স্লোভেনিয়া দেশটি বলকান ব–দ্বীপের উত্তরদিকে অবস্থিত। এর পশ্চিমে ইতালি, উত্তরে অস্ট্রিয়া, উত্তর–পূর্বে হাঙ্গেরি, ক্রোয়েশিয়া এবং দক্ষিণ–পূর্ব ও পশ্চিমে অ্যাড্রিয়াটিক সমুদ্র। পাহাড়–পর্বতে ঢাকা এ দেশের জলবায়ু মূলত কনটিনেন্টাল, তবে কিছু অংশে ভূমধ্যসাগরীয় জলবায়ু ও অ্যালপাইন জলবায়ু দেখা যায়। দেশের সরকারি ভাষা স্লোভেন।

সেন্ট্রাল স্কোয়্যার
                                     সেন্ট্রাল স্কোয়্যার


স্লোভেনিয়ার মধ্যভাগে অবস্থিত রাজধানী ল্যুবল্যানা একটি ছোট্ট শহর এবং দেশের আর্থিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক ও সাংগঠনিক পীঠস্থান। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ৯৬৮ ফুট উঁচুতে অবস্থিত এই শহরের আয়তন মাত্র ৬৩ স্কোয়ার মাইলস এবং বর্তমান লোকসংখ্যা ২ লক্ষ ৮০ হাজার। শহরের মূল কেন্দ্র সিটি সেন্টার থেকে অনেকটাই উঁচুতে অবস্থিত ল্যুবল্যানা।


                                      পরিষ্কার রাস্তাঘাট

ক্যাসেল একটি প্রাচীন দূর্গ। ট্রেজার অফ ল্যুবল্যানা নামে সেটি পরিচিত। রোমান আমলে দূর্গটি সেনা ছাউনি হিসাবে এবং অস্ট্রীয় রাজাদের আমলে জেলখানা হিসাবে ব্যবহৃত হত। পরবর্তিকালে সেখানে নগর প্রহরীরা বাস করতে শুরু করে। তাদের কাজ ছিল মূলত শহরে আগুন লাগলে বা কোন বিপর্যয় হলে কামান দেগে শহরবাসীদের সজাগ করা। ক্যাসেলটি এখন বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান বা বিবাহোৎসবের জন্য ব্যবহৃত হয়। ২০০৬ সালে তৈরি হওয়া গণ্ডোলা বা ফিউনিকুলার চেপে চটজলদি সিটি সেন্টার থেকে ক্যাসেলে পৌঁছে যাওয়া যায়। ক্যাসেলের মাথার উপরে বসানো ড্রাগনের মূর্তিটি দেশবাসীর কাছে অতি পবিত্র। তারা বিশ্বাস করে যে এই ড্রাগন বাস্তবিকই শক্তি, সাহস ও মঙ্গলের প্রতীক।


                                        রিপাবলিক স্কোয়্যার

তাদের ধারণা সেই ড্রাগনের আশীর্বাদেই দেশে জলের সরবরাহ ও জমির উর্বরা শক্তি বৃদ্ধি পায়। ড্রাগনের কল্যাণেই তারা নাকি একাধিকবার বন্যা ও আগুনের হাত থেকেও রেহাই পেয়েছে।
ছবির মতন সাজানো সুন্দর ও শান্ত শহর ল্যুবল্যানার ভেতর অনেকগুলো সেতু রয়েছে। তাদের মধ্যে সর্বাপেক্ষা উল্লেখযোগ্য হল ট্রিপল ব্রিজ। প্রকৃতপক্ষে তিনটি ব্রিজের সমষ্টি ঐ ব্রিজটি মধ্য ইউরোপের সঙ্গে বলকান শহরকে যুক্ত করেছে। এছাড়া, রেলস্টেশনের কাছেই ল্যুবল্যানার অন্যতম স্মারক হিসাবে চিহ্নিত শতাধিক বছরের পুরানো ড্রাগন ব্রিজ। ব্রিজের চার কোনায় চারটি ড্রাগনের মূর্তি সুন্দর ভাস্কর্যের জন্য প্রশংসিত। এছাড়া আরও দুটি শতাব্দী প্রাচীন ব্রিজ যথা ট্রনোভো ও হ্রাডেকি ইউরোপের ইতিহাসে স্থান করে নিয়েছে।


                     ফিউনিকুলার চড়ে ক্যাসেল যাবার রাস্তা

ছোট এই শহরের মূল রাজপথে ট্রামলাইন। একটাই লাইন। দুমুখো ট্রাম এক লাইনেই অল্প দূরত্বের মধ্যে যাতায়াত করে। ট্রাম লাইন ধরে এগোলে চমৎকার উদ্যান টিভলি সিটি পার্ক। উদ্যানের ভেতরে ফুটে রয়েছে নানা রঙের লিলি। লিলিদের ধার ঘেঁষে জলাশয়ে ভেসে চলেছে কয়েকটি রাজহাঁস, হরেক রকমের মাছ খেলে বেড়াচ্ছে। জলাশয়ের পাড়ে শুরু শহরের সবচেয়ে বড় উদ্যান বোটানিক্যাল গার্ডেন। নানা ধরণের গাছ দিয়ে সাজানো এর আয়তন ৫ বর্গকিমি। যে শিল্পীর পরিকল্পনায় এই বাগান সাজানো হয়েছে সেই জ্যাকোপিস প্রমেনেদের নামানুসারে গার্ডেনের ভেতরের রাস্তার নামকরণ হয়েছে। ভেতরে ফুলের বাগান ও চমৎকার ফোয়ারা। এর পাশ দিয়ে রঙিন পাথরে বাঁধানো তিনটি পায়ে চলার পথ। পথের শেষে ছোট একটি গির্জা। গির্জার পাশেই ঐতিহাসিক সংরক্ষণশালা ন্যাশনাল মিউজিয়াম অফ কনটেম্পোরারি হিষ্ট্রি। মিউজিয়ামের গা ঘেঁষে বয়ে চলেছে ল্যুবলিয়ানিকা নদী। ছোট একফালি নদীখানা দেখে মনে হয় যেন এক জলনিকাশি খাল।


                                   সিটি সেন্টারের অংশ

নদীর অপর পাশে শহরের মাঝখানে অবস্থিত সেন্ট্রাল স্কোয়্যার যার সৃষ্টি অষ্টাদশ শতাব্দীতে। তবে বিংশ শতাব্দীতে সেটিকে আধুনিক স্কোয়্যার হিসাবে তুলে ধরা হয়েছে। ঐ স্কোয়্যারে পর্যটকদের ট্যুরিস্ট ট্রেনে ঘোরানোর ব্যবস্থা রয়েছে। স্কোয়্যারের মাঝখানে স্লোভেনিয়ার জাতীয় কবি ফ্র্যাংক প্রিসেরেনের বিশাল মূর্তি দেখতে পেলাম। সেন্ট্রাল স্কোয়্যারের পরেই রিপাবলিক স্কোয়্যারের নাম উল্লেখ করা প্রয়োজন। রিপাবলিক স্কোয়্যারের নাম ছিল রেভোলিউশন স্কোয়্যার। ঐ স্কোয়্যার থেকেই ১৯৯১ সালের ২৬ জুন দেশের স্বাধীনতা ঘোষিত হয়।


                                    ফ্র্যাংক প্রিসেরেনের মূর্তি

পরিশেষে, বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য যে স্লোভেনিয়া সবুজ রক্ষার ব্যাপারে খুবই যত্নশীল। ছোট শহরটির চারিদিকে কেবল সবুজ আর সবুজ। সেই সবুজ রক্ষার স্বীকৃতি হিসাবে ২০১৬ সালে ল্যুবল্যানাকে ইউরোপের সবুজ রাজধানী হিসাবে মনোনীত করা হয়।


                      ল্যুবল্যানায় টাটকা ফল ও সবজির বাজার

রুটম্যাপ
ল্যুবল্যানার যোগাযোগ ব্যবস্থা অর্থাৎ আকাশপথ, রেলপথ ও স্থলপথ তিনটিই খুব উন্নত। শহরের বিমান বন্দর মূল শহরের ২৬ কিমি দূরে উত্তর–পশ্চিম অংশে অবস্থিত। সেখান থেকে ইউরোপের সব শহরের বিমান ওঠানামা করে। শহরের মধ্যে রয়েছে ছ’টি রেল ষ্টেশন। সব আন্তর্জাতিক ট্রেনই এখানে আসা–যাওয়া করে। সড়কপথে (ই ৫৭, ই ৬১, ই ৭০) ল্যুবল্যানা ইউরোপের সব অংশের সঙ্গে যুক্ত।

ছবি:‌ লেখক

Comments

  • সবুজে ঘেরা ঝকঝকে ল্যুবল্যানা শহরটি ছিমছাম ভ্রমণ কাহিনীতে ভালো লেগে গেল। বরাবরের মতো লেখকের পরিশীলিত লেখনীতে পত্রিকার সংক্ষিপ্ত পরিসরে নতুন দেশের রূপরেখা আকর্ষণীয় হয়ে ধরা দেয়।

    - ARPITA BHATTACHARYA

    Mon, Feb 1, 2021 5:34 AM

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *