এ ফেরা অন্য ফেরা

‌‌তপন বন্দ্যোপাধ্যায় 

উচ্চতা ৪ ফুট ৬ ইঞ্চি, গায়ের রং আধা-ফরসা, রোগা পাতলা চেহারা। পরনে অতিসাধারণ শাড়ি-ব্লাউজ, কিন্তু পরিষ্কার। ঈষৎ গম্ভীর থাকে কাজের সময়। ঠিক সময়ে ঘরে ঢোকে, দ্রুত নিজের কাজটি সেরে বেরিয়ে যায় অন্য বাড়ির উদ্দেশে। কামাই প্রায় করেই না। 
কাজে ঢোকার সময় মেয়েটা তার বয়স বলেনি, দেখে মনে হয়েছিল পনেরো-ষোলো। এত কম বয়েসে কাজ করতে বেরিয়েছে দেখে খুব খারাপ লাগছিল বিপাশার। নেবে কী নেবে-না দ্বিধা দেখানোয় নিভা নামের মেয়েটি কেঁদেকেটে  অতি অল্প কথায় আত্মজীবনী জানিয়ে বলল তার পরের বোন জন্মানোর পরেই মাকে ত্যাগ দিয়ে চলে গেছে বাবা। তার মা লোকের বাড়ি কাজ করে যা আনে তাতে তিনজনের দু’বেলা খোরাকি হয় না। তার বয়স কুড়ি, তার বোনের বয়স আঠারো। মা দুজনকেই বলে দিয়েছে, নিজের রোজগার নিজে-না-করলে খেতে দিতে পারবে না।
বিপাশা আন্দাজ করে রোগা-খর্বকায়দের বয়স অনেকটাই লুকানো থাকে তাদের চেহারার মধ্যে। নিভার বয়স কুড়ি শুনে তাকে কাজে বহাল করে বলল, দ্যাখ আমাদের দুজনের সংসার, এমন কিছু কাজ নেই। মন দিয়ে কাজ করবি। 
তা নিভার কাজ খুব পরিষ্কার, কিন্তু তার যেটুকু দায়িত্ব তার বেশি কিছু কাজ করতে বললে স্পষ্ট বলে দেয়, পারবনি। 
‘পারবনি’ শব্দটা বেশ মেজাজ নিয়েই বলে, যা বিপাশার পছন্দ হয় না। বিরক্ত মুখে সুরঞ্জনকে বলে, আমি কি ওকে বিনা পয়সায় কাজটা করাতাম! কীরকম কাঠ-কাঠ গলায় মুখে-মুখে উত্তর দেয়। 
সুরঞ্জন ভাবছিল ‘না’ বলাটাও একটা আর্ট এই মর্মে নিভার একটা ক্লাস নেয়। শুনে বিপাশা মুখ বেজার করে বলল, তুমি আর আদিখ্যেতা দেখিয়ো ন। তাতে ওর ডাঁট আরও বেড়ে যাবে। 
তবে নিভা নিজের কাজটা করছিল ভালোই, বছর খানেক নিশ্চিন্ত ছিল বিপাশা, হঠাৎ একদিন সুরঞ্জনকে বলল, নিভা একটু বদলে গেছে। আর কাজকম্মে মন নেই। 
— হঠাৎ এরকম কেন মনে হল? 
— ক দিন আগে হঠাৎ ওর মোবাইলে একটা ফোন এল, ও-প্রান্তের কথা কিছুক্ষণ শুনে খুব চ্যঁাচাল, বলল, ‘আমি তোমাকে আগেই বলেছিলাম, ওর ওপর নজর রাখো।  তুমি তো বিশ্বাসই করছিলে না। এখন বোঝো!’ নিশ্চয়ই বাড়িতে কিছু একটা ঘটেছে। আমি দু-তিনবার জিজ্ঞাসা করলাম, কিন্তু কিছুতেই ভাঙল না। 
নিভা চাপা মেয়ে, তার কাছ থেকে কোনো কথা আদায় করতে পারল না বিপাশা। লক্ষ করল খুবই অন্যমনস্ক দেখাচ্ছে তাকে। কাজে কিছু ভুলভালও করল। 

বিশাখা গোয়েন্দার মতো লেগে থেকে ঠিক বার করে ফেলল তার এই অসংগত আচরণের কারণ। বিষয়টা বেশ পুরোনো হয়ে গেছে, তাই গোপন করার আর কোনো কারণ নেই। নিভা ক্ষুব্ধ গলায় বলল, ‘ইভা বাড়ি থেকে পালিয়ে গেছে।’ ইভা নিভার ছোটোবোন। কিছুদিন ধরে এক ফলওয়ালার সঙ্গে এক গলির মুখে দাঁড়িয়ে কথা বলতে দেখা যাচ্ছিল, হঠাৎ একদিন সকালে কাজ করতে বেরিয়ে আর ফেরেনি বাড়িতে।  ফলওয়ালাও উধাও। ওর মা থানা-পুলিশ পর্যন্ত করেছে, কোনো লাভ হয়নি। 
বিপাশা অনুমান করল নিভার ক্ষোভের কারণ। তার পরের বোন পালিয়ে গিয়ে বিয়ে করে ফেলল, আর সে রইল পড়ে। ভুরুতে একটা লম্বা কোঁচ ঝুলিয়ে কাজ করে যায় রোজ। কথা প্রায় বলেই না কারও সঙ্গে। 
আবার একদিন ক্ষোভ কেটে যায় তার। কিছুদিন পরে একটু-একটু হাসিও ঠোঁটের কোণে। নিভার আর সবই ভালো, শুধু মাঝে মাঝে এমন ঝেঁজে উঠে বলে, ‘পারবনি’, তা বিপাশার কাছে মনে হয় অপমানজনক। তখন দু-চারদিন নিভার সঙ্গে বাক্যালাপ বন্ধ হয়ে যায় বিপাশার। সুরঞ্জনকে বলে, এমন রুখে উঠে বলার কী আছে! 
ক’দিন পরে আবার সব ঠিকঠাক। 
নিভা একদিন হঠাৎ খুব আস্তে আস্তে বলল, বউদিমণি, আমি কিছু টাকা জমিয়েছি। তোমার কাছে রাখবে? আমি পাঁচটা বাড়ি কাজ করতাম। তার সব টাকা মা কেড়ে নেয়। কিন্তু আমার তো কিছু টাকা লাগে। তাই আরও দুটো বাড়িতে কাজ ধরেছি। সেই বাড়িদুটোর কথা মাকে বলিনি। তার টাকা প্রতিমাসে তোমার কাছে রেখে যাব। 
বলে ব্লাউজের ভেতর থেকে বার করল কিছু টাকা। মোট দেড় হাজার। বিপাশা একটা খাতায় টাকার অঙ্ক আর তারিখ লিখে নিভকে সই করতে বলল। রাতে সুরঞ্জনকে বলল, প্রতি মাসে খাতায় লিখে রাখাই ভালো। কারণ কয়েক মাস পরে ওর হয়তো সব মনে থাকবে না। তখন চ্যঁাচামেচি করতে পারে। 
চলছিল বেশ। হঠাৎ বিপাশা লক্ষ করল নিভার চালচলনে বেশ ফুর্তির ছাপ। একটা জংলা শাড়ি পরেছে, খোঁপায় একগুচ্ছ সাদা ফুল। সুরঞ্জনকে বলল, কী ব্যাপার  বলো তো! নিভা দেখি ঘর মুছতে মুছতে গুনগুন করে গান করছে। 
সুরঞ্জন বলল, দ্যাখো, ওর মা হয়তো বিয়ের ঠিক করেছে। 
নিভার বিয়ের ঠিক হয়ে গেলে বিপাশা ভারি মুশকিলে পড়বে। খুব কাজের মেয়ে নিভা। কাজকর্ম খুব পরিষ্কার আর টিপটপ। প্রায় দু বছর কাজ করছে এ-বাড়িতে। তবে এ-বয়সের মেয়ে কাজে রাখলে যা হয়, কবে যে তার বিয়ে হয়ে যাবে ভেবে তটস্থ থাকতে হয়। আজকাল কাজের মেয়ে পাওয়া খুব কঠিন। ভালো কাজের মেয়ে পাওয়া কঠিনতর।
বিপাশা পরদিন আড়েওড়ে জিজ্ঞাসা করল, কী রে, মনে হচ্ছে তোর মনে খুব আনন্দ! 
নিভা কিছু বলল না। হাসল ফিক করে। 
— তোর মা কি বিয়ের ঠিক করেছে? 
— মা! নিভা ফোঁস করে ওঠে, মা আমার বিয়ে দেবে! আমি তো টাকা রোজগারের একটা কল। 
ইভা তা আগেই বুঝেছিল বলে বিয়ে করে পালিয়ে গেছে। গিয়ে বেঁচে গেছে।
বিপাশা ঠিক বুঝে উঠতে পারল না নিভার কথা। কিন্তু খেয়াল করছিল নিভা বেশ বদলে গেছে।
একদিন কাজ সেরে চলে যাওয়ার আগে বলল, বউদিমণি, টাকাটা আমাকে দেবে! ব্যাঙ্কে রাখব।
বিপাশার মনে একটা সন্দেহ হল, কিন্তু কিছু বলল না।
দিনদুয়েক পরে সুরঞ্জন বাস থেকে নেমে ঘরের পথে ফিরছে, দেখল একটা বিচ্ছিরি দেখতে ছেলের সঙ্গে ঘুরছে নিভা। গুন্ডা-গুন্ডা চেহারা। বাড়ি ফিরে ঘটনাটা বলল বিপাশাকে। 
পরের দিন সকালে কাজে আসতেই বিপাশা চেপে ধরল, নিভা, ওই ছেলেটা কে রে? 
নিভা প্রথমে গাছের মগডাল থেকে পড়লেও বিপাশা দুই ধমক দিতে বলল, বউদিমণি, আমি ওকে বিয়ে করব। 
— সে কী, ওই ছেলেটা! মানে খোঁজখবর নিয়েছিস কে ও? বাড়িতে কে আছে না আছে জানিস কিছু? তোর মা জানে এসব? 
নিভা চুপ করে থাকে। 
নিভা বিয়ে করবে তা জানাই ছিল, কিন্তু এসব ক্ষেত্রে যা হয়, হঠাৎ নিভা বিয়ে করে কাজ ছেড়ে দিলে খুবই আতান্তরে পড়বে বিপাশা। নিভাকে অনেক বুঝিয়ে বলল, বিয়ে করবি নিশ্চয়ই, কিন্তু তোর মাকে বল সব। তোর মা খোঁজ নিয়ে দেখুক। আগে দেখা যাক ছেলেটা ভালো কিনা! 
বিপাশা কিছুটা নিজের স্বার্থের কথা ভাবছিল না তা নয়, তবে এও ভাবছিল নিভা মেয়ে হিসেবে বেশ ভালো, তার জীবন যেন বয়ে চলে ঠিকঠাক পথে। 
কী আশ্চর্য, তার ঠিক পরের দিনই নিভা আর কাজে এল না।  তার পরের দিনও না। নিভা একেবারেই কামাই করে না, তাই পর পর দুদিনের অনুপস্থিতি একটু অবাক করল তাকে। সুরঞ্জন ওকে দেখে ফেলেছে একটি ছেলের সঙ্গে ঘুরতে, তাই হয়তো ভয় পেয়ে—
নিভার মায়ের কাছে খোঁজখবর নিতেই তার মা এসে পা ছড়িয়ে কাঁদতে বসল অমনি। বলল, একটা গুন্ডা ছেলে, তার পাল্লায় পড়ে আমার মেয়েটা—
বিপাশা ভাবতেই পারেনি এত তাড়াতাড়ি কাজ ছেড়ে দেবে নিভা। সুরঞ্জন যে নিভাকে দেখেছে তা নিভাকে না বললেই হত। তাহলে হয়তো এখনই ওকে পালাতে হত না। বিপাশা খুবই ঝামেলায় পড়ল। হঠাৎ কাজের লোক চলে গেলে সমস্ত ঝক্কি তার ঘাড়ে গিয়ে পড়ায় খুব রাগ হল নিভার ওপর। যাবি তো যাবি, কিছুদিন আগে বলতে পারলি না তোর চলে যাওয়ার কথা! লোক দেখে নিতাম! 
সংসার থেমে থাকে না। এক কাজের লোক চলে যায়, আর এক কাজের লোক আসে। মাঝে কয়েকদিন বিপাশার সংসারে টালমাটাল অবস্থা। নিভা গেল, সবিতা এসে ধরে নিল নিভার ফেলে যাওয়া কাজ। কিছুদিন সুরঞ্জন-বিপাশার কথোপকথনের মধ্যে নিভা-প্রসঙ্গ ঘুরে-ফিরে এল, ভালোয়-মন্দয় মেশানো সেই সংলাপ কিছুদিনের মধ্যে মিলিয়ে গেল হাওয়ায়।
তারপর কত হাওয়া বয়ে গেল বিপাশার সংসারের 
ওপর দিয়ে। নিভারও নিভতে দেরি হল না। বছর দুই পরে হঠাৎ একটা কলিং বেলের শব্দে একটা পুরোনো অধ্যায়ের নবসূচনা।
কলিং বেলের শব্দ পেয়ে বিপাশা রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে আঁচলে হাত মুছতে মুছতে দরজা খুলে দেখল সবুজ আঁচলে ঘোমটা দেওয়া এক তরুণী। কপালে বড়ো করে সিঁদুরের টিপ, সিঁথিতেও লম্বা করে সিঁদুর। কাঁখে ধরা বছরখানেকের একটি বাচ্চা। অন্য হাতে একটা পেটমোটা কাপড়ের ব্যাগ। 
নিশ্চয় কোনো সেলসগার্ল। গ্রামাঞ্চলের কোনো গৃহবধূ অভাবের তাড়নায় বেরিয়েছে কিছু সওদা নিয়ে। বিপাশা বলে উঠতে যাচ্ছিল, ‘না, আপাতত কিছু লাগবে না।’ তার আগেই যুবতি সামান্য হেসে বলল, বউদিমণি আমাকে চিনতে পারছ না! 
কণ্ঠস্বর খুবই চেনা, ভালো করে তাকাতে দেখল, আরে, নিভা না! প্রায় তিন বছর পরে দেখছে বলেই শুধু নয়, বিয়ে হওয়া নিভাকে আর দেখেইনি তো! বিয়ের পর মেয়েদের চেহারার একটু বদল ঘটে, তার ওপর কোলে বছর খানেকের একটি শিশু। তিন বছরে অনেকটাই বদলে গেছে নিভা। 
এতদিন পরে হঠাৎ তাকে দেখে অবাক হওয়ারই কথা। বলল, বোস নিভা। তোর বাচ্চাটা দেখছি তোর মতোই হয়েছে। 
মেঝের ওপর পা ছড়িয়ে বসে নিভা হঠাৎ হাউমাউ করে কেঁদে উঠে বলল, বউদিমণি তখন তোমার কথা শুনিনি। কী এট্টা খারাপ লোকের সঙ্গে তখন পালিয়ে গিসলাম,এখন আমারে ছেড়ে সে কোথায় উধাও হয়ে গেল, আর খুঁজে পেলামনি। বাচ্চা নিয়ে মা-র কাছে থাকতে গেলাম, মা দূরদূর করে তাড়িয়ে দিল। তুমি আমারে রাখবা? 
ঘটনাটা এমনই আকস্মিক, বিপাশা প্রথম মুহূর্তে বুঝে উঠতে পারল না তার এখন কী করা উচিত। তখন নিভা কাজ ছেড়ে পালিয়ে গিয়েছিল বলে খুব রাগ হয়েছিল তার ওপর। তারপর সত্যিই আর নিভার মতো ভালো কাজের লোক পায়নি। 
নিভা কান্না-কান্না গলায় বলল, বউদিমণি, এই তিন বছর রোজ তোমার কথা ভেবেছি।  তুমি তো আমার ভালোর জন্যই বলেছিলে। 
বিপাশার মনে পড়ল তিন বছর আগের কথা। তখন কিছুটা হলেও কথাটা বলেছিল তার নিজের স্বার্থের কথা ভেবে, এখন ভাবল নিভার স্বার্থের কথা। বলল, ঠিক আছে, এখন এখানে বিশ্রাম নে। আমি তোর মাকে খবর দিচ্ছি, তাকে বুঝিয়ে রাজি করাব যাতে তোকে থাকতে দেয়। আর আমার তো বয়স হচ্ছে। আর একজনকে লাগবে। তুই আমার অন্য টুকটাক কাজগুলো করে দিবি। দুপুরে এখানে খাবি। আর যা টাকা দেব তাতে তোর বাকি খরচ চলে যাবে। 
নিভা প্রায় ঈশ্বরী দেখার মতো চোখ করে দেখল বিপাশাকে, হাসি আর কান্নায় ভরা সেই অভিব্যক্তি, বাচ্চাটাকে বুকের মধ্যে চেপে ধরে হঠাৎ কেঁদে ফেলল হু হু করে। বলল বউদিমণি, আমি জানতাম, আর কেউ না থাক, তুমি আমাকে ফেরাবে না। 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *