই সঙ্গে ছপ্পড় ছিড়ির প্রান্তর সাক্ষ্মী থেকে যায় এক ঐতিহাসিক স্বাধীনতা যুদ্ধের। কারণ বান্দা সিং বাহাদুরের হাত ধরে পাঞ্জাবে স্থাপিত হয় প্রথম খালসা শাসন। যার রাজধানী হয় হরিয়ানার লোহগড়। দশম গুরু গোবিন্দ সিংজীর স্বপ্ন বাস্তবায়িত করেন তাঁর প্রিয় শিষ্য বান্দা সিং বাহাদুর।

বান্দা সিং বাহাদুরের বীরত্বের এই অমর কীর্তিকে চিরস্মরণীয় করে রাখার জন্য পাঞ্জাব সরকার ছপ্পড় ছিড়ির প্রান্তরে ৩২৮ ফুট উঁচু এক মিনার স্থাপন করেন। যার নাম ফতেহ বুর্জ। মনে করা হয় এই মিনারটি ভারতবর্ষের সবচেয়ে উঁচু বিজয় স্তম্ভ।

মিনারটিকে কেন্দ্র করে সাজানো গোছানো ছোট ছোট টিলার উপর বান্দা সিং বাহাদুরের সঙ্গে ওই পাঁচজন সেনানায়ক যাঁরা ছপ্পড় ছিড়ির রণক্ষেত্রে বীর বিক্রমে যুদ্ধ করেছিলেন তাঁদের মূর্তি বসানো হয়েছে।
এক অসম বীরত্বের প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়ে আছে ছপ্পড় ছিড়ির প্রান্তর। শিখ এবং খালসা বাহিনীর শৌর্যবীর্যকে দিকে দিকে ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য অহঙ্কার আত্মগরিমায় মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে ফতেহ বুর্জ।

ছপ্পড় ছিড়িতে বহু যুগের ওপারে ঘটে যাওয়া অস্তিত্ব রক্ষার এই যুদ্ধের ইতিহাসকে সাক্ষ্মী রেখে বারংবার মনে করিয়ে দেয় ‘‌জো বোলে সো নিহাল’‌ (Whoever utter, shall be fulfilled)। শ্রদ্ধায় আবেগে মাথা নত হয়ে আসে সেই সব বীর সেনানীদের চরণতলে যাঁরা যুগের পর যুগ বিদেশী শত্রুদের হাত থেকে মাতৃভূমিকে রক্ষা করার জন্য নির্দ্ধিধায় নিজেদের প্রাণ বিসর্জন দিয়ে যাচ্ছেন যুদ্ধক্ষেত্রে।



 

খুব পরিষ্কার–পরিচ্ছন্ন মন ভালো করা জায়গা ফতেহ বুর্জ প্রাঙ্গণ। সন্ধ্যায় লাইট অ্যান্ড সাউন্ডের অনুষ্ঠানে যদি সামিল হওয়া যায় তা হলে তো কথাই নেই। আলোর খেলা আর সুন্দর উপস্থাপনার মধ্য দিয়ে মন যেন চলে যায় সেই ৩০০ বছর আগের যুদ্ধক্ষেত্রে। ফতেহ বুর্জের কাছে বান্দা সিং বাহাদুরের তৈরি একটি গুরুদোয়ারাও আছে। ইচ্ছে হলে সেখানেও ঘুরে আসা যায়।

ইতিহাস ছুঁয়ে আসা অদ্ভুত এক ভালো লাগা এখানে যেন ভেসে থাকে। বেলা যে কীভাবে বয়ে যায় টেরই পাওয়া যায় না। পড়ন্ত বিকেলে ফিকে রোদ্দুর গায়ে মেখে ছপ্পড় ছিড়ির প্রান্তরকে বিদায় জানাই। ঘোড়ার ক্ষুরের আওয়াজ, তরোয়ালের ঝনঝনানিতে মোহাবিষ্ট আমি হর্ণের আওয়াজে চমকে তাকাই, দেখি আমাদের গাড়ি ছুটছে ইতিহাসের গলি থেকে অত্যাধুনিক শহর চণ্ডীগড়ের রাস্তায়।


রুটম্যাপ
ট্রেন কিংবা বিমানে যাওয়া যায় চণ্ডীগড়। তবে দিল্লি হয়েও যাওয়া যেতে পারে। যেহেতু চণ্ডীগড় রাজধানী শহর তাই ছোট বড় হোটেলের ছড়াছড়ি। চণ্ডীগড় থেকে মাত্র ১৪ কিমি দূরে ছপ্পড় ছিড়ি। মোহালির একদম পাশেই। তবে সেখানে যেতে হলে ক্যাব বা গাড়ি রিজার্ভ করে যাওয়াই ভালো।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *